সোহেলের প্ররোচনায় আমার গীটারের প্রতি আগ্রহের জন্ম নেয়। সেই এক বিকালে সোহেল আর আমি গোলডেন মিউজিকে পৌঁছালাম গীটার কিনার উদ্দেশ্যে, সেখানে একজন সেতার বাজাচ্ছিল বসে, সেই সুর শুনে মনে হলো গীটার ফেলে সেতার কেনা ভালো। তবে সাধনা বা মনোযোগ আমার কম, তাই গীটার আনার উৎসাহে প্রথম 1 মাস খুব চললো টুংটাং, অবশ্য সারাদিনে সময় ছিলো খুব কম, আড্ডা মেরে সময় বের করতে পারতাম না গীটার বাজানোর। আর আড্ডা দেওয়ার মানুষের কমতি ছিলো না আসলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডার এক দল ছিলো তাসুরে, তাদের সাথে তাস পিটানো, আরেক দল ছিলো বামপন্থি রাজনীতিতে জড়িত, তাদের সাথে দ্্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের কারন অনুসন্ধান করে, আরও একটা ছোটোদলের সাথে হতো আধুনিক কবিতার আলোচনা, তাদের লেখা পড়ে, মতামত দিয়ে, আর উদ্দেশ্যবিহীন হেঁটে হেঁটে কখনও রমনা থেকে বেইলি রোড হয়ে সেখানে মারুফের বাসায় ওর ছবি আঁকা দেখতে যাওয়া, আর সেখানে বাঁশী বাজাতো মারুফ, সোহেল আর সেই সিেেদ্দশ্বরীর চায়ের দোকানে চা,
অথবা হেঁটে হেঁটে পান্থ পথ হয়ে, মানিক মিয়া এভেনু্য আড়ং, মোহাম্মদপুর, কিংবা কখনও মিরপূর 1-2-10 এবং মাঝে মাঝে এলিফ্যান্ট রোড, সেখান থেকে ফিরে আবার আড্ডার জন্য অন্য আরেক বাসায় গিয়ে বসা। আসলে দিনগুলোর মাপ 24 ঘন্টা হওয়ায় বেশ সমস্যা ছিলো, সব কাজ গুছিয়ে করা হতো না।
পরীক্ষার সময়সূচি না দেখলে পড়ার কোনো তাগিদও আসতো না, এছাড়াও ছিলো খেলা, এর মাঝে গীটারের জন্য সময় বরাদ্দ ছিলো গভীর রাত। তখন আবার সবাই ঘুমায়, তাই বাইরের বারান্দায় মশার কামড়ের সাথে সাধনার ব্যাস্তানুপাতিক সম্পর্কের ফলে মাস 2 পরে সেই আগ্রহ সম্পুর্ন শেষ হয়ে গেলো।
অবশ্য সন্ধ্যা পরবর্তি সময়ে যাদের সাথে আড্ডা ছিলো তাদের ভেতরে অন্তত 6 জন গীটার বাজাতো নিয়মিত, তাদের ঘরে গীটারও ছিলো, সেখানেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে গিটার বাজানোই ছিলো গীটারের প্রধান চর্চা।
সেসময় বিভিন্ন ইনস্ট্রাকশন বই খুঁজে খুঁজে সূরের ব্যাকরন বোঝার চেষ্টা। পৃথিবী নিয়ম মেনে চলে, এটা সূর অবশ্যই সুরের একটা নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, নির্দিষ্ট অংকরে হিসাব আছে, আমি খুঁজে খুঁজে সেই অংক বোঝার চেষ্টা করলাম, ফলাফল হলো ভয়াবহ। আমি বেশ কয়েক দিন ঘেঁটে ঘেঁটে বিভিন্ন ব্যাকরনসম্মত সূরের সঞ্চালন দেখলাম,, শ্রুতিমধুরতার কারন কিংবা সূরের শ্রুতিমধুর