[ফেসবুকে Mohib Nirob এর স্ট্যাটাস থেকে সংগৃহীত, সংক্ষেপিত ও ঈষৎ পরিবর্তিত...]
অনেক দীর্ঘ লেখা, তাই যাদের ডাক্তারদের ব্যাপারে এলার্জি আছে এড়িয়ে যেতে পারেন অথবা সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করতে পারেন।
গতরাতে নিউরো সার্জারী ওয়ার্ডে ডিউটি করছিলাম। হঠাৎ একজন মাথায় আঘাত পাওয়া রোগীকে নিয়ে আসা হল। ট্রাক চাপায় তাঁর মগজের কিছু অংশ খুলির বাইরে চলে এসেছে। এখনি কোন ব্যবস্থা না নিলে রোগী রক্তক্ষরণেই মারা যাবেন। সিনিয়র কাউকে ডাকার সময়-সুযোগ ছিল না তাই আমি ওটির দাদু (ওয়ার্ডবয়), ব্রাদার (নার্সের সমান পদ) মিলে রোগীটাকে ম্যানেজ করি। মাত্র সাতদিনের জন্যে এই ওয়ার্ডে আমার প্লেসমেন্ট, একদমই প্রাথমিক কিছু ধারণার উপরে কাজ করতে হয় এবং এই সব দাদু-ওয়ার্ডবয় আমাদের সহযোগিতা করেন তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে। হ্যাঁ, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় এবং দাদুরা যেমন দেখেছেন তার রেফারেন্সে আমি সেদিন কসাইয়ের মত ছুরি চালাই। বের হয়ে আসা মগজের অংশবিশেষ কেটে ফেলে দিয়ে দ্রুততার সাথে সেলাই শেষ করি। পরের দিন রাউন্ডে প্রফেসর স্যার রোগীর সিটি স্ক্যান (যেটা আমরা বিনামুল্যে করার ব্যবস্থা করে দিয়েছি) দেখে বলেন এই রোগীর এতক্ষণ বেঁচে থাকার কথা নয়। আমি তখন মগজের কিছু অংশ কেটে ফেলার কথা স্বীকার করি। স্যার রাউন্ডে থাকা সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন এটা ঠিক হয়েছে কিনা? আমার সকল কলিগ বলল, ভুল হয়েছে। স্যার হেসে বললেন, না, ঠিক হয়েছে। ছিঁড়ে যাওয়া মগজ ফেলে না দিলে রোগীটা বাচঁত না (খুলির ভেতরে চাপ বেড়ে মারা যেত)। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলাদেশে প্রথম শ্রেনীর সরকারী চাকুরেদের মাঝে একমাত্র ডাক্তাররাই ইউনিয়ন পরিষদ স্তরে চাকুরী করেন (অন্য সব ক্যাডার করেন উপজেলায়)। দেশের সেবায় তাতেও আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমি কখনোই গ্রামে সেবা দেয়ার বিরোধী নই কিন্তু সেবার নামে সরকারী ডাক্তারদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দানে বঞ্চিত করার বিরোধী। সম পদমর্যাদার যে কোন প্রশাসনিক বা অন্যান বিসিএস ক্যাডারের সাথে একজন ডাক্তারের পদোন্নতি তুলনা করে দেখেন! একজন ডাক্তার বছরের পর বছর মেডিকেল অফিসার পদে পড়ে থাকেন (কোন লবিং বা উচ্চ ডিগ্রী না থাকলে)। একজন ইউএনও যেখানে পাজেরো চড়েন গত এক বছরে শুধুমাত্র আমাদের ক্যাম্পাসের দুই জন ডাক্তার সেখানে কর্মস্থলে যাবার পথে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছেন (মিডিয়া কিন্তু এসব জানবেও না)। যাদের লবিং নাই তাদের উচ্চ শিক্ষাই একমাত্র অবলম্বন যেটার পথও এখন বন্ধ হবার পথে। অথচ বাইরের দেশে যে ডাক্তার পেরিফেরিতে (মানে শহর থেকে দূরে) থাকবে তার বেতনভাতা, সুযোগ-সুবিধা বেশী প্রদান করা হয়। আর আমাদের দেশে পেরিফেরিতে সরকারী ডাক্তার কিভাবে দিন কাটায় তা সাধারণ মানুষের চিন্তারও বাইরে (আমার এক সিনিয়র এক রোগীর কাটা হাত সেলাই দিচ্ছিলেন উপজেলা হাসপাতালে, রোগীটাকে যারা মেরেছিল তারা এসে সেই ডাক্তার ভাইয়ের সহকারীর হাত কেটে দিয়ে গিয়েছিল, অপরাধ- কেন তার প্রতিদন্দ্বীর চিকিৎসা দেওয়া হল)। আপনারাই চিন্তা করে দেখেন একই পদমর্যাদার ইউএনও’র ক্ষমতা কত বেশি?
