সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পগুলি আমার বিশেষ প্রিয়। সেগুলি পড়েছিও একটু দেরিতে, ক্লাস নাইনে উঠে বোধহয়। "খগম" পড়ে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। এরকম আরো কিছু গল্প আছে সত্যজিতের, "ফ্রিৎস", "বৃহচ্চঞ্চু"।
গল্পের কাহিনী বলে দিয়ে অন্যের পড়ার মজা মাটি করা আমার স্বভাব নয়। কিন্তু খগমের বেলায় আমি নিরূপায়, কারণ আমার পোস্টের শিরোনাম অনুযায়ী বেশ ফাঁদালো করে লিখতে গেলে এ ছাড়া করার কিছু থাকে না। খগমে দুই পর্যটকের একজন এক সাধুবাবার পোষা সাপ বালকিষণকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করে। সাপ তার একদমই পছন্দ নয়। সাধুবাবা আবার প্রত্যেকদিন সেই সাপকে ডেকে ডেকে দুধ পিলান। পোষা সাপের হত্যাকান্ড আবার সাধুবাবা দেখে ফেলেন। তিনি তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। শুধু বলেছিলেন, একটা গেছে তো কী হয়েছে? আরেকটা আসবে। বালকিষণের মৃতু্য নাই।
এর পর রেস্ট হাউজে ফিরে সেই সর্পঘাতী পর্যটক কেমন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। বিনা কারণে হিসহিস করতে থাকেন। ছড়া জপতে থাকেন মন্ত্রের মতো, বালকিষণের বিষম বিষ, ফিসফিস ফিসফিস ... ফিসফিসসসসসসস ... দেখা যায় তাঁর জিভে একটু লাল দাগ দেখা গিয়েছে, সেটা চিরে যাচ্ছে সাপের মতো। গায়ের চামড়ায় কেমন একটা ছোপছোপ দাগ।
এরপর এক রাতের ভেতর সেই ভদ্রলোকের শরীর রূপান্তরিত হয় সাপের শরীরে। পরদিন গল্পের বক্তা সাধুবাবার কাছে তার খোঁজে গেলে সাধুবাবা প্রসন্ন মুখে জানান, তাকে আর পাওয়া যাবে না। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সে রেখে গেছে তার মানুষের খোলসটা। তারপর এক বাটি দুধ হাতে সাধুবাবা বালকিষণকে ডাকতে থাকেন।
গল্পটা অনেক দিক থেকে ভয়ঙ্কর। কিন্তু সত্যজিতের লেখনীর গুণে দারুণপাঠ্য।
[গাঢ়] খগম সিনড্রোম [/গাঢ়] শব্দটি কয়েন করতে চাইছি পরিস্থিতির সাথে আশ্চর্য সাদৃশ্যের জন্যেই। রাজনীতিতে খগম সিনড্রোম আমরা অহরহ দেখি, যেখানে বিষাক্ত কোন চরিত্রকে যাঁরা ঘায়েল করেন, তাঁরাই আবার পরিণত হন সেই একই বিষাক্ত চরিত্রে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে আমরা টেনে হিঁচড়ে নামালাম, কিন্তু গণতন্ত্রের ভেতরে কোন সাধুবাবার অভিশাপ লাগলো, কিংবা কোন সে দুধের বাটির মোহে আমাদের স্বৈরাচারঘাতী গণতন্ত্রিয়াদের জিভে চেরা দাগ দেখা গেলো, আমরা বুঝেও প্রার্থনা করি, আমাদের আশঙ্কা যাতে সত্যি না হয়। আমরা ঐ ফেলে রেখে যাওয়া মানুষের খোলসটাকে ঘিরেই হইচই করি।
কিন্তু সাধুবাবারা যখন দুধের বাটি মেলে ধরে ডাক দেন, বালকিষণ, তখন সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ফণা তোলা বালকিষণরা ছুটে আসে।
আমাদের সামনে খোলা দুই রাস্তা। হয় বালকিষণের ছোবল খেয়ে মরা, নয়তো নিজেই মানুষের খোলসটা খসিয়ে ফেলে বালকিষণদের দলে ভেড়া। সাধুবাবারা এই দুই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাসেন, বিবৃতি দেন আর সময়মতো দুধের বাটি খুলে ডাক দেন। বালকিষণদের মৃতু্য নাই, যতদিন সাধুবাবারা আছেন। এই সত্য সাধু আর সাপ, দুজনেই জানে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।