হওয়ার পেছনেও কম্পনের বিশেষ অবদান আছে। আমাদের মাস্তিস্ক বেশ চমৎকার, সেখানে কোন কম্পঙ্কের পর কোন কম্পাঙ্ক যুক্ত হলে মস্তিস্কে চাপ কম পরে, কিংবা আমাদের শ্রবনযন্ত্র বেশ সুখদ একটা অনুভব পায় এসবই সূরের ব্যাকরনের অংশ। অনেক দিনের চর্চায় কিছু নির্দিষ্ট ফরম্যাট তৈরি হয়ে গিয়েছে। যারা নিয়মিত বাজায় তারা হয়তো এই ব্যাকরন না জেনেই একই ফর্মা ব্যাবহার করছে, ওদের প্রাকটিক্যাল জ্ঞানের সাথে আমার ব্যাকরন জানা জ্ঞান সব সময় ঐক্যতানিক নয়। ব্যাকরন আবেগটা ঢেলে দিতে শেখায় না। আবেগটা অংকের নিয়ম মেনে আসে না, ওটা অনুভবের জায়গা। এই একটা জায়গায় খামতি কখনই অতিক্রম করতে পারবো বলে মনে হয় না। আমার ভেতরে আবেগের পরিমান একেবারে নগন্য, তাই সেই অনুভবটা সুরে আসে না, আমার গীটার বাজানোর ধাঁচ বকের ছাঁপ দিয়ে ছবি আঁকার মতো, সাবলীলতা নেই, নেই একটার সাথে অন্যটা মিলে যাওয়ার সুক্ষতা।
চর্চা করলেও এই কমতিটা যাবে না, সূরের প্রধান লজিক অনুভব, অংক না, আমি অংক দিয়ে সূর তৈরি করতে পারি হয়তো, একটা সমিকরণ লিখে ফেলতে পারি, সেই সমীকরনের জন্য একটা মধুর সূর তৈরি হতে পারে। কিন্তু মানুষের বিভিন্ন অনুভব তুলে আনা গীটারে ওটা আমার পাতের খাওয়ার না।
এরপরও আমি মাঝে মাঝেই গীটারে সূর তৈরি করতে চাই, আমার নিজের কাছে ভালো লাগে না, হয়তো 10টা চেষ্টা করলে একবার খানিকটা সময় শ্রুতিমধুর কিছু আসে এবং তাও মুহূর্ত খানিকের জন্য, আমার ভয়াবহ গানের গলা নিয়ে আমি এর পরও মাঝে মাঝে গান সুর করার চেষ্টা করি। অবশ্য আমি নিজেকে সুরকার না বলে বলবো আমি রূপকার, আমি কাঠামো বানাতে পারি, একটা কাঠামো দাঁড়া করিয়ে দেওয়ার পর আমি আশা রাখি আমার পরিচিত যেসব মানুষ অনুভবটা তুলে আনতে পারে তাদের বুঝিয়ে বললে তারা গানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।
অবশ্য অনেক চেষ্টা করে গান লেখার বিদ্যা আয়ত্ত্ব করার চেষ্টা করছি। এখনও তেমন সাফল্য আসে নি, আমার কাছে গান লেখা এখনও হাতুড়ি-ছেনি নিয়ে বসার মতো, শব্দের সাথে শব্দের সংঘাত আর মিলমিশ দিয়ে আবেগ ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা, মাঝে মাঝে প্রথম 4টা পংক্তি খুব সুন্দর চলে আসে, সেটা সুর করে ফেলার পরে আসে আসল যন্ত্রনা, এর পরের অংশ খুঁজে পাওয়া।
