এটা ছিলো m~Pbv
আমরা একবার ভারতে গিয়েছিলাম সদলবলে, ডিপার্টমেন্ট থেকে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতভ্রমন হাওয়া প্রবল ছিলো, আমার কিছু বন্ধু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক থেকে সার্ক দেশগুলো ভ্রমনে গেলো, ঢাকা মেডিক্যালের বন্ধুরা গেলো ভারত ভ্রমনে, ফার্মেসী, কম্পিউটার সায়েন্স, ভারত যাওয়ার হিরিক পড়ে গেলো। বাঙ্গালীর হুজুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা প্রজন্মের ফ্যাশনদুরস্ত থাকার একটাই উপায় অবশিষ্ট ছিলো, শিক্ষাভ্রমনের কথা বলে দল বেধে ভারত যাওয়া।
প্রস্তাবটা কে কোন কুক্ষণে উত্থাপন করেছিলো মনে নেই এখন, তবে আমার কাছে খবর যখন আসতো সেটা বাসী হয়ে, পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে এমন একটা অবস্থায় আসতো, হয়তো যেই গুটিকয় অভাগা এই বিষয়টা তখনও জানেনা সেই গুটিকয় অভাগার দলের নিয়মিত সদস্য আমি। এবং এই প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার পর ছাত্রদের ভেতরে প্রাণচাঞ্চল্য বাড়লো শতগুন। ওটা টক ওফ দি ডিপার্টমেন্ট পর্যায়ে চলে গেলো কয়েক দিনেই, সবাই এই নিয়ে আলোচনা করছে, সবাই মতবিনিময় করছে, রূট প্ল্যান চলছে, সেখানে কোনো বক্তব্য না থাকা মানে তুমি আন্দামানের অংরসর উপজাতির বংশধর, সভ্যতার ছাপ না লাগা কেউ, যে এখনও নেংটি পড়ে ক্লাশে আসে। আমার নিজের ভ্রমন অনিচ্ছা আর জড়তা, এবং আমার শতেক ব্যাস্ততার মাঝে এসব বিষয়ের আপডেট পেতাম ঠিকই। কোনো রকম নীতিনির্ধারনী সভায় কথা বলার যোগ্যতা নেই তাই আমি নির্বিবাদী শ্রোতা, জনগন যা বলে তাতেই সায় দেওয়া মানুষ, একদল বললো দিল্লি হয়ে কাশ্মির হয়ে দার্জিলিং হয়ে বাংলাদেশ, কোলকাতা থেকে শুরু দার্জিলিংএ এসে শেষ, চমৎকার প্রস্তাব, আমার সায় থাকে, কেউ বললো শুধু দিল্লি আগ্রা, মোঘল সম্রাজ্যের নিশান দেখতে দেখতে যাওয়া, তাদের স্থাপত্যকলা দেখে, অবশেষে কাশ্মির কি কলির গন্ধ শুঁকে ফেরত আসতে হবে।
সিকিম আসাম মেঘালয়ের পক্ষেও কিছু ভোট ছিলো, কিছু ভোট ছিলো কৈরালা তামিল নাড়ুর পক্ষেও, আমি জনগন সবাইকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেই, কাউকেই গুরুত্বপূর্ন মতামত দিয়ে দুঃখিত করতে চাই না। সবার মতেই মত মেলানো এই অলৌকিক ক্ষমতার জন্য অনেকেই ভ্রমন পরিকল্পনার রোমাঞ্চময়তার কথা বলতো। আমি শ্রোতা হিসেবে বেশ চমৎকার। নিজের প্রশংসা নয় এটা, এটা সত্যভাষন।