এখন বলবেন সরকারী চাকরির কী দরকার? আমাদের যাদের বাবার সম্পদের তিন-চতুর্থাংশ মেডিকেল পাশ করাতে খরচ হয়েছে তাদের আর শারীরিক বা মানসিক সামর্থ্য নেই আমাদের আরো দশ বছর ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে চলার। কারণ খেয়ে না খেয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করতে অন্তত ১০ বছর লাগবে। ইন্টার্নী শেষ করে ৬ মাস পরে উচ্চ শিক্ষার জন্যে আবেদন করা যাবে, এক চান্সে এফসিপিএস ফার্স্ট পার্ট হয় এরকম ডাক্তার হাতে গোনা। হয়ে গেলে ট্রেনিং ৩+১=৪ বছর। চার বছর শেষে সেকেণ্ড পার্ট পরীক্ষা। সেটা আরেক পুলসিরাত। আমাদের মেডিসিনের প্রফেসরের স্যারের লেগেছে ৭ বার, মানে আরো সাড়ে তিন বছর (প্রতিবার ৬মাস পর পর পরীক্ষা হয়)। সেখানে কিনা শিক্ষাছুটির নীতিমালায় বলা হয়েছে একবারের বেশি ছুটি পাওয়া যাবে না।
শুধুমাত্র এমবিবিএস ডাক্তারকে কেউ পাত্তা দেয় না। রাস্তায় যে প্রেশার মাপে ব্লাড সুগার মেশিন নিয়ে বসে থাকে তাকে লোকে ২০+৩০=৫০ টাকা দেয়। ভাবছি ইন্টার্নশিপ শেষ করে বাড়ি গিয়ে একটা ব্লাড স্যুগার মেশিন কিনে ডিগ্রী লুকিয়ে রাস্তায় বসবো...
শিক্ষাছুটি নিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিষিদ্ধ- খুব ভালো প্রস্তাব। প্রথমত প্রশাসন অবশ্যই আমার চাইতে ভালো জানেন তবুও বলি যারা সত্যিকার অর্থেই পরীক্ষায় বসার জন্যে ছুটি নেন তাদের প্র্যাকটিসের নুন্যতম মানসিকতা বা সুযোগ থাকেনা । দ্বিতীয়ত, তারা যদি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেনই তাতে কারা উপকৃত হচ্ছে? মানুষই তো নাকি? খুব কম ডাক্তারই রোগীকে নিজের প্রয়োজনে ডেকে আনেন। নিয়মিতভাবে সব প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাশ করে এসে আমি ইন্টার্নশিপের বেতন পাবো এক বছর মাসিক ১০,০০০ টাকা। স্কুল ছেড়েছি ৯ বছর হল। আমার ক্লাসের ৩৮০+ ছেলের মধ্যে যে একদম শেষের দিকে যে ছিল টাকার জোরে প্রাইভেট ভার্সিটিতে বিবিএ, এমবিএ করেছে সেও এখন গেট টুগেদারে আসে অফিসের এসি গাড়ি নিয়ে, আমি ফ্যাঁকাসে হাসি দিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখি একদিন আমিও...। কিন্তু কিভাবে কেউ কী জানেন? যে মেডিকেল থেকে পাশ করেছি ১১৫ জন এক সাথে তাদের মাঝে সর্বোচ্চ ১৫ জন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে? বাকীরা বেঁচেবর্তে মুখ লুকিয়ে থাকবে। সেই ১৫ জনের একজন হতে হলেও দরকার উচ্চ শিক্ষা- যার পথ প্রশাসন বন্ধ করতে চাচ্ছে।
শিক্ষাছুটি নিয়ে লিখতে গিয়ে কয়েকশ' শব্দের রচনা লিখে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যে ডাক্তারদের প্রতি সরকারের মনোভাব কী-
এতিম শিশুদের মাথাপিছু মাসিক খোরাকি ২০০০ টাকা করে এবারের বাজেটে বরাদ্দ ৯৪ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা...