ইদানিং এসব ঘটায় িরক্ত হয়ে আমি কোনো 4 লাইনের গান সুর করা বাদ দিয়েছি। সুরের সাথে কথা বসিয়ে গান করা আসলে সহজ বেশী। সুরটা আসতে থাকে, সেই সাথে গুনগুন করে কথা আসতে থাকে। তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর ভাব বদলে যায়। বদলে যায় সুর তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে না পারার ব্যার্থতা আবারও সব শেষ করে দেয়।
অংক মেনে কাজ করলে যা হয়। মাথায় সব সময় হিসাব ঘুরতে থাকে আসলে এর পর এইটা আসতে হবে।
যারা নিয়মিত গীটার বাজায় তাদের ব্যাকরন জানা না থাকলে আমার কথা আশ্চর্য লাগবে, তবে বেশীর ভাগ শ্রুতিমধুর গানের ফর্মা খুবই সাধারন
1ম-4র্থ-5ম-1ম। কিংবা 1ম-5ম-4র্থ-6ষ্ঠ-
কিংবা 1ম-6ষ্ঠ,-1ম-4র্থ,( এটামূলত বাংলা লোকগীতির সহজ ফর্মা।
আরও একটা লোকগীতি ফর্মা হচ্ছে
1ম-2য়-5ম-4র্থ
এসবই সাধারন গানের ফর্মা। যারা অভিজ্ঞ তাদের জন্য বিভিন্ন মিক্সড কর্ড আছে, ওসবের ব্যাবহারের পারদর্শিতা আর বাছাই করার জন্য আলাদা একটা কান লাগে।
আমি নিজে বাজানোর সময় মূল সূরের বাইরে যাওয়া পছন্দ করি না, সেই জায়গায় গেলে আর সুর কে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারি না।
তবে প্রতিটা কর্ডের জন্য 16টা কর্ড আছে সার্কেলে।
এখন সার্কেল বলতে যা বুঝায় তা হলো, একটা স্বর- গীটারের কর্ড মনে করা যাক "সি" এখন এই "সি" কর্ডের সাথে খাপ খাবে এমন প্রথম মাত্রার কর্ড আছে 7টা- এর পরে বাকি 9টা মিক্সড কর্ড আছে
গীটারের অংকের সুবিধা হচ্ছে শুধু প্রধান কর্ডগুলোকে আলাদা করে ঘুরালেই নতুন সব প্যাটার্ন পাওয়া যায়।
গীটারের মূল সুর হচ্ছে- এ , বি, সি, ডি , ই, এফ, জি, আর এদের শার্প নোট। ই আর বি এর কোনো শার্প নেই, এই 12টা নোট নিয়ে যেকোনো স্কেল, যাকে আমরা বাংলায় স্বরগম বলি ওটা তৈরি হয়।
প্রতিটা স্কেলে 7টা আলাদা স্বর থাকে। এই 7টা স্বরই প্রথম পর্যায়ের সুর।
একটা মেজর প্যাটার্ন বলি,
সি- এর পরে এই কর্ড সার্কেলে আসে ডি-মাইনর- এর পর আসে ই-মাইনর- এফ- জি- এ-মাইনর, বি মাইনর। ডি মাইনর সেভেন্থ, কিংবা বি-9 এসব 2য় মাত্রার।
এখানে যেকোনো গান শুরু করার পর এই কয়েকটা প্রধান কর্ডই ঘুরে ঘুরে আসবে গানে।
যা বললাম সেটা ঠিক হলে
একটা প্যাটার্ন হবে।
সি- ডি মাইনর- এফ- জি
সি- এ মাইনর- এফ- জি-
সি- এফ- জি- সি
সি- এ মাইনর- ডি মাইনর- এফ
এমন অনেক রকম সংমিশ্রন হয়
যেমন
সি-এ মাইনর- এফ- ডি মাইনর- জি-ই মাইনর-
এসবই আসলে ব্যাকরন থেকে পাওয়া।
যে কেউ চেষ্টা করে দেখতে পারেন তাদের প্রিয় গান নিয়ে- বেশীর ভাগ গানই এই ধাঁচ মেনে চলে। আর যেসব গান চলে না সেসব গাওয়ার দরকার নাই।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



