somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বছরের প্রথম সুর্যোদয়

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পশ্চিমা বিশ্বে নাইট লাইফ বিশাল আমুদের ব্যপার। পুর্ব-বিশ্বের অনেক দেশেও নাইট লাইফের আড়ম্বরপুর্ণ দেখা মিলে। তবে সর্ব পুর্বের দেশ জাপান কিছুটা ব্যতিক্রম। নাইট লাইফ এইখানেও বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। তবে এরা ভদ্র জাতি কিনা, অভদ্রতা চার দেয়ালের মাঝেই পরিমিত রাখতে পছন্দ করে। ইংরেজি নতুন বছরের শুরুটা তাই অত বড় পরিসরে জাঁকজমকপুর্ণ ভাবে হয়না। টোকিও তে কাউন্ট ডাউন পার্টি খুঁজতে হলে যেতে হবে বিভিন্ন ক্লাব, পার্ক অথবা ক্রুজগুলোর জমজমাট আয়োজনে। আর ফ্রিতে ক্ষণ গণনা করতে হলে যেতে হবে টোকিওর শিবুয়া ক্রসিং এ। শিবুয়া শুধু টোকিওর নয়, পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত ক্রসিং। বিশ্বায়নের প্রবাহে পশ্চিমা বিশ্ব হতে ভেসে আসা উৎসবগুলো যেমন হ্যালোউইন, থার্টিফার্স্ট নাইট টোকিওবাসী এইখানেই পালন করে। গত বেশ কয়েকবছর ধরেই রাত নয়টার পর এই ক্রসিং এ যান চলাচল বন্ধ করে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের আয়োজন করা হয়। তবে মুল ধারার জাপানিজ বর্ষবরণ অনেকটাই ভিন্ন ধাঁচের-শান্ত এবং চুপচাপ। এদের বর্ষবরনের শুরুটা হয় বিভিন্ন শ্রাইন এবং মন্দিরের ঘন্টা বাজানোর মধ্য দিয়ে। বড় বড় শ্রাইন এবং মন্দিরগুলোয় মধ্যরাত এবং ভোরবেলায় থাকে উপচে পড়া ভিড়। সেই ভিড়ের লোকসংখ্যা মাঝে মধ্যে লাখ ছাড়িয়ে যায়। আমি তাই পুর্বে থেকে পশ্চিমা তালে না নেচে ভাবলাম জাপানিজ কায়দার বর্ষবরন দেখে আসি।

বর্ষবরনের আরেকটি জাপানিজ ট্র্যাডিশন হলো বছরের প্রথম সুর্যোদয় দেখা। ব্যাপারটা মনে ধরলো। সুর্যোদয়ের দেশে থেকে বছরের প্রথম সুর্যোদয় দেখার ব্যাপারটি নিতান্ত মন্দ নয়। কিন্তু আমি খুব একটা লোকসমাগমপ্রেমী মানুষ নই। আবার টোকিওতে থেকে হলিডের মৌসুমে ভিড়বিহীন টুরিস্টস্পট আশা করা আর পাবলিক পরীক্ষার টাইমে ফাঁকা ঢাকার রাস্তা কল্পনা করা একই কথা। বাস্তবে ইহাদের অস্তিত্ব নাই। আমরা তাই ঠিক করলাম কিছুটা দুরেই যাওয়া যাক। আর দূরে যখন যাচ্ছিই, প্রশান্ত মহাসাগরের পাড়ে দাড়িয়েই সুর্যোদয় দেখে আসি। তাই আমাদের এবারের গন্তব্য হলো চিবা প্রিফেকচারের কেইপ ইনুবো।


টোকিওতে এমনিতে রাত একটার পর লোকাল ট্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তবে নতুন বছর উপলক্ষে সেদিন রাতভরই লোকাল ট্রেন চালু ছিলো। আমরা ডর্ম থেকে রওনা করলাম রাত সাড়ে বারোটায়। আমি শান্ত শিষ্ট ভালো মেয়ে। অত রাতে লাইব্রেরি ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছি কিনা মনে করতে পারিনা। যদিও ঠাণ্ডায় কাহিল, তারপরও গভীর রাতে ফাঁকা টোকিওর চেহারা দেখতে মন্দ লাগছিলোনা। আমরা ৫ জনের দল। ৫ জনই এশিয়ার পাঁচ প্রান্ত থেকে আগত। টোকিওর মতো গলাকাটা শহরে দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া পকেটের স্বাস্থ্যের জন্য ব্যপক ক্ষতিকারক। আমাদের পাঁচজনের তাই একটাই কম্বাইন্ড টিকেট একদিনের জন্য। এই টিকেট আবার শুধুমাত্র লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তারউপর মধ্যরাত হওয়ায় ট্রেনের ফ্রিকোয়েন্সি কম; রুটও লিমিটেড। অতঃপর চারবার ট্রেন পরিবর্তন করে যখন গন্তব্যে পৌছালাম তখন প্রায় ছয়টা বেজে বিশ মিনিট। পুরো রাত ট্রেনে আর ওয়েটিং রুমে কাটলো। স্টেশন থেকে যখন বের হলাম বাইরের টেম্পারেচার ১ ডিগ্রী তারউপর সমুদ্রের পাড়ের কনকনে বাতাস। এই বাতাস ফুরেই ভালো ভিউ পাওয়ার জন্য আমরা কেইপের উঁচু একটা যায়গায় এসে দাড়ালাম।