এই উত্তেজনা- আলোচনার ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে একটা পর্যায়ে সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা ভারত ভ্রমনে যাবেই, এবং এই ঘোষনার পর জেগে উঠলো সংগ্রামী চেতনা মানুষের। বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিখিত একটা বিভেদের প্রাচীর ছিলো আগেই, হলবাসী এবং ঢাকাবাসী বিভেদ।বিভিন্ন উদযাপনে রআগে আগে এই বিভেদটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর জানি না, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভেদটা প্রকাশ্য। হলের ছেলেরা একসাথে আড্ডা দেয়, এক সাথে ক্লাশে ঢুকে, এবং এদের ভেতরের সহমর্মিতা বেশী। ঢাকাবাসিরাও বিভিন্ন ভাবে নিজেদের ভেতরে সম্পর্কের সাঁকো বানিয়েছে, তারাও সরমা, রমনা, হাজী বিভিন্ন উপলক্ষে মিলিত হয় এবং তারাও দলবেঁধে আড্ডা দেয়।
যারা এইচ এস সি করেছে ঢাকায় তারা খানিকটা হলেও ঢাকা ঘেঁষা কারন তাদের কলেজ জীবনের অনেক বন্ধুই এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু যারা বাইরে থেকে এসেছে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠা কঠিন। এই দ্্বন্দ্ব-সন্দেহ- অবিশ্বাস আর সংঘর্ষ নিয়েই জীবন। আমি মফস্বলের ছেলে তবে হলে থাকি নি কখনই তাই আমার সাথে 2 দলেরই চলনসই সম্পর্ক। খুব ঘনিষ্টতা নেই কারো সাথেই। বিভিন্ন ছুটির আগে হলে কাটাই কোনো বন্ধুর রূমে সারা রাত আড্ডা দিয়ে পর দিন বাসা ফিরি টাইপ সম্পর্ক যাকে বলে।
যেহেতু একটা বড় মাপের কাজ হটে যাচ্ছে এটা, আমরা ভারত যাবো, তাই এই উপলক্ষে একটা কমিটি গঠিত হলো। অনেক সদস্যবিশিষ্ট কমিটি, তবে এর কোনো পদেই আমাকে কেউ যোগ্য মনে করে নি, সাধারন সদস্য পদেও আমি ছিলাম না। ফ্লাইংসদস্য বলা যেতে পারে আমাকে। এই সময়ে অশালীন রকমের স্পষ্ট হয়ে উঠলো এই হলবাসী-ঢাকাবাসী বিভেদ। আমাদের হলবাসী বন্ধুরা সভাপতির পদ চায়, পদ চায় অর্থ সম্পাদকের, প্রকাশনার দায়িত্বও তারা চায়, কিংবা সমঅধিকার ভিত্তিক কমিটি চায় সেখানে সকল পদে হলবাসী ও ঢাকাবাসির অনুপাত সমান হবে। বিচ্ছিন্ন মানুষেরা আরও বিচ্ছিন্ন হলো, হলবাসীরা আলাদা স্থানে গিয়ে একটা কমিটির খসরা করে নিয়ে আসলো, ঢাকাবাসিরাও জাহাঙ্গির ভাইয়ের দোকানের সামনে বসে একটা কমিটির খসরা করলো। অবশেষে নিরপেক্ষ সায়েন্স ক্যাফেটেরিয়াতে তাদের সম্মিলিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। আমার মতো ফ্লাইং সদস্যের অংশগ্রহন বাধ্যতামূলক নয় তাই আমি গাঁয়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরছি, বিভিন্ন কথা শুনছি। রাগ দ্্বেষের গল্প শুনছি। এবং ফ্যাকড়া হলো কেউই অন্যের করা কমিটি গ্রহন করতে নারাজ। কোনো রকম সমঝোতা প্রস্তাবে কাজ হবে না। সভাপতির পদ নিয়ে সংঘর্ষ বেধেছে, হলবাসীকে সভাপতি করতে হবে এই ঘোষনার পর ঢাকাবাসী ক্ষেপে বলেছে ঢাকাবাসী সভাপতি না হলে কমিটি কোনো কমিটিই হবে না। বিভিন্ন সম্পাদকমন্ডলির সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকার পেছনা আমার গুরুত্বপূর্ন যুক্তি হইলো সদস্য হওয়া মানেই একটা দায়িত্বের বোঝা চাপা আমি এমন কোনো বোঝা নিতে রাজি না, কিন্তু সবাই কেনো এই বোঝা ঘাড়ে নিতে ইচ্ছুক তাও বুঝতে পারি না। একজন হলেই হয়,ঢাকাবাসি হলেও কোনো ক্ষতি নেই, হলবাসী হলেও কোনো ক্ষতি নেই। পরিসমাপ্তিতে ভারতভ্রমন হলেই হয়।
