আদম সন্তান যখন ঘুম থেকে উঠে তখন সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও নরম প্রকৃতির একটি অঙ্গের কাছে বড়ই অনুনয় বিনয় করে আকুল আবেদন জানায়। তাদের অনুরোধ, ‘আমাদের ব্যাপারে তুমি আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর, কেননা আমরা তোমার সাথে জড়িত। তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকবো, আর তুমি বিশ্বাস ভঙ্গ করলে, বেসামাল হয়ে পড়লে আমরাও বিচ্যুত হবো।’
তিরমিযী শরীফ-এ হযরত আবু সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বরাতে একথা আমাদেরকে জানিয়েছেন।
শরহে সুন্নাহ, মালিক, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফ-এ এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘মানুষ মুখ দিয়ে মন্দ কথা বলে, কিন্তু সে জানেনা, তারা প্রতিক্রিয়া কতটুকু? আল্লাহ পাক এই কারণে উক্ত কথার (বক্তার) উপর নিজের ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করতে থাকেন সে সময় পর্যন্ত, যতক্ষণ না সে আল্লাহ পাক উনার সাথে সাক্ষাৎ করে।’
বুখারী শরীফ-এ এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, “বান্দা কোন সময় এমন কথা বলে, যাতে আল্লাহ পাক তিনি গভীর অসন্তুষ্ট হন, সে কথা তাকে জাহান্নামের দিকে নিক্ষেপ করে অথচ বান্দা সে বিষয়ে ওয়াকিফহাল থাকে না।”
মুসলমান হয়েও হালে, মুসলমানদেরকে মৌলবাদী হতে বলা অথবা মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার কথা একটি মহল থেকে যেভাবে বার বার এবং যেরূপ জোরদার রূপে উচ্চারিত হচ্ছে তাতে বর্ণিত হাদীছ শরীফ-এর সতর্কবাণীই বিশেষভাবে মূল্যায়িত হয়।
এ মহলটি প্রচার করছে, “যারা মৌলবাদী দাবি করবেনা তারা অবৈধ সন্তান, কাফির, ফাসিক ইত্যাদি।”
‘মৌলবাদ’ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিতে আলোচনার শুরুতেই বলতে হয় যে, শব্দটি যতটা ধর্মীয় তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক তথা ধর্মের নামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
যে কারণে এদেশের মুসলমানদের নতুন করে ‘মৌলবাদ’ শব্দের সাথে পরিচিত হতে হচ্ছে, এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে এবং সর্বোপরি মৌলবাদী দাবিদার তথাকথিত মৌলবাদ প্রতিষ্ঠায় শক্ত অপতৎপরতা শুরু করেছে এবং তা অস্বীকারকারীদেরকে ‘অবৈধ সন্তান্তু হবার ভয় দেখিয়ে ‘মৌলবাদ’ স্বীকার করার জন্য জঘন্য কায়দায় জুলুম-নিপীড়ন করা হচ্ছে।
কায়দাটা মূলত হুবহু ওই ভণ্ড ফকিরকে অনুসরণ করার মত।
ভণ্ড ফকির নিজের বুযূর্গী জাহির করার জন্য খুবছে ঢাক-ঢোল পিটালো যে, ‘তাকে যদি রাজি করানো যায় তাহলে সে সকলকে মোরাকাবায় বসিয়ে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখাতে সক্ষম।’
মানুষ তার কথায় চমকে গেলো। অবশেষে সকলেই তাকে হুযূর! হুযূর! বলে তা’যীম-তোয়াজ করে বহুবিধ নজরানা হাদিয়া পেশ করে অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখানোর জন্য রাজি করলো।
অবশেষে ভণ্ড ফকির সকলকে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে বিশেষ কায়দায় বসতে বললো।
দুরু দুরু বক্ষে, অজানা প্রত্যাশায়, ভীত হরিণ শাবকের ন্যায় সকলে কম্পিত হৃদয়ে মোরাকাবায় আসীন হলো।
বুভূক্ষ মন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুখচ্ছবি খোঁজার জন্য কল্পিত অন্ধকার জগতে বহু আকুলি বিকুলি, তালাশ সন্ধান করলো।
কারো মনে অনর্থক তার ফুফু, চাচি, মা, বাবা আমলের স্মৃতি, হাটবাজার ইত্যাদির চিত্রই কেবল ভাসতে লাগলো। এদিকে সময়ের পর সময় ব্যয় হচ্ছিলো। অবশেষে কিছু একটি শেষ ফায়সালার জন্য যখন প্রতীক্ষিত, ব্যাকুল মন অধীর হয়ে উঠছিলো তখন সে গুরুগম্ভীর কন্ঠে সকলকে উদ্দেশ্য করে ভণ্ড পীর হাঁকলো, ‘বাছারা! তোমরা সকলে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখতে পেয়েছ কি?’
