মায়ানমার রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর যে পরিমান অত্যাচার নির্যাতন করা হচ্ছে, তার বিভীষিকা বা নির্মমতা আজকের এই আধুনিক সভ্যতায় দেখতে পাওয়া তো দূরের কথা, চিন্তাই করা যায়না। ব্যক্তিগতভাবে মনের জোর খুব বেশী না বলে বার্মার সামরিক বাহিনীর এই নৃশংসতার ছবি, ভিডিও, শিশু-মহিলা-বৃদ্ধদের কান্না, চিৎকার, আহাজারি প্রভৃতি চেষ্টা করেছি সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতে বা দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেলতে। কারন নিরুপায় বা অসহায় মানুষগুলোর চোখের চাহনির যে আকুলতা বা ব্যাকুলতা, তা আমার মত মানুষের পক্ষে চোখে চোখ রাখার মত সাধ্য নাই। তথাপি এই সামাজিক যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যানে বা বিশ্বায়নের এই যুগে কিছু ছবি বা ঘটনা নিজের অজান্তে চোখে ধরা দেয়, যা এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠেনা।
যেসব বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী বা জ্ঞান-পাপী অমানুষেরা অসভ্য দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্মম, নিষ্ঠুর, নৃশংস, বর্বর, অমানবিক নির্যাতনকে দেখে বা শুনেও না শুনার ভান ধরে ইনিয়ে বিনিয়ে নির্লজ্জের ন্যায় কুযুক্তি দেয় তাদের জন্য আমার কিছু কথাঃ
১। কেহ কেহ বলেন, নিজের দেশের হিন্দু, সাওতাল, বৌদ্ধ বা বিহারীদের উপর নির্যাতনের সময় নিরব কিন্তু রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে এত সরব কেন?
- একজন মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে যে কোন নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কথা বলা উচিত। নিজের দেশের সংখ্যালঘু যখন নির্যাতিত হয় তখন যেমন সরব থাকা উচিত, ঠিক তেমনি অন্য দেশের কোন নির্যাতিত জনগোষ্ঠির ব্যাপারেও সরব থাকা উচিত। যদিও দু'টা দেশের নির্যাতনের মাত্রা দু'রকম তথাপি একজন মানবিক মানুষ হিসেবে সবক্ষেত্রেই প্রতিবাদ করা উচিত বা নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। আবার একটা ঘটনার সময় সরব না হলে অন্য সময় সরব হওয়া যাবেনা, এমনও তো কোন কথা নাই।
২। অনেকে বলেন - বিষয়টা মুসলিম বা বৌদ্ধের না, বিষয়টা সম্প্রদায়ের বা রাজ্যের।
- রাজ্য বা সম্প্রদায়ের হলে তো বার্মার সেনাবাহিনী বা বৌদ্ধরা রাখাইন রাজ্যের সব জনগোষ্ঠীর উপরই আক্রমন করতো। রাখাইন রাজ্যের শুধু শুধু মুসলমান জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ করছে কেন? বা রাখাইন রাজ্যে তো আরও অন্য জনগোষ্ঠী আছে, তাদের উপর আক্রমন করছেনা কেন? কিংবা তারা যদি বৌদ্ধ হতো, তাহলে কি আক্রমন করতো?
৩। অনেকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের যেসব ছবি দেখানো হচ্ছে সেগুলো সত্য নয় কিংবা আসলে এই রকম কিচ্ছু ঘটছেনা বা আসল সত্য জানুন।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব ছবি বা ভিডিও প্রকাশিত হচ্ছে তার শতভাগ সত্যতা যাচাই করা হয়ত সম্ভব নয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন যারা এইসব প্রশ্ন করছে তাদের সততা নিয়ে বা হীন উদ্দ্যেশ নিয়ে। তিনি কি খবরের সঠিকতা যাচাই করতে চাচ্ছেন, নাকি নৃশংসতাকে আড়াল করতে চাচ্ছেন? কারন যেসব লোক এই ধরনের নিউজ শেয়ার করছে, দেখবেন তাদের প্রোফাইলে নির্যাতিতদের পক্ষাবলম্ভন করে কোন নিউজ নাই। তাদের জন্য করুনা হয়। করুনা হয় তাদের লব্ধ জ্ঞানের জন্য। শন্কিত হই এই ভেবে যে, তারা তাদের অর্জিত জ্ঞান ভবিষ্যতে কি নিষ্ঠুরভাবে মানবতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। তাদের জ্ঞাতার্থে কিছু তথ্য উপস্থাপন করছিঃ-
* জাতিসংঘের মতে বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত জনগোষ্ঠী হলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
* রাষ্ট্র তাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। যেমন -তাদের বিয়ে করার অধিকার নেই,সন্তান হলে নিবন্ধন নেই, ধর্মকর্ম করার অধিকার নেই, নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়, শিক্ষার অধিকার নেই, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়, বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই, জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না।
* আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত স্যাটেলাইটে ধারণ করা ছবিতে দেখা গেছে, ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামের কমপক্ষে ৮৩০টি বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
* মিয়ানমারের সরকার সম্প্রতি ঘোষণা করেছিল যে তারা রাখাইন রাজ্যের সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ২৫ হাজার বাড়ি, ৬০০ দোকান, ১২টি মসজিদ এবং ৩০টিরও বেশি স্কুল।
* ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়েও পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।