তবে সমঝোতার কোনো সম্ভবনা তৈরি হচ্ছে না, এমন অবস্থায় সমঝোতা বোর্ড গঠিত হলো। সর্বদলীয় ছাত্রের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ বিবেচিত হলো আশফাক, শনক আর ঢাকাবাসির পক্ষ থেকে ছিলো লুকু সুমন, রুবেল, তমাল।
হলবাসীর পক্ষে ছিলো মাসুম, সিরাজ, মামুন, তুহিন, পলাশ আরও কয়েকজন, 12-13জনের একটা দল ছিলো। তারা কোনো এক বুধবারের দিবাগত রাত্রে আলোচনায় বসবে যেখানে গ্রহনযোগ্য কমিটি প্রস্তাবিত হবে। শনকের দায়িত্ব ছিলো অর্থমন্ত্রির বোধ হয়। বুধবার বিকালে আমাকেও বলা হলো সেই আলোচনায় থাকার জন্য, বেশ উত্তেজক পরিস্থিতি আমিও সায় দিলাম সেই রাতে আমার উপস্থিতি থাকবে। বিকালের পর থেকেই শহীদুল্লাহ হলের পুকুরের পাশে বসে আড্ডা- চা - সিগারেট চলছে, ফজলুল হকের ক্যান্টিনে ভাজাপোড়াও হলো, আমার পকেট থেকে কিছুই যাচ্ছে না তাই আমার জন্য আরও উপভোগ্য এই আড্ডা।
একে একে সবাই হাজির হলো। আশফাক, শনক সুমন লুকু রুবেল তমাল, আমি সবাই মিলে গেলাম মিতালী হোটেলে রাতের খাবারের জন্য, ফাউ খাওয়ার একটা সমস্যা হলো মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যও আসে, তাই বেছে বেছে আমার তরকারিতে বেশ বড় একটা পতঙ্গের আত্মাহুতির স্মৃতি, সেই পোকা ফেলে দিয়ে খেয়ে ফেলতে কোনো সমস্যা ছিলো না, তবে এটা আরও বড় একটা উপলক্ষ্য এনে দিলো, সবাই মোটামুটি খাওয়াটার শেষ পর্যায়ে গিয়ে উঠে ম্যানেজারকে তুমুল ঝাড়ি দিলাম। মিয়ারা কি রান্না করো, বালের রান্না করো এই খানে আয়া, তরকারিতে পোকা থাকে ক্যান, আমাদের হম্বিতম্বির ফল ফললো আমরা রাতের খাবারের বিল না দিয়েই যেতে পারলাম, এই অবসরে কেনা কোলড ড্রিংকসের দামও দিতে হয় নি, একটা ছোটো পোকার আত্মহত্যা রান্নার হাড়িতে আমাদের একবেলা খাওয়ার খরচ কমিয়ে দিলো, পৃথিবীতে কাউকেই তুচ্ছজ্ঞান করতে নেই এই মহান বানীর কার্যকারিতা আবারও প্রমানিত হলো।
অবশেষে আড্ডা দিয়ে, হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে আলোচনার স্থান নির্দিষ্ট হলো প্রাণীবিদ্যাবিভাগের বারান্দা। চমৎকার জায়গা, সামনে টলটলে পুকুর, ওপাশের মামার দোকানের আলো নাচছে পুকুরের পানিতে, আমরা কতিপ যুবক মুখোমুখি ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। হলবাসীর অভিযোগ শোনা হলো প্রথমে, ক্যানো তারা এই বিষয়টা মানতে পারছে না, তাদের যুক্তি শোনার পর, ঢাকাবাসিরাও বক্তব্য দিলো, তাদের প্রস্তাবিত কমিটির সুবিদঃা অসুবিধা নিয়ে আলোচনার পর শনকের বক্তব্য, এর পর আমি একটা মৃদু বক্তিমে দিলাম, পোকা পাওয়ায় আমার খাওয়া