ভূমিকা
ডিঙ্গাপোতা হাওড়ের পাশের একটি গ্রামে একজন কৃষক গত দুইদিন আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। অথবা রতন মিয়ার বাড়ি বাজিতপুরের হুমাইপুরে। রতন মিয়া (৩৬) এনজিও থেকে সুদের টাকা এনে ছয় একর জমি চাষ করেছিলেন। আমরা জানতে পেরেছি অন্তত এই দুইজনের ফিঙ্গার প্রিন্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র আর দল ও ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত না থাকায়, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কিছু করার ছিল না।
বর্তমানে হাওড়ের চাষীরা প্রকৃতির সাথে রাষ্ট্রের একটা প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদনে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ নিয়ে তারা একটি স্মারকলিপি কাগজের নৌকায় করে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়েও দিয়েছেন। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির অনেক সাংবাদিক ছিলেন, যারা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কারণে কোন ছবি তুলে পাঠাতে পারেন নি বলে মর্মাহত।
তো এইসব নিয়ে বন্ধু সাদিয়া'র সাথে একদিন কথোপকথন। আমাদেরই বয়ান, সখি ও মাঝির আলাপে, হাওড়ের অবারিত দুখ সুখের মিলনে।
কথোপকথোন
মাঝি - জানো সখী হাওরে যহন পানি আহে আমি সাঁতরাই অার সাঁতরাই। আমার নৌকা সাঁতরায়, আমার মরা বাপ মায় সাঁতরায়। অামার খোয়াবও ঘোলা পানিত সাঁতরায়। পিছলা মাছের মতোন ডুবসাঁতার মারে। সাঁতরাইতে সাঁতরাইতে অামার দম ফুরায় অাহে।
সখী - ওইডা তো সাঁতার না মাঝি। তুমিতো খালি হুগনায় খাবি খাও। বান তোমার নাও গিলছে গেলবার। অারেকখান নাও পাইলা কই? বাপ-মায়েরেও তো গিল্যা খাইছে। বচ্ছরতো গেল খোনকার বাড়ির বোঝা টানতে টানতে। অার খোয়াব! খোয়াবের কথা হুনলে হাসি লাগে মাঝি। ভাত-সালুনের খোয়াব ছাড়া অার খোয়াব অাছেনি দুনিয়াত?
মাঝি - অাছে সখী। বাপ-মার লাশের পিঠে উইঠা আমি খোয়াব দেহি, সাদা কাফনে মোড়াইয়া হেগো কলমা পড়তে পড়তে কব্বরে শোয়াই।
সখী - বানের মইদ্দে কব্বর পাইলা কই! খালি হাসাওগো মাঝি!
মাঝি - সখীরে অামার লগে লগে গরু বাছুর ভাইস্যা যায়। ভাসতে ভাসতে রাইত নামে। চান্দে তার অালো নিয়া বেশুমার ভাসে অাসমানের মেঘের মইদ্দে! অাহারে, কী সুন্দর চান্দের অালো! য্যান বাত্তি জ্বলে অাসমানে! হাওরের পানিত চান্দের ছায়া ঝকঝক করে, সাদা ভাতের লাহান।
সখী - ভাতের খোয়াব অামিও দেহি মাঝি। সোনালি গাইয়ের দুধের লাহান ফকফকা সাদা ভাত। লগে লাল সবুজ সালুন। একখান মরিচ পোড়া অার পিঁয়াজের ঝাঁঝ। মনে পড়তেই প্যাটের মইদ্দে ঢকঢক করে। খালি পেটে পানি যাইয়া খাবি খায়।
মাঝি - কাল রাইতে রমিছা খালা ভাত দিছিল। হিস্যার পানি না পাইয়া বানের ঘোলা পানি থিতায় সানকিত দিছে। লগে দুই চামচ চিনি। হায়রে, তার সোয়াদ! যেন মায়ের হাতের ফিন্নি খাইছি সখী!
সখী - পানি উজাইলে, খিদাও উজায় মাঝি।
মাঝি - যহন পানি উজায় খিদার লগে লগে মনটাও উজায়। পক্ষীর লাহান ফাল পাড়ে। চাইরধারে বেদিশ ওড়ে।
সখী - অত উজাইও না মাঝি, ভাইস্যা যাইবা।
মাঝি - মন্দ কী! ভাসতে ভাসতে বেহেশতে ঠেকি যদি!
সখী - শখ কত! ভাত পায় না বেহেশতের খোয়াব দেহে! বাসি পেটে হাসি পায়গো মাঝি।
মাঝি - হ বেহেশতের খোয়াব দেখুমই তো। অামি ডাকার অাগেই বেহেশতী খোয়াব অামার দরজায় খাঁড়ায় থাহে। বিহানথন অামার ঘর হুদ্দা বেহেশতি খুশবু। মনে কয় অার দেরি নাই, বেহেশতে যাইতে।
সখী - ব্যাডাছাওয়ালের খাছলতই খারাপ। দুনিয়ার দিকদারি শ্যাষ, অহন খালি হুরের নেশা।
মাঝি - হাহা। দুনিয়ার হুরই তো বাসি হয় নাই।
সখী - রঙ কত!