সমস্বরে সকল অনুসন্ধানী মনের বিনীত ভাষণ উচ্চারিত হতে যাচ্ছিলো, ‘হুযূর! আমরা তো দেখছিনা, আমাদের দয়া করে দেখানোর ব্যবস্থা করুন।’ কিন্তু সেই মিনতি, আরজি কন্ঠস্বরেই রূপ লাভ করতে পারলোনা- জলদগম্ভীর কন্ঠের অপর হুঁশিয়ারিতে, ‘সাবধান! যারা এখনও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখতে পাওনি, বুঝতে হবে তারা অবৈধ সন্তান।’
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জিয়ারত লাভে উদগ্রীব আগ্রহে ব্যাকুল হৃদয়গুলো মুহূর্তের তরে হতচকিত হয়ে গেলো। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দীদারের উঁচু আশা বাদ দিয়ে এখন ত্রস্ত ব্যস্ত হয়ে নিজের ইজ্জত, বাবা-মার সম্মান বাঁচাবার পালা। দু’একজন ভীত বিহ্বলের কন্ঠে ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে, হ্যাঁ- আমরা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখেছি। আর যায় কোথায়! গোষ্ঠীর ব্যাপারটা তখন গড়িয়ে গেছে ব্যক্তি পর্যায়ে। হাজার হোক ‘অবৈধ সন্তান্তু চিহ্নিত করার বিড়ম্বনা থেকে হাজিরানে মজলিসে নিজেকে বাঁচাবার তাগিদে অবশেষে ব্যক্তি নির্বিশেষে সকলেই সমস্বরে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দীপ্তকণ্ঠে বলে উঠল হ্যাঁ, আমিও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখেছি। কারণ এই দীপ্ত উচ্চারণের সাথে সংযুক্ত যে অন্য এক কথা, “আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখেছি। সুতরাং আমি অবৈধ সন্তান নই।”
ভণ্ড পীর এভাবেই অবৈধ সন্তান হওয়ার ফাঁদে ফেলে তার কুউদ্দেশ্যে চরিতার্থ করল। মানুষের দুর্বল জায়গায় হাত দেয়ার মত, ভণ্ড পীরের ন্যায় সে মোক্ষম সুযোগটিরই ব্যবহার করতে চেয়েছিল চর্মনাইর মরহুম পীর নামধারী ফজলুল করিম। জানা নেই, অজানা নেই, ডান নেই, বাম নেই, দিক নেই, দিশা নেই মৌলবাদ স্বীকার না করলে একেবারে সরাসরি অবৈধ সন্তান। কিন্তু ফজলুল করিম তার ন্যায় ভণ্ড পীরের খপ্পরে পতিত সরলমনাদের ন্যায় আজকের প্রজন্মের সকলকে বোকা ঠাউরালেও অভিজ্ঞতা মানুষকে অনেক সচেতনা দিয়েছে।
আর সচেতনতা ছাড়াও সাধারণ বিবেকেই প্রশ্ন যে, মৌলবাদ সমর্থন করা বা না করার সাথে বৈধ বা অবৈধ সন্তানের কি সম্পর্ক? কারণ কারো মা যদি সতী সাধ্বী হয়ে থাকে তাহলে সে মহিলা যে সন্তান প্রসব করে তা সম্পুর্ণ বৈধ। যদিও খোদা না করুক সে সন্তান পরবর্তিতে কুফরী করে। অপরদিকে কারো মা যদি চরিত্রহীনা হয়ে থাকে তবু সে অবৈধ সন্তান, যদিও সে পরবর্তিতে আলিম বা ওলীআল্লাহ হোক না কেন? এজন্য ফিক্বাহর কিতাবে অবৈধ সন্তানের ক্ষেত্রে আলিম হওয়ার পক্ষেও মত প্রকাশ করা হয়েছে।
মূলত এ ধরনের কথা বলে মৌলবাদী মহল হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত উটের চেয়েও মূর্খ সে বেদুইনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছে। হযরত জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক যাযাবর বেদুইন আসল নিজের উটকে বসাল, মসজিদে বসে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পেছনে নামায পড়লো। নামাযের সালাম ফিরানোর পর সে নিজের উটের কাছে তার পা খুলল এবং উটের পিঠে সশব্দে একথা বলে চলে গেল, হে আল্লাহ পাক! তুমি আমাদের ও মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে রহমত কর। আমাদের রহমতে অন্য কারো শরীক করো না। এটা শুনে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “তোমাদের কি ধারণা? এই বেদুইন লোকটি বেশি মুর্খ? না কি তার উটটি? তোমরা কি শোননি লোকটি কি বলল?” হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বললেন: জি, হ্যাঁ শুনেছি। মূলত মূর্খতাসূচক মন্তব্যের জন্য রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এই উক্তির মাধ্যমে বেদুইন লোককে উটের চেয়েও বেশি মূর্খ বলে সাব্যস্ত করেছেন।
