বরিশাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে চড়বাড়িয়া ইউনিয়নের লামচড়ি গ্রাম। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর ধর্মান্ধতার বেড়াজাল এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই প্রাচীণ জনপদ। এখানেই ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৩ পৌষ (ইংরেজি ১৭ ডিসেম্বর, ১৯০০) এক কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন আরজ আলী মাতুব্বর। শৈশব থেকেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা আরজ আলীর মনে বাসা বেঁধেছিল জগত, জীবন সম্পর্কিত নানা জিজ্ঞাসা। যার যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও উত্থাপিত প্রশ্নের সমৃদ্ধতা তাকে উপস্থাপন করেছে একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি হিসেবে। তাঁর দর্শন বিদগ্ধজনকে বিস্মিত করে, তার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর হচ্ছে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষিতে তাঁর বিস্ময়কর অর্জন। গ্রামের মক্তবে ‘বাল্যশিক্ষা’ বই পড়ে তার বাল্যশিক্ষার সমাপ্তি ঘটলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে গড়ে ওঠা একজন সাধারণ মানুষের এই স্বনির্মাণ প্রতিষ্ঠা লাভ বাঙালি মননে আজও বিস্ময় হয়ে রয়েছে।
অন্য পাঁচ-দশটা গ্রাম্য শিশুর মতই জন্মের আড়ম্বরতাহীন পরিবেশে এক অতি সাধারণ দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মানোতে সামান্য ভিটেবাড়ি ছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে তেমন কোন বিষয় সম্পত্তিই পাননি তিনি। বাবাকে হারান শৈশবেই। নিজ গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বেরিয়ে পড়তে হয় কাজের সন্ধানে। বাবাকে হারিয়ে কৃষিকাজে লেগে যান কৃষক বালক আরজ আলী। কৃষিকাজের ফাঁকে শিখে নেন জমি মাপজোখের আমিনের কাজ। লাঙ্গল ছেড়ে এবার আমিনের পেছনে শেকলবাহী আরজ আলী। আস্তে আস্তে পাকা আমিন হয়ে ওঠেন তিনি। দূর দূরান্ত থেকেও আসতে থাকে জমি মাপার বায়না। নিখুঁত, নিরপেক্ষ, চুলচেরা সূক্ষ্ম মাপজোখ এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকাতেই আরজ আলী মাতুব্বরের চাহিদা বেড়ে যায় এলাকার শহরেও। পিতৃহীন আরজ আলী মায়ের স্নেহেই বড় হচ্ছিলেন। বাংলা ১৩৩৯ সনে সেই মাকে হারিয়ে প্রচন্ড আঘাত পান তিনি। তখন আরজ আলী যৌবন পেরিয়ে। তার ইচ্ছা হলো মৃত মায়ের একটি ছবি তুলে রাখবেন। নিজেই ছুটে যান বরিশাল শহরে। এই দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে শহর থেকে ক্যামেরাম্যান এনে মায়ের ছবি তোলালেন। মৃত মায়ের ছবি তুলেছিলেন বলে আরজ আলী’র মায়ের জানাজা হলো না। আরজ আলীর’র অন্তরাত্মা থেকে উঠে আসতে লাগল হাজারো প্রশ্ন, জগত ও জীবন নিয়ে নানা জিজ্ঞাসা। প্রশ্ন করে করে নাড়িয়ে দিতে লাগলেন কুসংস্কারের ভিত। উত্তর খুঁজতে গিয়ে ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের ওপরে পড়াশুনা শুরু করেন । এই ব্যাপক পড়াশুনা তার মনে জাগিয়ে তোলে আরও প্রশ্ন। আলোড়িত হন প্রশ্নবানে। কাগজে লিখে রাখেন তার প্রশ্নগুলো, এবার উত্তর খোঁজার পালা। কারও কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে নিজেই আপন মনে করে চলেন সত্যের সন্ধান, আর এভাবেই লিখে ফেলেন তার প্রথম বই ‘সত্যের সন্ধান’। এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ এ। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। একে একে লিখে ফেলেন ‘সৃষ্টির রহস্য’, প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ এ; ‘স্মরণিকা’, প্রকাশিত হয় ১৯৮২ এ। সবশেষে লেখেন ‘ভিখারির আত্মকথা’।