মাঝি - মশকরা না সখী। হুনছি ফেরেশতারা আহে খাওন লইয়া, রহমত লইয়া। অামিতো পুরা দুই পায়ে খাঁড়ায় অাছি। যহন জিগাইব তুমি কি মুসলমান, কি কমু জানো?
সখী - না।
মাঝি - কমু অামি মানুষ।
সখী - মানুষ কইয়া পার পাইবা? যহন কলমা জিগাইব তহনতো অালজিব হুগায় অাইবো। অামগো লাইগা বেহেশত না। বেশি খোয়াব দেইখো না মাঝি। দুনিয়ার খাওন পিন্দন ভালা ঠেহে না তবু মাটি কামড়ায় পইড়া থাহো। মরলে তো দোজখ হা কইরা গিলবো। বানের পানির মইদ্দে মোচড়াইব।
মাঝি - মাটি কই সখী?
সখী - ওই হেথা।
মাঝি - হেথাতো শুধু পানি অার পানি। তয় তুমি ঠিকই কইছ সখী। ভাতের লাহান বেহেশতও পামু না। তবু খোয়াব দেহি, দিনরাত বেহেশতী বাসনা পাই। অাতকা ঘুম ভাইঙ্গা গেলে কান্দি। বেবাক মাইনসে কানে পট্টি দিয়া থাকে, অামার কান্দন হোনে না সখী!
সখী - তয় যে বেলা কইরা উঠল্যা?
মাঝি - বেহেশতের খাওনের লোভে অাবার ঘুম গেছি। কিন্তুক খোয়াব বদলায় গেছিল। শেষ খোয়াবে দেহি আমার শইল্যে কাপড় নাই, আমি ল্যাংটা। অামি তহন অাবার দুইনাত ফিরতে ছটফটাই।
সখী - কিন্তুক ফিরতে পারো না, কব্বরের কপাট বন্ধ তহন।
মাঝি - হ রে সখী, কব্বরের আন্ধারে মচ্ছব লাগে হিস্যা হিস্যা কইরা চেঁচাই দেইখা পোকারা আমারে খুইটা খুইটা খায়। আমার কাতুকুতু লাগে,শরমও লাগে। শরম লাগে, আমি আমার ভাইয়েগো মাংসও এমনি খুইটা খায়। একসমো অাবার অান্ধার কব্বরে অামার ঘুমও আহে।
সখী - অাহা! তহন তোমার শইল জারে জর জর! কাম পোড়ায় তোমার শইলরে! হাহাহা! কিন্তুক বেকুব মাঝি, খালি এক চামচ হিস্যার লাইগা খুনখুন কইরা কান্দো। নাকি ঘুমাও ফের?
মাঝি - চোখের মনিতো খবিশে খায়, ঘুমামু কেমতে! হাসফাস করতে করতে অামার অাবার ঘুম ভাইঙা যায়। উইঠা দেহি অামার পিন্দনের কাপড় ভিজা। বানের পানিত ডুইব্যা অাছি। ডুইব্যা অাছে ঘরদোর, ডুইবা অাছে বেবাক খোয়াব।
সখী - তবু মরণ নাই।
মাঝি - মরি তো! আমি আবার মরি, কিন্তু এইবার আমার লগে রাজাও মরে। গরীবের রাজা পইড়া থাহে। গরীবের রাজা মইরা থাহে। তহন অাতকা টের পাই, বানের লাহান ফকফকা সাদা ভাত ভাইস্যা অাসে। ভাতের বান ঠেকাইতে অামার রুহ রাজামশাইরে ডাক পাড়ে অার ডাক পাড়ে। কিন্তু রাজা পইড়া থাহে, মইরা থাহে। অার ভাতের বানের তোড়ে অামার খিদাও মইরা থাহে।
উপসংহার
নিচের অংশটুকু শুধু আমার উপলব্ধি।
চুরারানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে কৃষকেরা না খেয়ে মরে কিকরে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজি, আরো অনেক প্রশ্ন আছে, কিন্তু কেউ কি জবাব দিতে পারবেন বলে মনে হয়? নাকি দেশের আট কোটি কৃষকের আর দরকার নেই আমাদের, যেহেতু আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছি খাদ্যে, বস্ত্রে, বাসস্থানে, শিক্ষায়, দীক্ষায়, নীতিতে অথবা ধর্মে। তো সেই মাঝি আবার বলে
"মরি তো! আমি আবার মরি, বারবার মরি
কিন্তু এইবার আমার লগে আমার খোদাও মরে।
গরীবের খোদা মইরা থাহে
গরীবের খোদা মইরা থাহে
গরীবের খোদা মইরা থাহে"।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১২:২০