somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের ১১৫ তম জন্মবার্ষিকী

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এই বাংলাদেশের এমন একজন দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর, যিনি সকল ধরনের কুসংস্কার, যুক্তিহীনতা আর অন্ধত্বের বিপক্ষে নিয়ত সংগ্রাম করে গেছেন। পেশায় কৃষক এই মানুষটির ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ডিগ্রী। দু’চোখে জ্ঞানের প্রতি অসীম আগ্রহ, ভালোবাসা আর বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের এক দুর্নিবার ইচ্ছা নিয়ে নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন কয়েক হাজার বইয়ের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরজ মঞ্জিল পাঠাগারটি আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই অতীত ইতিহাসকে, যেখানে বরিশালের প্রত্যন্ত গ্রামের মেঠোপথ ধরে একাকী পথচলা নিঃসঙ্গ এক দার্শনিকের কথা রয়েছে।

বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে চড়বাড়িয়া ইউনিয়নের লামচড়ি গ্রাম। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর ধর্মান্ধতার বেড়াজাল এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই প্রাচীণ জনপদ। এখানেই ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৩ পৌষ (ইংরেজি ১৭ ডিসেম্বর, ১৯০০) এক কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। শৈশব থেকেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা আরজ আলীর মনে বাসা বেঁধেছিল জগত, জীবন সম্পর্কিত নানা জিজ্ঞাসা। যার যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও উত্থাপিত প্রশ্নের সমৃদ্ধতা তাকে উপস্থাপন করেছে একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি হিসেবে। তাঁর দর্শন বিদগ্ধজনকে বিস্মিত করে, তার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর হচ্ছে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে তাঁর বিস্ময়কর অর্জন। গ্রামের মক্তবে ‘বাল্যশিক্ষা’ বই পড়ে তার বাল্যশিক্ষার সমাপ্তি ঘটলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গড়ে ওঠা একজন সাধারণ মানুষের এই স্বনির্মাণ প্রতিষ্ঠা লাভ বাঙালি মননে আজও বিস্ময় হয়ে রয়েছে।

অন্য পাঁচ-দশটা গ্রাম্য শিশুর মতই জন্মের আড়ম্বরতাহীন পরিবেশে এক অতি সাধারণ দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মানোতে সামান্য ভিটেবাড়ি ছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে তেমন কোন বিষয় সম্পত্তিই পাননি তিনি। বাবাকে হারান শৈশবেই। নিজ গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বেরিয়ে পড়তে হয় কাজের সন্ধানে। বাবাকে হারিয়ে কৃষিকাজে লেগে যান কৃষক বালক আরজ আলী। কৃষিকাজের ফাঁকে শিখে নেন জমি মাপজোখের আমিনের কাজ। লাঙ্গল ছেড়ে এবার আমিনের পেছনে শেকলবাহী আরজ আলী। আস্তে আস্তে পাকা আমিন হয়ে ওঠেন তিনি। দূর দূরান্ত থেকেও আসতে থাকে জমি মাপার বায়না। নিখুঁত, নিরপেক্ষ, চুলচেরা সূক্ষ্ম মাপজোখ এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকাতেই আরজ আলী মাতুব্বরের চাহিদা বেড়ে যায় এলাকার শহরেও। পিতৃহীন আরজ আলী মায়ের স্নেহেই বড় হচ্ছিলেন। বাংলা ১৩৩৯ সনে সেই মাকে হারিয়ে প্রচন্ড আঘাত পান তিনি। তখন আরজ আলী যৌবন পেরিয়ে। তার ইচ্ছা হলো মৃত মায়ের একটি ছবি তুলে রাখবেন। নিজেই ছুটে যান বরিশাল শহরে। এই দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে শহর থেকে ক্যামেরাম্যান এনে মায়ের ছবি তোলালেন। মৃত মায়ের ছবি তুলেছিলেন বলে আরজ আলী’র মায়ের জানাজা হলো না। আরজ আলীর’র অন্তরাত্মা থেকে উঠে আসতে লাগল হাজারো প্রশ্ন, জগত ও জীবন নিয়ে নানা জিজ্ঞাসা। প্রশ্ন করে করে নাড়িয়ে দিতে লাগলেন কুসংস্কারের ভিত। উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের ওপরে পড়াশুনা শুরু করেন । এই ব্যাপক পড়াশুনা তার মনে জাগিয়ে তোলে আরও প্রশ্ন। আলোড়িত হন প্রশ্নবানে। কাগজে লিখে রাখেন তার প্রশ্নগুলো, এবার উত্তর খোঁজার পালা। কারও কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে নিজেই আপন মনে করে চলেন সত্যের সন্ধান, আর এভাবেই লিখে ফেলেন তার প্রথম বই ‘সত্যের সন্ধান’। এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ এ। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। একে একে লিখে ফেলেন ‘সৃষ্টির রহস্য’, প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ এ; ‘স্মরণিকা’, প্রকাশিত হয় ১৯৮২ এ। সবশেষে লেখেন ‘ভিখারির আত্মকথা’।