আরজ আলী ছিলেন বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। আরজ আলী’র পরিচয় তার লেখার মধ্যেই। তাঁর প্রতিটি রচনাতেই মুক্তচিন্তা ও যুক্তির বিকাশের প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়েছে। বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব সবক্ষেত্রেই ছিল তাঁর যৌক্তিক পদচারণা। বরিশাল গণগ্রন্থাগার, ব্রজমোহন কলেজ গ্রন্থাগার এবং অন্যান্য বিদ্ব্যজনের পারিবারিক গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। আর এই বই পড়ার স্পৃহায় তিনি নিজ গ্রামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, যা তাকে স্বপ্ন দেখাত যুক্তিহীন কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিপরীতে একটি বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ প্রতিষ্ঠার। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে কয়েক হাজার বইয়ের এক সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা। কিন্তু ১৯৬১ সালে ভয়াবহ বন্যায় তাঁর অধিকাংশ সংগ্রহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরে ১৯৮০ সালে তাঁর ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে তিনি বিগত বিশ বছরের সমূদয় উপার্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’। মানবকল্যাণে তিনি নিজ দেহ ও চোখ উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। জ্ঞানার্জনে শিক্ষার কোন বিকল্প হতে পারে না, এই সত্যটি আরজ আলী উপলব্ধি করেছিলেন, তাইতো আমৃত্যু জ্ঞানন্বেষনে ছুটে বেরিয়েছেন।
প্রাযুক্তিক উন্নয়নের হাত ধরে ছুটে চলা এই সভ্যতা হয়তো আরজ আলী’র স্মৃতি রোমন্থন করতে উৎসাহী নয়, কিন্তু এদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের বহুলাংশের মাঝে যখন যুক্তিহীনতা, বিজ্ঞানবিমুখতা আর জ্ঞানার্জনের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সনদলাভের স্পৃহা বেশি কাজ করে তখন প্রশ্ন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা আধুনিক সভ্যতার অংশীদার হয়েও কতোটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছি নিজেদের? লৌকিক পথিক মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বত্তার মূল ভিত্তি হচ্ছে মানবীয় উৎকর্ষতা ও যৌক্তিক-বিশ্লেষণার্থক চিন্তার প্রসারতা। যা তাকে অনুপ্রাণিত করে জ্ঞান চর্চায়। কালের ক্রমবিকাশে এই লৌকিক পথিক মানুষেরাই আজ হয়ে গিয়েছে মহাজাগতিক পথিক, যে ছাড়িয়ে গেছে সময়কে-নিজেকে। আরজ আলী, সেই লৌকিক পথিক-দার্শনিক, যার দর্শন এখনো অনুপ্রেরণাদায়ী বহুমাত্রিক কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেদ করে যৌক্তিক সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, জাতিগত বিদ্বেষ আর রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বর্তমান সময়ে আনবিক বোমার চেয়েও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাগত প্রজন্মের জন্য নতুন শান্তিময় বিশ্ব বিনির্মাণে এখন প্রয়োজন মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, বিজ্ঞানমস্কতার উত্তরণ ঘটনো। মানুষ যখন নিজেই তার মেধা আর মননের সমন্বয়ে যৌক্তিক পথে চলতে শেখে তখন তাকে আলাদাভাবে কুসংস্কার সম্পর্কে সচেতন করে তোলার প্রয়োজন পড়ে না। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষের চেয়ে তাই আমাদের বেশি প্রয়োজন স্বশিক্ষিত আলোকিত মানুষের। যারা প্রশ্ন করতে শিখবে, যুক্তি আর জ্ঞানের ধারাবাহিকতায় সত্যকে অন্বেষন করবে। আরজ আলী ছিলেন সেই পথেরই পথপ্রদর্শক। আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার সন্ধানে উন্নত বিশ্ব যখন অগ্রসরমান, তখন এই আমরা পশ্চাৎপদতা আর গতানুগতিকতার আটপৌঢ়ে চিন্তায় আবর্তিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ-জাতি যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতায় ক্রমধাবমান তখন আমরা বাংলাদেশে ক্রমশঃই যেন পিছিয়ে পড়ছি। এর মূল কারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের দায়বদ্ধতা ও সচেতনতার অভাব। এই অনগ্রসরতার দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার জন্য আমরা প্রতীক্ষিত। আরজ আলী’র মতো স্বশিক্ষিত মানুষেরাই সেই বদলে দেয়ার চেষ্টাটুকু করতে পারে। আমরা তাই এখনো স্বপ্ন দেখি এই দেশে মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চায় আর যৌক্তিক চিন্তায় বেড়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম। যে ছাড়িয়ে যাবে নিজেকে, ছাড়িয়ে যাবে বর্তমানকে .. .. হয়ে উঠবে মহাজাগতিক পথিক। মানবিক স্বপ্নে বিভোর আমরা সেই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্রতীক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:০৮