নিশিতার খুব তেষ্টা পেয়েছে। পানির জগটা খুব বেশী দূরে নয়, কিন্তু উঠে গিয়ে পানি ঢেলে খাওয়ার মত অবস্থায় নেই সে। ডান পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। পা নাড়ানো মাত্র পুরো শরীর ব্যথায় বাঁকা হয়ে আসে। নিশিতা বার কয়েক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। আজ মনে হয় আর শেষ রক্ষা হয়নি। পায়ের কোন একটা হাড় বেশ ভালমতোই ভেঙেছে। নিশিতা পাজামার কাপড় কিছুটা উঠিয়ে নিয়ে পায়ের দিকে তাকায়। পুরো পা’টা লাল নীল কালো রঙের বিচিত্র এক বিমুর্ত চিত্র হয়ে আছে। নিশিতা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। এই ধরণের জখমগুলো সাধারণত ওকে খুব একটা কাবু করতে পারেনা। কিন্তু আজ মনে হয় একটু বেশীই হয়ে গিয়েছে। কাল সকালে উঠেই ইউনিভার্সিটিতে ফোন দিতে হবে। এ অবস্থায় ক্লাস নেয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে গত তিন সপ্তাহে মোট ছয়দিন ছুটি নিলো সে। এর আগেও বেশ কয়েকবার ছুটি নেয়া হয়ে গিয়েছে। জমানো ছুটিগুলোও প্রায় শেষের পথে। এবার ফোন দিলে হয়তো পার্মানেন্ট ছুটিই দিয়ে দিবে। কিন্তু কিছু করার নেই। পা’টা না ভাঙলেও হয়তো কিছু একটা চিন্তা করা যেতো। নিশিতা ডান পা’টা না নাড়িয়ে বাম পাশে বাঁকা হয়ে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে। সাথে সাথে দরজার মৃদু একটা শব্দে ঝটকা মেরে আবার সোজা হয়ে বসে। টের পায় ঝাঁকুনি লাগায় পা থেকে ব্যথাটা আবারো সরীসৃপের মত হিংস্র হয়ে উঠছে। সেই অবস্থায়ও নিশিতা ছোট করে একটা হাসি দেয়। পানির গ্লাস নিয়ে বিছানার পাশে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে। হাসতে গিয়েই টের পায় ঠোঁটগুলোও আর অক্ষত নেই। অরুণ গুটি গুটি পায়ে বিছানার আরো কাছে এগিয়ে এসে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। ওর বড় বড় চোখগুলো তখন নিশিতার জখমী পায়ের বিমুর্ত চিত্র দেখতে ব্যস্ত। নিশিতা গায়ের ওড়নাটা দিয়ে পা’টা ঢেকে দেয়। পানির গ্লাসটা সাইড টেবিলে রেখে অরুণকে টেনে এনে পাশে বসায়।
"রাতে ভাত খেয়েছো আব্বু? মুখটা এতো শুকনা লাগছে কেন"?”
“"তোমার কি খুব বেশী ব্যথা লাগছে আম্মু"?”
নিশিতা হেসে অরুণকে কাছে টেনে নেয়। ভাগ্যিস হাতদুটো তেমন জখম হয়নি। অরুণের ছোট করে কাটা চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, "এসব কিছুনারে বাবা। কালকেই দেখবে আম্মু একদম ভালো হয়ে গিয়েছি। তারপর আম্মু আর অরুণ মিলে ক্রিকেট খেলবো কেমন? এখন যাও ঘুমাতে যাও। কাল সকালে স্কুলে যেতে হবেনা”"?
“"আমি আর কক্ষনো ক্রিকেট খেলবোনা। কক্ষোনা"”!
নিশিতার হঠাৎ খেয়াল হল অরুণের নতুন ক্রিকেট ব্যটটা ভেঙ্গে দুই টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ভালো কাঠ পড়েনি। সবকিছুতেই ভেজাল। অবশ্য খারাপ কাঠের দুই ঘাঁতেই ঠ্যং একটা ভেঙ্গে ঝুলে পড়েছে। ভালো হলে তো এখন হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকতে হতো। রেগে গেলে জামিলের কোন হুশ থাকেনা। আর ড্রাঙ্ক থাকলে তো কথাই নেই। আজ ক্রিকেট ব্যাট তো কাল ব্যডমিন্টনের র্যা কেট। মশারির স্ট্যন্ড, টেবিলের পায়া এগুলোও দেদারসে চলে। কবে যে দা বটি নিয়ে আসবে কে জানে? নিশিতা অরুণের গাল টিপে ধরে, “" আম্মু তোমাকে আরো সুন্দর দেখে একটা ব্যাট কিনে দেবো কেমন! মন খারাপ করতে হয়না। এখন যাও, লক্ষী ছেলের মত ঘুমাতে যাও। কাল স্কুলে যেতে তো"”!!