আর এ ধারাবাহিকতায় তার চেয়েও বেশি মূর্খ সাব্যস্ত হয় ওই মহলটি; যারা বলে, ‘যে মৌলবাদী দাবি করেনা সে অবৈধ সন্তান।’
কারণ, মৌলবাদ স্বীকার অস্বীকারই যদি বৈধ অবৈধ সম্পর্কের কথিত পীর মানদণ্ড হয় তাহলে উদাহরণ টানা যায় নব্বই বছরে বৃদ্ধের কথা। গোটা জীবন সে মৌলবাদ অস্বীকার করে আসছে। তাহলে চরমোনাইর পীরের ভাষায় সে নব্বই বছর ধরে অবৈধ সন্তান। কিন্তু এরপরে বৃদ্ধ বয়সে মতিভ্রম হলে অথবা জাহিল পীরের খপ্পরে পড়ে যে মৌলবাদ স্বীকার করল, তাহলে এই দীর্ঘ নব্বই বছর অবৈধ সন্তান থাকার পর, চরমোনাইর পীরের ফতওয়া অনুযায়ী সে বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হবে। তার এর পরের মূহূর্তে যদি সে মৌলবাদ অস্বীকার করে তবে আবার অবৈধ সন্তান হবে।
আবার একইরূপে নব্বই বছর মৌলবাদ স্বীকার করার পর যদি যে ছহীহ বুঝ বুঝে মৌলবাদ অস্বীকার করে তাহলে নব্বই বছর বৈধ সন্তান থাকার পর সে অতঃপর চরমোনাইর পীরের কথানুযায়ী অবৈধ সন্তান বলে গণ্য হবে। নাঊযুবিল্লাহি মিন যালিক!
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, নব্বই বছর জীবন অতিবাহিত করার পর যা ফতওয়া স্বীকার/অস্বীকারের মাধ্যমে মুহূর্তের তরে যেখানে বৈধ বা অবৈধ সন্তান হতে হয় সেখানে এ ফতওয়াদাতা, পীর নামধারী হলেও সে যে হাদীছে বর্ণিত উটের চেয়েও জাহিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মূলত এই জিহালতই মৌলবাদীদের তাদের শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতার প্রতিও গালি দেয়ার স্পর্ধাজনিত কাজটিতে প্ররোচিত করেছে। হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “নিজের পিতা-মাতাকে গালি দেয়া সবচেয়ে জঘন্য কাজ। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনারা বলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কেউ কি নিজের পিতা-মাতাকে গালি দিতে পারে? হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, যে ব্যক্তি অপরের পিতা-মাতাকে গালি দেয় সে মূলত তার নিজের পিতা-মাতাকে গালি দেয়।” এখন হাদীছ শরীফ মোতাবেক মৌলবাদীদের দুটি পথ খোলা আছে। হয় এই হাদীছ শরীফ অস্বীকার করে দুনিয়াতেই নিজের স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করা নতুবা নিজের মাকে চরিত্রহীনা বলে অভিযুক্ত করার দায়ভার গ্রহণ করা। তার পাশাপাশি ফজলুল করীমকে আরো অনেক গুরুতর অপরাধ স্বীয় কাঁধে বহণ করতে হবে। কারণ হযরত সুফিয়ান ইবনে আসিদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, “সবচেয়ে বড় খেয়ানত এই যে, তুমি তোমার কোন মুসলমান ভাইকে কোন কথা বললে, আর সে তা সত্য বলে জানল, অথচ প্রকৃতপক্ষে তার সাথে মিথ্যা বলেছো।” (আবূ দাউদ)
সুতরাং যেখানে মৌলবাদ ইসলামের স্বীকৃত নয় সেখানে তাতেই বিশ্বাসী হবার কথা বলার প্রেক্ষিতে যত লোক মৌলবাদীতে বিশ্বাসী হবে এবং মৌলবাদকে সত্য বলে জানবে তাদের সকলের প্রতি ওই মহলটি বড় খেয়ানতকারী বলে সাব্যস্ত হবে।
পাশাপাশি যারা মৌলবাদে বিশ্বাসী নয়, যারা ছহীহ ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী তাদেরকে গালি-গালাজ করার অপরাধেও ওই মহলটি চরম ফাসিক বলে গণ্য হবে। যেহেতু হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “মুসলমানকে গালি-গালাজ করা ফাসিকী।” (বুখারী, মুসলিম)
অন্য হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, “এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে পাপী বলে অপবাদ দিবে না। যদি সেই ব্যক্তি এরূপ না হয় তবে তার কথা (অপবাদ) তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে।” (বুখারী)
কাজেই এই হাদীছ শরীফ-এর মূল্যায়ন মূলত আমাদেরকে ফজলুল করীমের জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে ভাবিয়ে তোলে। তদপুরি তার পরিণতি সম্পর্কেও আমরা কম শঙ্কিত নই। কারণ যদি কারো মধ্যে দোষত্রুটি থাকে তবে তা বর্ণনা করাই গীবত। আর যদি না থাকে তবে তা অপবাদ।