somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন (শেষ পর্ব)

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১ম পর্ব

আমার বিয়ের আজ চতুর্থ দিন পুর্ন হল। আমি এখন আমার বাবার বাসায়। নাহ এতো তাড়াতাড়ি শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে আসিনি। বিয়ের স্বভাবিক অনুষ্ঠানের পরিক্রমায় এখন বাবার বাড়ি আছি। এই কয়দিন আমার স্বামী মানুষটার সাথে খুব বেশী কথা বলার সুযোগ পাইনি। কিন্তু এই লোকটার সাথে কথা বলার জন্য আমি রীতিমতো ছটফট করছি। আমার ধারণা ছিলো এই পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষ থাকে। এক দল অন্য মানুষদের ব্যবহার করে ফায়দা লুটে, যেমন আমার বাবা। আর অন্যদল নিজেদের ব্যবহৃত হতে দেখে মজা পায়, যেমন আমার প্রাক্তন প্রেমিক আসিফ টাইপের মানুষ। কিন্তু একটা অদ্ভুত কারনে আমি এই লোকটাকে কোন দলেই ফেলতে পারছিনা। এই লোকের চালচলন, আচার ব্যবহার কোনকিছুই আমার পরিচিত ছক মাফিক পড়ছেনা। একটা মোবাইল ভেঙে ফেললাম আর লোকটা কিছুই বল্লোনা। এ কেমন জাতের লোক?

আমি যখন বৌভাতের পর বাবার বাড়ি ফেরত আসি তখন আমার সাথে সাথে তিন ট্রাক আসবাবপত্রও ফেরত এসেছিলো। এই সব আসবাব ছিলো আমার বিয়ে উপলক্ষে আমার বাবার দেয়া উপঢৌকন। আমার স্বামী আসিফ এই গুলোর একটাও তার বাসায় ঢুকতে দেননি। আমার সাথেই ফেরত পাঠিয়েছেন। মিষ্টি করে আমার আব্বাকে বলে গিয়েছিলেন, এখনো এতো গরিব হইনি যে আপনার মেয়ের সুখের জন্য দু চারটে কাথা বালিশ কিনে দিতে পারবোনা। মেয়ে দিয়েছেন বড় উপকার করেছেন। এইগুলো দিয়ে আর ছোট করবেন না। এই লোকটা সম্ভবত আমার আমার বাবার ছকেও ঠিকমতো আটেনি। কেননা, সেদিনের পর থেকে আব্বার মুখ থেকে একবারের জন্যও মেয়ের জামাইয়ের প্রশংসা শুনিনি। মনে মনে ভেবে আরেকবার শান্তি পেয়েছিলাম যাক কেউ একজন তো এই পৃথিবীতে আছে যে আমার আব্বাকে মুখের উপর না বলতে পারে। আর উত্তরে আব্বা কিছুই বলেনা।

এখন প্রায় নিশুতি রাত। আব্বা ঘুমিয়ে পড়েছেন। আসিফও মাত্র বাহির থেকে ফিরলো। আমি আমার ঘর থেকেই শুনতে পেলাম মা তাকে জামাই আদরে খাওয়াচ্ছে। মা কয়েকবার ডাকলেন কিন্তু ভুলেও আমি ওঘর মাড়ালাম না। মার জামাই মা আদর করে খাওয়াক। যখন আমার মেয়ের জামাই হবে আমি আদর করে খাওয়াবো। ব্যপারটা মাথায় আসার সাথে সাথেই নিজেকে একটা চাটি মারলাম। প্ল্যান করছি পাকাপাকি বাবার বাড়ি থেকে যাওয়ার আর এইদিকে মনে মনে মেয়ের জামাইয়ের স্বপ্নও দেখে ফেলছি। আসলে কি চাচ্ছি আমি? আমার নিজের উপরই রাগ হতে লাগলো। যখন অন্য কারো উপর রাগ হয়, সেই রাগ যখন তখন যার তার উপর ঝেড়ে ফেলা যায়। কিন্তু নিজের উপর রাগ হলেই মুশকিল। সেই রাগ নিজের ভেতরেই পুষে রাখতে হয়। কিন্তু আমি তো আমিই। আমি এবারও ধরে নিলাম এই রাগের পুরো দায়ভার খাবার ঘরে খাদ্যরত আসিফ নামের লোকটার। আব্বা নিশ্চয়ই ইচ্ছে করেই আসিফ নামের একটা লোকের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে। যাতে আজীবন আমার কাঁটা ঘায়ে নুনের মতো এই লোকটা লেগে থাকতে পারে। আমি এখনো নিশ্চিত করে জানিনা, এই লোকটা আসিফ সম্পর্কে আসলেও কিছু জানে কিনা। জানলেই বা কতদুর জানে। যদি না জানে তো সব উগড়ে দিতে হবে। আর যদি জানে। তবে আরো ভয়ঙ্কর কিছু মিথ্যা কথা সেটার সাথে যোগ করতে হবে। আমি মনে মনে কথা গুছিয়ে নিতে থাকি।