অরুণ চুপচাপ পা দিয়ে মাটিতে নকশা কাটতে থাকে। মাটির দিকে তাকিয়েই বলে, “"আম্মু আমার ব্যাট লাগবেনা। চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই। গ্রামে নানুর বাড়ি চলে যাই। গ্রামে আমি থাকতে পারবো। আমার কোন অসুবিধা হবেনা। এখানে আমার ভালো লাগেনা। এখানে থাকলে দেখা যাবে বাবা আর দাদু মিলে একদিন.........”"।
অরুণ কথা শেষ করেনা। কিন্তু নিশিতার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠে। অরুণের বলে ফেলা কথাগুলোর চাইতে না বলা কথাগুলোকেই সে বেশী ভয় পায়। জামিল যখন নিশিতাকে পেটাচ্ছিলো অরুণ তখন আসে পাশে ছিলোনা। সে কি করে টের পেলো এইসব? নিশিতা কিছু বলেনা। চুপচাপ অনেকক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার চেহারা, গায়ের রঙ এমনকি কথা বার্তার ধরণ, সবকিছুতেই মায়ের ছাপটা বেশী। বাবার কাছ থেকে বলতে গেলে কিছুই পায়নি। নিশিতার নিজের চেহারাটা কখনই খুব একটা পছন্দের ছিলোনা। কেমন দায়সারা একটা চেহারা। চোখ, মুখ, নাক, কান জায়গামতো থাকতে হয় তাই আছে। একটু গুছিয়ে জায়গামত থাকলে কি হতো? অরুণ হওয়ার আগে যতবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে, ততবারই এ কথা মনে হয়েছে। সেই একই চোখ, মুখ, নাক, কান নিয়ে অরুণের জন্ম। অথচ কি মায়াকারা চেহারা। নিশিতার মা সবসময় বলে, মায়ের কাছে নাকি সন্তানের চেহারা সবসময় সুন্দর হয়। কিন্তু নিশিতার বিশ্বাস হয়না। অরুণের চেহারা আসলেও সুন্দর। শুধু চেহারা না, একদম শান্ত শিষ্ট এই ছেলেটার কিছু কিছু কথা শুনলে নিশিতারও মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়না ওর ছেলের বয়স মাত্র বারো। কখনো পড়তে বসার জন্য অরুণের সাথে দস্তাদস্তি করতে হয়নি, স্কুল থেকেও কখনো কোন নালিশ আসেনি। বরং ভালো রেজাল্টের জন্য স্কুলের টিচারেরাই মাথায় তুলে রাখে। কেবল খাবার গেলানোটাই যা একটা ঝামেলা। অরুণের চোখ এখন নিশিতার ওড়না ঢাকা পায়ের দিকে। কেউ বলে দেয়নি তাও মায়ের কষ্ট বুঝতে ছেলেটার দেরি হয়না। নিশিতা অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। এই রকম একটা ছেলের জন্য একটা কেন দশটা পা ভাঙলেও কোন কষ্ট নেই। এ সংসার টিকিয়ে রাখতে যত কিছু সহ্য করার দরকার সে করবে, তবুও তার ছেলেটা ভালো থাকুক। সমাজের আঙ্গুল তার ছেলের দিকে সে উঠতে দিবেনা। নিশিতা অরুণকে বুকে টেনে নিতে নিতে বলে, "“এভাবে বলতে হয়না বাবা, এক সময় দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার অরুণ বাবা যখন অনেক বড় হবে তখন দেখবে আম্মুর আর কোন কষ্ট থাকবেনা”"। কথাগুলো বলতে বলতে কেন যেন তার চোখ ভিজে এলো। ছেলেটার সাথে মিথ্যে কথা বলতে তার বড় কষ্ট হয়। একটা ভাঙ্গা পায়ের কষ্টের চাইতেও সে কষ্ট অনেক বেশী তীব্র।
পাঁচ ছয়মাস পরের কথা। অরুণ তার ছোট্ট খাটের উপর শুয়ে ভীষণ কাঁপছে। এমনিতে সে অনেক সাহসী ছেলে, অন্ধকার ঘরে একলা ঘুমাতে একটুও ভয় পায়না। কিন্তু আজকে তার সবকিছুতেই ভয় লাগছে। একটু আগেও পুরো বাসাটায় অনেক মানুষ ছিলো। এখন কেউ নেই। শুধু সে, তার আব্বু আর দাদু। বাসার কাজের বুয়াটারও আজ ছুটি। অরুণ বুকের উপর কম্বল চেপে ধরে। তারপরেও তার কাঁপাকাঁপি থামছেনা। বার বার মার কথা মনে পড়ছে। এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা, গলায় ওড়না পেঁচানো, ফ্যনের সাথে ঝুলতে থাকা মানুষটা তার মা। না ওটা আর যেই হোক, তার মা হতে পারেনা। ওর মা সবসময় ওকে দেখলেই ছোট্ট করে হাসতো । আব্বু যতই মারুক, ওকে দেখে মা কখনোই গোমড়া মুখে থাকতোনা। ঐ ঝুলে থাকা মানুষটা দেখতে আম্মুর মতোই ছিলো। অরুণ একবার মাত্র দেখেছে। তারপর ওর আব্বু ওকে ঠেলে বার করে দিয়েছে। তারপর শুধু মানুষ আর মানুষ। পুলিশও এসেছিলো। অরুণ বারান্দার এক কোনায় বসে কাঁপতে কাঁপতে শুনেছে ওর নানুর চিৎকার। ওর নানু ওকে নিয়ে যেতে চাইছিলো, কিন্তু দাদু আর বাবা দেয়নি। অরুণ তখন কিছুই বলতে পারেনি। শুধু থর থর করে কাঁপছিল। সে আত্মহত্যা শব্দটা আগে কখনো শুনেনি। তার মা নাকি আত্মহত্যা করেছে। নিজেকে নিজেই মেরে মেলেছে। পুরো ব্যপারটা সে বুঝতেও পারছেনা।