এছাড়া ২০১২ সালে ট্রেনে রোহিঙ্গা মুসলমান কর্তৃক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুক ধর্ষনের জের ধরে সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের দ্বারা পরিচালিত বর্বরতায় প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম দেশত্যাগ করে। বর্তমানে প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করে। মিয়ানমার ছাড়াও মালেশিয়ায় প্রায় ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৪-৫ লক্ষ এবং প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা সৌদিআরবে বাস করে বলে ধারনা করা হয়, যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে যে সামরিক অভিযান চলছে তার মোটো হলো- "আগে গুলি, পরে জিজ্ঞাসা"। চিন্তা করুন, কি ভয়ংকর কথা। সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ১৩০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করার কথা স্বীকার করা হলেও বেঁচে আসা মানুষদের মতে- হত্যার সংখ্যাটা কয়েকগুন হতে পারে। যে ভয়াবহ নৃশংসতার কথা বিশ্ববাসী জানতে পারছে তাও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষন বা মায়ানমার সামরিক বাহিনী থেকে প্রচারিত সংবাদ থেকে কারন রাখাইন রাজ্যে কোন ধরনের ব্যক্তি বা সংবাদ সংস্থার প্রবেশ নিষেধ। গতকাল জাতিসংঘ এই নৃশংসতাকে অভিহিত করেছেন এই বলে যে, "এটা প্রকারান্তরে মুসলমান রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা"।
৪। অনেকে বলেন রোহিঙ্গাদের মধ্যেও অনেক জঙ্গী আছে বা অস্র সশ্রসহ অনেকের ছবি দেখা যায়।
- হ্যা, এই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু এটার পরিমান কত? একটা ক্ষুদ্র অংশের কারনে আপনি কি পুরো জনগোষ্ঠীকে জঙ্গী বলবেন? এছাড়া কোন জনগোষ্ঠী যদি অন্যায়ভাবে নির্যাতিত হয়, মা-বোনেরা ধর্ষনের শিকার হয়, সেখানে প্রতিবাদী বা বিপ্লবী বা বিদ্রোহী কোন না কোন গোষ্ঠীর উদ্ভব হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যদিও বার্মার কাছ থেকে এইরকম কোন জোরালো অভিযোগ আসেনি যে, কোন দেশ বিদ্রোহীদের লালন করছে বা সাহায্য- সহযোগিতা করছে।
৫। কেহ কেহ বলেন - আমরা গরীব দেশ, আমরা কেন তাদের পালবো? কিংবা সমস্যাটা মিয়ানমারের সুতারাং সমাধানও তাদেরকে করতে হবে।
- কেহ কি তাদেরকে পালার কথা বলেছে? বিষয়টা হলো মানবিকতার। আপনি অসহায় মানুষগুলোকে কি আগুনের মাঝে ছেড়ে দিবেন, নাকি তাদেরকে আশ্রয় ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থা দিবেন। পরবর্তীতে বিষয়গুলো নিয়ে জাতিসংঘ বা বিশ্বের কাছে দাবী পেশ করা যায় জোরালোভাবে। এছাড়া তাদের খাবারের ব্যবস্থা তো জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক এনজিওরা করে থাকে। প্রয়োজনে এইসব বিষয়ে জাতিসংঘের কাছ থেকে লিখিত নিশ্চয়তা নিয়ে তারপর আশ্রয় দেন।
মিয়ানমার সামরিক বাহিনী বা সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর নৃশংসতা, নির্যাতন, ঘর-বাড়ী পুড়ে দেওয়া, মানুষকে জীবন্ত পুড়ে ফেলা, নারীদের উপর পৈশাসিক নির্যাতন, রাতের অন্ধকারে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় খোঁজা, কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা এবং বিজিবির এই অসহায় মানুষগুলোকে ফেরত পাঠানো। সবগুলোকে আমি দেখি নৃশংসতার বিপরীতে মানবিকতার স্বরুপ হিসেবে। সুতারাং আশা করব আমরা সবাই মানবিকতা কিংবা উদারতার দৃষ্টিতে সমস্যাকে অনুধাবন করবো।
এর মাঝেও কিছু কথা বা ঘটনা স্বপ্ন দেখায় মানুষে মানুষে, সমাজে সমাজে, সভ্যতায় সভ্যতায়, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে। গতপরশু মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা গতকাল মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বলেছেন - "যেসব শিশু বা মহিলা আমাদের সীমান্তে প্রবেশ করেছে, মানবিক কারনে আমরা এই মূহুর্তে তাদেরকে ফেরত দিবোনা" বা "সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের সাথে মানবিক আচরন করবে বাংলাদেশ, কারন তারাও তো মানুষ"। সাল্যুট মাননীয় মন্ত্রীদ্বয়। সম্মান জানাই আপনাদেরকে। দেশ হিসেবে আমরা গরীব হতে পারি কিন্তু মানুষ হিসেবে মনের দিক দিয়ে আমরা অনেক মানবিক - আপনারা সেটাই প্রমান করলেন। আসুন নিরীহ, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষগুলোর প্রতি আমরাও হই মানবিক। সাথে সাথে বিশ্বকে জানিয়ে দিই - অসভ্য, বর্বর রাষ্ট্র (মায়ানমার) তার জনগনের প্রতি যে অমানবিক আচরন করছে, প্রতিবেশী হিসেবে বা মানুষ হিসেবে আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ করছি। আর বিশ্ব দেখুক, হাজার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও আমরা এবং আমাদের রাষ্ট্র যে মানবিক আচরন করছে এই নিরীহ মানুষগুলোর প্রতি, তা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে শুধু সমৃদ্ধই করবেনা, গৌরবান্বিতও করবে। সবাইকে ধন্যবাদ। জয় হোক মানবতার।
মোঃ শওকত হোসেন বিপু
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:১৭