ইনুবো হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একটা উপদ্বীপ। জাপানিতে ইনু মানে হলো কুকুর আর বো অর্থ ডাক। বলা হয়ে থাকে জাপানের এক মিলিটারি কমান্ডারের হারিয়ে যাওয়া কুকুর এখানে সাতদিন ধরে তার মালিকের জন্য ডাকাডাকি করছিলো। সেই থেকে এই এলাকার নাম ইনুবো। তবে নামের কারন যাই হোক না কেন, এই উপদ্বীপের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।



তিনদিকে শান্ত সমুদ্র। সমুদ্রের এই নিস্তরঙ্গতা দেখে বোঝা যায়না পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মহাসাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশ তখন একটু একটু ফর্সা হচ্ছে। পশ্চিমের আকাশ তখনো কালো। এই প্রথম দিক চিনতে আমার একটুও সমস্যা হচ্ছেনা। আকাশের প্রায় মাঝ বরাবর এক ফালি চাঁদ। কিন্তু সমস্যা একটাই। দুরের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ভেবেছিলাম সমুদ্রের বুক থেকে লাল টকটকে সুর্য উঠা দেখবো। সেটা আর হচ্ছেনা। তারপরও যা খানিকটা দেখা যাচ্ছে সেটাও মানুষের মাথা আর ক্যামেরার ভিড় ঠেলে রীতিমতো যুদ্ধ করে দেখতে হচ্ছে। তবুও আমরা হাল ছাড়লাম না। কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে যে যেখানে জায়গা পেলাম, সেখানেই দাঁড়িয়ে নতুন বছরের প্রথম সুর্যের অপেক্ষা করতে লাগলাম।


প্রায় পৌনে একঘন্টা অপেক্ষা করার পর সুর্য্যিমামা মেঘের দেয়াল ভেদ করে উপড়ে উঠলেন। এক ঝাক বেলুন উড়িয়ে উপস্থিত জাপানিজেরা নতুন সুর্যকে বরণ করে নিলো। আমিও দেখলাম বছরের প্রথম সুর্যকে। পশিমের আকাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে। চিকন চাঁদটাও হারিয়ে গিয়েছে। শান্ত সমুদ্র তার ধুসর রঙ পালটে এখন চঞ্চল গাঢ় নীল।


ফটোসেশনের পালা শেষ করে এবার দিনের আলোয় আমরা এলাকা দেখতে বের হলাম। রোদ উঠায় ঠাণ্ডা কমে এসেছে একই সাথে ভিড়ও কমে এসেছে। ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য সরাসরি নিচে পানির কাছাকাছি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। আমরা উপর থেকেই পাথরের উপর নীল পানি আছড়ে পড়া দেখলাম। কেইপ থেকে অল্প কিছুটা দুরেই দুই পাশে লম্বা বিচ। কিন্তু বেশ খানিকটা রাস্তা ঘুরে হেঁটে যেতে হবে। পানিতে যেহেতু এই ঠাণ্ডায় নামা সম্ভব না। আমরা আর সেইদিকে গেলাম না। ফিরতি পথে ওইখানকার স্থানীয় একটা টেম্পল ঘুরে ইনুবো স্টেশনে ফিরে আসলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ইম্পুকুজি টেম্পল যেটা কিনা আমাদের ফেরার রাস্তাতেই পড়ে।


জাপানের মোটামুটি সব টেম্পল আর শ্রাইন একই ধাঁচের। শুধু বয়স আর আকৃতিভেদে চারপাশের সাজসজ্জার কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। তবে এই টেম্পলে এসে দেখলাম বছরের প্রথম দিন উদযাপনের জন্য বেলুন উড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। আমি কিছু বোঝার আগেই আমার হাতে একটা বেলুন ধরিয়ে দেয়া হলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। না জানি এখন কতগুলো ইয়েনকে গুডবাই বলতে হবে। টোকিও থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে হলেও তো বৃহত্তর টোকিওরই পার্ট। কিন্তু জিগ্যেস করতেই জানা গেলো, এইটা ফ্রি। এমনকি বেলুনের সাথে
ফ্রি ম্যাসেজ কার্ডও ধরিয়ে দিলো। কিন্তু আমি কোন ভাষায় ম্যাসেজ লিখবো এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই দেখা গেলো বেলুন উড়ানোর সময় হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আমিও বেলুন উড়িয়ে নতুন বর্ষকে স্বাগতম জানালাম।


এইবার ফেরার পালা। আবারো চারবার ট্রেন পাল্টিয়ে যখন বাসায় ফেরত এলাম, বছরের প্রথম দিনটির অর্ধেক শেষ। পুরো বছর কেমন যাবে জানিনা। আমি জ্ঞানী নই, ভবিষ্যৎ নিয়ে আগ্রহ কম। তবে শুরুটা ভালোই হল। অন্তত বলা তো যাবে, যতই তোমরা ভোরের পাখি হওনা কেন, বছরের প্রথম সুর্যটা তো এই রাতজাগা পাখিই আগে দেখলো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৩
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×