ওয়াশিংটন থেকে প্রেসিডেন্ট সাহেব জানিয়েছেন যে তিনি আমাদের জমি-জিরাত কিনতে চান। কিন্তু আকাশ কি কেনা-বেচা করা যায়? যায় জমি কেনাবেচা করা? আমাদের কাছে এই ধারনা খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে। বাতাসের সজীবতা, জলের স্বচ্ছতা তো আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। তাহলে? কি করে কিনবেন তাদের?
এই ধরিত্রীর প্রতিটি ধূলিকণা আমার লোকদের কাছে পবিত্র; প্রতিটা পাইন পাতার কাটা, প্রতিটি বালুবেলা, ঘনান্ধকার অরণ্যের প্রতিটি শিশিরকণা, প্রতিটি মাঠ, প্রতিটি গূন্জরিত পতঙ্গ। আমার লোকদের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় এরা সবাই পবিত্র।
গাছ রস টেনে নেয় গোপন পথে- আমারা তা জানি, যেমন জানি রক্ত আমাদের ধমনি বেয়ে চলে। আমরা এই পৃথিবীর অংশ, যেমন এই পৃথিবী আমাদের অংশ। সুরভিত ফুলেরা আমাদের বোন। ভালুক,হরিন,ঈগল -এরা সবাই আমাদের সহোদর ভাই। পাহাড়ের চূড়া, সবুজ প্রান্তরের রস, ঘোড়ার শরীরের ওম, আর মানুষ সবাই আমরা একই পরিবারের সদস্য।
ঝরনায়, নদীতে স্ফটিক-স্বচ্ছ যে জল গড়িয়ে যায় সে তো নেহায়ত জল নয়, আমাদের প্রপিতাদের শরীরের স্বেদ, রক্ত। আমরা যদি আপনাকে জমি বিক্রি করি তো অবশ্যই স্মরণ রাখবেন যে জমিটা পবিত্র। ঝিলের স্বচ্ছ জলে অলৌকিক ছায়া পড়ে। তার প্রতিটিতে আমার লোকদের জীবনের স্মৃতি আর ঘটনা প্রতিফলিত হয়। বনের মর্মরধ্বনিতে আমি আমার পিতামহের ডাক শুনতে পাই।
নদীরা আমাদের ভাই। তাদের জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটে। ওরা আমাদের নৌকা বয়ে নেয়, আমাদের সন্তানদের মুখের গ্রাস জোগায়। অতএব আপনি অবশ্যই নদীকে সেই রকম দ্য়া করবেন যেমনটা করবেন আপনার ভাইকে।
আমরা যদি জমি বিক্রি করি তো মনে রাখবেন যে সেই জমির ওপর প্রবাহিত বাতাস আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। হাওয়া তার উদ্যমের অংশ দান করে তার সমস্ত পোষ্যকে। হাওয়া যেমন প্রথম ফুৎকারে আমাদের প্রপিতামহকে দিয়েছে ফুসফুসে দম, তেমনি গ্রহণ করেছে তার অন্তিম শ্বাসবায়ুও। আমাদের শিশুদেরও বাতাস দেয় জীবনের উদ্যম। অতএব আপনাকে জমি বিক্রি করলে আপনি অবশ্যই সেই জমি বিশেষ যত্ন করে রাখবেন যেন সেখানে লোকে মাঠের ফুলের মিষ্টি ঘ্রান পাওয়ার লোভে সমবেত হয়।
আমাদের সন্তানদের যা শিখিয়েছি, আপনারাও কি আমাদের সন্তানদের তা-ই শিখাবেন? আমরা শিখিয়েছি যে ধরণী আমাদের মা। এই ধরণীর কিছু হলে এর সন্তানদের সবারই তা হবে।
আমরা এটুকু জানি: মাটি মানুষের নয়, বরং মানুষই মাটির। রক্ত যেমন আমাদের একত্রে বেধেছে, তেমনি সমস্ত জিনিসও পরস্পরে বাধা। জীবনের জাল মানুষ বয়ান করেনি। সে তো এই জালে কেবল বাধা। এই জালের ক্ষতি করা মানে নিজেরই ক্ষতি করা।
আপনাদের ভবিষ্যৎ আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়। গরু-মহিষ সব জবাই করলে কি হবে অবস্থাটা? বুনো ঘোড়া পোষ মানিয়ে চালাবেন? অরণ্যের গোপন অঞ্চলগুলো যখন মানুষের ঘামের গন্ধে উঠবে ভরে, এবং উচু পাহাড়ের চূড়া আলাপি তারের আড়ালে পরবে ঢাকা, তখন কি হবে? ঝোপঝাড়, বনবাদাড় যাবে কোথায়? সব উধাও? ঈগল পাখি যাবে কোথায়? উধাও,উধাও। আর ক্ষিপ্রগতি ঘোড়া আর শিকারকে অকালে বিদায় জানাতে হলে কেমন হবে ব্যাপারটা? তখন ফুটে উঠবে জীবনের অন্তিম দশা এবং শুরু হবে ধুকে ধুকে জীবনের পথ চলা।
যখন একেবারে শেষ লাল মানুষটিও তার নিধুয়া দিগন্ত পাড়ে হাওয়া হয়ে গেছে, এবং তার স্মৃতি কেবল ভাসমান মেঘের মত প্রেইরির পাথরে থেকে থেকে ছায়াসম্পাত করে বেড়াচ্ছে, তখনো কি এই সমুদ্রতট, এই অরণ্যরাজি থাকবে যেমন আজো আছে? তখনো কি আমাদের আত্না মিশে থাকবে এদের আনাচে কানাচে?
নবজাতক যখন মায়ের হৃদস্পন্দন ভালোবাসে, তেমনি আমরা ভালোবাসি এই পৃথিবীকে । অতএব আমরা জমি বিক্রি করলে আপনিও একে আমাদের মতই ভালোবাসবেন। আমরা এর যেমন যত্ন নিয়েছি, আপনাকেও সেরকম যত্ন নিতে বলি। জমি সম্প্রদানের অবিকল স্মৃতি মনে ধরে রাখুন। সমস্ত সন্তানদের জন্য জমি রক্ষা করুন, জমিকে ভালোবাসুন যেমন ঈশ্বর আমাদের ভালোবাসেন।
আমরা যেহেতু সবাই ভূমির অংশ, সে জন্য আপনিও এর অংশ। জমি আমাদের কাছে মুল্যবান, তেমনি আপনার কাছেও । একটা বিষয়ে আমরা নিশ্চিত : ঈশ্বর এক। মানুষ সে লালই হোক আর সাদাই হোক, কখনো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে নাহ; হাজার হলেও আমরা তো পরস্পরের ভাই।
মুল চিঠির লিংক Chief Seattle's LETTER TO ALL
অনুবাদটা 'নৃ' নামের একটা বই থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১০ রাত ১১:৩৪