আরজ আলী ছিলেন বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। আরজ আলী’র পরিচয় তার লেখার মধ্যেই। তাঁর প্রতিটি রচনাতেই মুক্তচিন্তা ও যুক্তির বিকাশের প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে। বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব সবক্ষেত্রেই ছিল তাঁর যৌক্তিক পদচারণা। বরিশাল গণগ্রন্থাগার, ব্রজমোহন কলেজ গ্রন্থাগার এবং অন্যান্য বিদ্ব্যজনের পারিবারিক গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। আর এই বই পড়ার স্পৃহায় তিনি নিজ গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, যা তাকে স্বপ্ন দেখাত যুক্তিহীন কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিপরীতে একটি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ প্রতিষ্ঠার। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে কয়েক হাজার বইয়ের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। কিন্তু ১৯৬১ সালে ভয়াবহ বন্যায় তাঁর অধিকাংশ সংগ্রহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে ১৯৮০ সালে তাঁর ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে তিনি বিগত বিশ বছরের সমূদয় উপার্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। মানবকল্যাণে তিনি নিজ দেহ ও চোখ উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। জ্ঞানার্জনে শিক্ষার কোন বিকল্প হতে পারে না, এই সত্যটি আরজ আলী উপলব্ধি করেছিলেন, তাইতো আমৃত্যু জ্ঞানন্বেষনে ছুটে বেরিয়েছেন।

প্রাযুক্তিক উন্নয়নের হাত ধরে ছুটে চলা এই সভ্যতা হয়তো আরজ আলী’র স্মৃতি রোমন্থন করতে উৎসাহী নয়, কিন্তু এদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের বহুলাংশের মাঝে যখন যুক্তিহীনতা, বিজ্ঞানবিমুখতা আর জ্ঞানার্জনের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সনদলাভের স্পৃহা বেশি কাজ করে তখন প্রশ্ন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা আধুনিক সভ্যতার অংশীদার হয়েও কতোটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছি নিজেদের? লৌকিক পথিক মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বত্তার মূল ভিত্তি হচ্ছে মানবীয় উৎকর্ষতা ও যৌক্তিক-বিশ্লেষণার্থক চিন্তার প্রসারতা। যা তাকে অনুপ্রাণিত করে জ্ঞান চর্চায়। কালের ক্রমবিকাশে এই লৌকিক পথিক মানুষেরাই আজ হয়ে গিয়েছে মহাজাগতিক পথিক, যে ছাড়িয়ে গেছে সময়কে-নিজেকে। আরজ আলী, সেই লৌকিক পথিক-দার্শনিক, যার দর্শন এখনো অনুপ্রেরণাদায়ী বহুমাত্রিক কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেদ করে যৌক্তিক সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে।

আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, জাতিগত বিদ্বেষ আর রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বর্তমান সময়ে আনবিক বোমার চেয়েও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাগত প্রজন্মের জন্য নতুন শান্তিময় বিশ্ব বিনির্মাণে এখন প্রয়োজন মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, বিজ্ঞানমস্কতার উত্তরণ ঘটনো। মানুষ যখন নিজেই তার মেধা আর মননের সমন্বয়ে যৌক্তিক পথে চলতে শেখে তখন তাকে আলাদাভাবে কুসংস্কার সম্পর্কে সচেতন করে তোলার প্রয়োজন পড়ে না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষের চেয়ে তাই আমাদের বেশি প্রয়োজন স্বশিক্ষিত আলোকিত মানুষের। যারা প্রশ্ন করতে শিখবে, যুক্তি আর জ্ঞানের ধারাবাহিকতায় সত্যকে অন্বেষন করবে। আরজ আলী ছিলেন সেই পথেরই পথপ্রদর্শক। আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার সন্ধানে উন্নত বিশ্ব যখন অগ্রসরমান, তখন এই আমরা পশ্চাৎপদতা আর গতানুগতিকতার আটপৌঢ়ে চিন্তায় আবর্তিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ-জাতি যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতায় ক্রমধাবমান তখন আমরা বাংলাদেশে ক্রমশঃই যেন পিছিয়ে পড়ছি। এর মূল কারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের দায়বদ্ধতা ও সচেতনতার অভাব। এই অনগ্রসরতার দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার জন্য আমরা প্রতীক্ষিত। আরজ আলী’র মতো স্বশিক্ষিত মানুষেরাই সেই বদলে দেয়ার চেষ্টাটুকু করতে পারে। আমরা তাই এখনো স্বপ্ন দেখি এই দেশে মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চায় আর যৌক্তিক চিন্তায় বেড়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম। যে ছাড়িয়ে যাবে নিজেকে, ছাড়িয়ে যাবে বর্তমানকে .. .. হয়ে উঠবে মহাজাগতিক পথিক। মানবিক স্বপ্নে বিভোর আমরা সেই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্রতীক্ষিত।

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:০৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×