আসিফ প্রথমে ঘরে ঢুকে যে ভয়ঙ্কর কাজটা করলো তা হল, আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি একটা হাসি দেয়া। এর পর পরই আবিষ্কার করলাম আমি এতোক্ষন ধরে যা যা ভেবেছি কোনকিছুই আমার মনে পড়ছেনা। পুরো মাথাই একেবারে ফাঁকা। আমি মুর্তির মতো ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আসিফ মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল, "খাবার ঘরে আসেননি দেখে ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছেন, এখন তো দেখছি পুরো মিলিটারির ভঙ্গীতে ব্যরিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার উপর হামলা করার পাঁয়তারা করছেন নাকি। হা হা হা"!!

আমি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি! পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি। একটা মানুষের হাসি এতোটা মোহ লাগানো কি করে হতে পারে? কি করে?

"আগেই বলে দেই। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। কোন কোন দিন দেখবেন দিনে বারোটায় ঘুম থেকে উঠছি, কোন কোন দিন দেখা যাবে ঘরে ফেরারই সময় পাচ্ছিনা। আপনার তো ভালো জানার কথা। আপনার বাবাও ব্যবসায়ী মানুষ"।

নাহ! এই লোকটাকে থামানো দরকার। যুদ্ধের ময়দানে নেমে লেজ গুটিয়ে পালানোর মানে হয়না। একটু বাঁকা হেসে বললাম, "আমার আব্বা ব্যবসায়ী ঠিক আছে, কিন্তু মানুষ কিনা ঠিক জানিনা"।

কথায় কাজ হল লোকটা হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আপাতত এটাই দরকার। ওই আক্রমণাত্মক হাসি শুরু হওয়ার আগেই যা বলার বলে ফেলতে হবে।

"আপনি জানেন, বিয়ের আগে আমার একটা সম্পর্ক ছিলো। আমার আব্বা জানতে পেরে দেড়দিনের মাথায় আপানার সাথে আমার বিয়ে দেয়"।

"জানি"।

আমি আবারো হোঁচট খেলাম। এতো সহজে বলে দিলো জানি।

"কিভাবে"?

"ধরে নেন যেভাবে আপনার আব্বা জানতে পেরেছে অনেকটা সেভাবেই"।

আমি ফ্লোচার্টের দ্বিতীয় ধাপে চলে গেলাম, "এইটা কি জানেন সেই সম্পর্ক কতোটা গভীর ছিলো"?

"জানি। আপনি একজন মানুষ। ভুল করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি যেহেতু একই সাথে অনেক ভালো একজন মানুষ সেই ভুলের মাত্রাও খুব বেশী হবেনা এটাও একইরকম ভাবে স্বাভাবিক"।

আমার ফ্লোচার্ট এইখানেই শেষ হয়ে গেলো। নিজের সম্পর্কে এতো ভালো ভালো কথা শুনতে আমি অভ্যস্ত নই। আমার আব্বার চোখে আমি ছিলাম এক ধরণের চোর জাতীয় মানুষ। তার ভাবটা ছিলো এমন, যে কোন সময় তার মান সম্মান চুরি করে আমি হাট বাজারে বেঁচে দিতে পারি। সবসময় আমার উপর তাই কঠোর নজরদারি। সে বাসার প্রাইভেট টিউটর হোক আর কলেজের স্যারই হোক। আমার তো মনে হয় আসিফের প্রতি দুর্বলতার কারণ আমার ভালোবাসা নয়। আমার জেদ। চুরি না করেই চোরের শাস্তি পাবো এটা কি মেনে যায়? চুরি করেই নাহয় চোর হলাম। কিন্তু এই লোক এতো আত্মবিশ্বাসের সাথে এই কথা বলছে কিভাবে? হঠাৎ বাড়ী ঘর কাঁপিয়ে লোকটা হাসতে শুরু করলো। আমি হা করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