আজ সারাদিন সে মার অপেক্ষায় ছিলো। অথচ আম্মু এখনো এলোনা। তাহলে কি সবাই সত্যি বলছিলো। অরুণ কাঁপতে কাঁপতে বিছানা থেকে নেমে আসে। তার যত ভয়ই লাগুক সে আম্মুর ঘরে যাবে। আম্মুকে খুঁজবে। যদি আম্মুর পানির তেষ্টা পায়, তাহলে আম্মুকে পানি দিয়ে আসতে হবে। আম্মুর অনেক কষ্ট। অরুণ আস্তে করে নিশিতার ঘরের দরজাটায় ঠেলা দেয়। পুরো ঘর ফাঁকা, এলোমেলো। খাটের উপর কেউ নেই। ঘরের পাশের বাথরুমের দরজাটাও হাট করে খোলা। অরুণ গুটি গুটি পায়ে বিছানায় উঠে বসে। আম্মুর বালিশের উপর হাত বুলিয়ে দেয়। এই বিছানাটার ঠিক উপরেই ওই মানুষটা ঝুলছিলো। ওর আম্মু ঝুলছিলো। আম্মুর খুব কষ্ট হচ্ছিলো নিশ্চয়ই। খুব তেষ্টাও হয়তো পেয়েছিলো। কেউ আম্মুকে একটু পানিও কি দেয়নি? আজ সারাদিনে প্রথম বারের মতো অরুণের চোখে পানি জমে। শান্ত জলপ্রপাতের মতো সে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানার উপর পড়তে থাকে। অরুণ এখন জানে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিতে ওর আম্মু আর কখনোই ছুটে আসবেনা। সে খেলা বাদ দিয়ে সারাদিন পড়াশোনা করতো, যাতে ফার্স্ট হয়ে আম্মুকে দেখাতে পারে। অরুণ ফার্স্ট হলে আম্মু খুব সুন্দর করে হাসত। এখন আম্মু নেই। ওর ফার্স্ট হওয়ার দরকার নেই। ওর বড় হওয়ারও দরকার নেই। কিন্তু বড় কিছু একটা করতে হবে। এখনই করতে হবে। অরুণ বিছানা থেকে নেমে মাটিতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ওর এখন আর ভয় ভয় লাগছেনা। কাঁদতেও ইচ্ছে হচ্ছেনা আর। বুকের ভেতর খুব অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভুতির নাম জানা নেই তার।
রোকসানা বেগম, নিশিতার শ্বাশুরি এবং অরুণের দাদু ঘুম থেকে উঠলেন প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে। এমনিতে তার ভ্রু দুটো বিরক্তিতে কুঁচকে গিয়ে প্রায় সবসময়ই কাছাকাছি পাশাপাশি থাকে। এখন তো মনে হচ্ছে এরা আজীবনের জন্য মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে। এমনিতে সারাদিন যা একটা ধকল গেলো। মানুষ, পুলিশ, এখন রাতের বেলাতেও কি একটু রেহাই পাওয়া যাবেনা। এই মাঝরাতেও দরজাতে ঠক ঠক। কোথাকার কোন এক আধগেঁয়ো মেয়ে এসে জুটেছে। নিজে মরলো, সবাইকে মেরেও গেলো। ঘরে তো জামিল আর অরুণ ছাড়া আর কেউ নেই। হল কি আবার। রোকসানা বেগম রাগে গজ গজ করতে করতে দরজা খুলে তার জীবনের সবচেয়ে অবাক করা দৃশ্যটা দেখলেন। দরজার সামনে অরুণ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে রান্নাঘরের মাংস কাটার ছুরি। পরনের গেঞ্জির পুরোটাই রক্তে ভেজা। সারা মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত। জামিলের ঘর থেকে রক্তের দাগ শুরু হয়ে তার ঘরের সামনে এসে শেষ হয়েছে। রোকসানা বেগম আতংকে পুরোপুরি জমে গেলেন। অরুণ তার দাদুর প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসলো। হাসতে হাসতেই বলল, “"দাদু বাবাকে মেরে ফেলেছি”"।
রাত তখন শেষের দিকে। ফযরের আযান পড়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ হল। কিছুক্ষণ পরেই সুর্য উঠবে। অন্ধকারে নিমজ্জিত এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর একটা কঠোর অরুণোদয়ের বড় প্রয়োজন।