তেমন সুবিধার হয় নি, এই ঝাঁঝটা বোধ হয় ছিলো সেই বক্তিমেতে, ফলাফল অসাধারন, সবাই উঠে কোলাকুলি করে মিষ্টিমুখ, এবং আরও একটা সমস্যা হইলো এইবার, দুইদলই অপরপক্ষের কমিটিকে শ্রেষ্ট বলে ঘোষনা দিয়ে ওদের কমিটিকে গ্রহন করতে চায়। বিষম সমস্যার সমাধান হলো মুহূর্তেই, যখন সবাই সমাধান চায় তখন ঐক্যমতে পৌঁছাতে সময় লাগে না। অবেশেষে মাসুমের কেনা এক প্যাকেট মিষ্টির সদব্যাবহার করে ঘুমাতে গেলাম, কিছু ক্ষন আড্ডার পর।
নতুন একটা কমিটি হইলো, এবং ওখানে আমার নাম লিপিবদ্ধ হয় নি। কমিটির সদস্যরা সবাই কিভাবে কিভাবে য্যানো সেই কমিটিটে ঢুকে গেলো।প্রকাশনা,অর্থসম্পাদক, সভাপতি, সহসভাপতি, এমন ভাবে সবাইকেই স্থান দেওয়া হয়েছিলো সেখানে। ওখানেই সিদ্ধান্ত হলো আমাদের মূল অর্থায়ন হলে বিজ্ঞাপনের টাকায়, একটা আনুমানিক হিসাব করা হলো, সেই হিসাবে জনপ্রতি ব্যায় ধরা হলো 9000 টাকা এবং এটা বিজ্ঞাপন দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যাবে, কেউ বিজ্ঞাপন এবং নিজস্ন অর্থায়নেও এই 9000 পুরণ করতে পারে। বাড়তি হলে সেটা ফেরত দেওয়া হবে না, এবং সবার ক্ল্যায়েন্ট ধরার প্রতিভা সমান না, কেউ কেউ 10 হাজারের বিজ্ঞাপন জোগাড় করে ফেললো, কেউ 3000, কেউ 15000, সবাই একজনকে এসে কনফার্ম করে আজ এত টাকার বিজ্ঞাপন এসেছে, বেশ কয়েক দিন সবার আলোচনার প্রধান বিষয় ছিলো বিজ্ঞাপন জোগাড় এবং এই সম্পর্কিত ঝামেলা, বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, প্রায় প্রতিটা উড়োজাহাজে রএজেন্টদের কাছে যাওয়া হয়েছিলো, বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি, পাট কর্পোরেশন, ওয়াপদা, সালমান এফ রহমানের কোম্পানি থেকে শুরু করে আদমব্যাপারি সবার কাছেই মানুষ গিয়েছে, এবং একটা সত্য অবিস্কার হলো বাঙ্গালি ভীষন ঘরকূনো টাইপ প্রজাতি, তারা এমন ভ্রমনের কথা শুনেও হাতের মুঠা আলগা করতে রাজি না, এমন কি তাদের প্রতিষ্ঠানের কথা পুস্তিকাতে ছাপা হবে এমন আশ্বাসের পরও কেউ রাজি হয় না। বিজ্ঞাপনের রেট ছিলো বোধ হয় পুরা পৃষ্টা 15000 ছোটো কলাম 1500, এর দ্্বিগুন 3000, বর্গ ইঞ্চির হিসাব, ঐভাবে কেউ 1500 টাকার বিজ্ঞাপন দেয়, কেউ 3000, তবে সবচেয়ে বেশী এসেছিলো 1500 টাকার বিজ্ঞাপন।
অবশেষে নির্ধারিত সময় শেষ হলো। সবার চেক হাতে আসার পর প্রকাশনার কাজ, অলংকরনের কাজ, এসব কাজের দায়িত্ব ছিলো শমিকের উপর, এবং এর মাঝামাঝি সময়ে শনকের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার বিষয়টা নির্দিষ্ট হলো। তাই সে যেতে পারবে না। সে দায়িত্ব নিয়ে অর্থ সঞ্চালন করবে তবে সে আমাদের সাথে যাবে না। পৃথিবীর নিয়মই এমন, যারা গুরুদায়িত্ব নেয় তাদের কেউই তার শেষ দেখে যেতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