ঢাকা মহানগরীর ২ হাজার ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ ১০ কোটি টাকা, সর্বমোট ১০ হাজার ভিক্ষুক পুনর্বাসন করা হবে , সারা বাংলাদেশে কী ট্রেইনিদের সংখ্যা ১০ হাজারের ও বেশী?
সমাজর সবেচেয় অনগ্রসর দলিত, হরিজন, বেদে, হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে ১৪ কোটি ৬১লক্ষ টাকা বরাদ্দ...
দেখা যাচ্ছে, ডাক্তারদের প্রতি প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকদের মত বা তার চেয়েও নিম্নমানের ...
প্রস্তাবিত শিক্ষাছুটি নীতিমালা যদি বাস্তবায়িত হয় তবে আমার একটা প্রস্তাব হলো -দেশের সকল মেডিকেল কলেজ(২০/২৩টি সরকারী ৩৯/৪৩টি বেসরকারী) বন্ধ করে দিয়ে MATS এ convert করা হোক,দেশে MATS আছে সরকারী ৮টি বেসরকারী ৪৪টি যার প্রায় সবগুলোই গত ৩/৪ বছরে স্থাপিত। কারণ- আমরা "চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর অনুপাত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ১:৩:৫ করতে আমরা নার্স ও প্যারামেডিক্সের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছি"- ( অর্থমন্ত্রির বাজেট বক্তৃতা ২০১২-১৩)। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১'তে বিদ্যমান ডাক্তার:নার্সের অনুপাত= ১ : ০.৪৮, মেডিকেল এসিস্টেন্টের অনুপাত শুন্য বা দশমিকের কত ঘর ডানে সেটার হিসেবও কোথাও নেই। ১৯৮৩ সালে দেশে সরকারী মেডিকেল ছিল ৯টি এবং MATS ১৮টি, তার মানে দাঁড়ালো প্রশাসনের ভুলে MATS'র সংখ্যা কেবল কমেছেই ...
এবার শুরুর কথায় ফিরে যাই, আমরা ডাক্তাররা যদি শিক্ষাছুটি না পাই, আমার মতো হয়তো না জেনে রোগীর ব্রেইন কেটে ফেলার (হয়ত ভাগ্যক্রমে আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল) মত কসাইয়ের কাজ ডাক্তার’রা করতে থাকবে। ডাক্তাররা যথাযথ ট্রেনিং না পেলে কসাইয়ের চাইতেও ভয়ংকর সম্প্রদায়ে পরিণত হবে। আর কসাইয়ের কথায় বলি, এক কেজি বীফ বা মাটনের দাম কত? আর আপনার বৃদ্ধ পিতার মাংস ক্ষয়ে যাওয়া ক্ষত যে নির্দ্বিধায় ড্রেসিং করছি প্রতিদিন তার দাম কি আপনার কাছে? তার বিনিময়ে কি একটু শুকনো ধন্যবাদও পেতে পারি না?...
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মূল লেখা এখানে ...