"আচ্ছা, এমন একটা জিনিসের নাম বলেন তো যেটার কোন বাহ্যিক আঁকার নাই কিন্তু দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশী দামে কেনাবেচা হয়"।

আমি আরেকটু বড় আকারের হা করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

"জিনিসটা হল তথ্য। আপনার আব্বা কবি আসিফ সাহেবকে বিয়ের রাতেই বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন। যাওয়ার আগে তিনি আপনার আর তার মধ্যকার সম্পর্কের বিশদ বিবরণ আপনার বাবার কাছে রেখে যান। অবশ্যই তা খুব একটা স্বেচ্ছায় ছিলোনা। সেই তথ্যেরই কিছু মিছু অংশ আমার কানে চলে আসে। আপনার বাবা অবশ্য পুরো ব্যপারটা গোপনে করার যারপর নাই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। নিজের পেটে ভাত দিতে হলে অন্যের পেটে লাথি মারতেই হয়"।

"এতকিছু জানার পরও আপনি আমাকে বিয়ে করলেন"?

"এর পেছনেও কিন্তু একটা যৌক্তিক কারণ আছে। এ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য টাকার দরকার। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য একটা জীবন দরকার। আর আপনাকে প্রথম দেখার পর থেকেই আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো এই মেয়েটাকে ছাড়া আমার জীবনটা অর্থহীন। আমি শুধু টিকে থাকার জন্য বেঁচে থাকতে চাইনা। বেঁচে থাকার জন্য বাঁচতে চাই। আমি সোজাসাপ্টা বলে দিলাম। কিভাবে নিবেন সেটা এখন আপনার ব্যপার"।

এইটুকু বলেই আসিফ সাহেব সবকিছুই সঠিক সুন্দর স্বাভাবিক এমন একটা ভাব করে শুয়ে পড়লেন। আর আমি পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে ঠিক আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমি শ্রদ্ধা নামক জিনিসটার সাথে খুব একটা পরিচিত নই। আমার মার চোখে আমি সবসময়ই দাসত্ব দেখেছি। আমার আব্বাকেও কখনো দেখিনি আমার মাকে খুব বিশ্বস্ত একজন ভৃত্যের বাহিরে আর কিছু ভাবতে। আমার প্রাক্তন প্রেমিকের জন্যও আমার কিছু একটা অনুভূতি ছিলো। যেটাকে ঠেলেঠুলে কোনভাবে ভালোবাসার গন্ডিতে ফেলা গেলেও কোনভাবেই শ্রদ্ধার গন্ডিতে ফেলা যাবেনা। কিন্তু যে মানুষটা এমন অবলীলায় এতো কঠিন কথা বলে ফেলতে পারে তার প্রতি কি অনুভূতি হওয়া উচিত আমার? ঘুরে ফিরে আমার মাথায় শুধু একটা শব্দই মাথায় আসছে। আর তা হল শ্রদ্ধা। ছোট্ট একটা জীবন শুধুমাত্র শ্রদ্ধার উপর ভর করে কাটিয়ে দেয়া কি খুব কঠিন? মনে হয়না। হয়তো ভালোবাসা ছাড়া কাটিয়ে দেয়া যাবে কিন্তু শ্রদ্ধা ছাড়া জীবন কাটানো সত্যি বড় কঠিন।

অনেকদিন ধরেই আমি প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় ছিলাম। কিন্তু ঠিকানা ভুল ছিলো। আজ ঠিক ঠিক ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। কাল আমার শ্বশুরবাড়ি ফেরার কথা। উহু ভুল বললাম। আমার নিজ বাড়িতে ফেরার কথা। একটা নতুন মানুষের সাথে, একটা নতুন অনুভূতির সাথে, আমার দ্বিতীয় প্রত্যাবর্তন, আমার নিজ আলয়ে। আমি আর সাত পাঁচ না ভেবে ঘুমের তোড়জোড় শুরু করি। আমার নিজের বাড়িতে আমি মোটেও দেরী করে ফিরতে চাইনা।

(শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৪:১৮
৩১টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×