আজকের রাত বেশ অন্ধকার। আকাশে চাঁদ তারা কিছুই নেই শুধু জমাট বেধে থাকা মেঘ ছাড়া। সরওয়ারের এই রকম রাতে বিদঘুটে যন্ত্রনাবোধ হয় কারন সে আকাশের তারাগুলি দেখতে পারে না। প্রতি রাতে সরওয়ার উঠানে পাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশে তারার দিকে তাকিয়ে থাকে আর তার মায়ের কথা ভাবে। দাদি বলেছে মানুষ মৃত্যুর পর তারা হয়ে যায় আর ঐ দূর আকাশ থেকে তাকিয়ে দেখে তার প্রিয় মানুষটিকে। তাই সরওয়ার প্রতি রাতে নিয়ম করে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে থাকে। সরওার নিজেও জানে না তার মার কাছে সে প্রিয় ছিলো কিনা, প্রিয়ই যদি থাকতো তাহলে তাকে মাত্র ৭ দিনের রেখে কি অভিমানে চলে গেলো না ফেরার দেশে।
সরওয়ারের বয়স এখোন মাত্র ৮ কিন্তু মৃত্যু নিয়ে সে নিজে মত করে একটা ভাবনা গড়ে নিয়েছে । তার কাছে মৃত্যু মানে ঘুম ভাঙ্গা। তার ধারনা মানুষের আসল দেহ ঐ উপরে সপ্ত আসমানে আল্লাহর কাছে ঘুমিয়ে থাকে আর স্বপ্ন দেখে এই দুনিয়ার। দুনিয়াতে যা কিছু হয় সবই স্বপ্নের মধ্যে হয় এইযে যেমন খাওয়া-দাওয়া চলা-ফেরা এমন কি ঘুম পাড়াও। এইটা একটা মজার ব্যপার যে স্বপ্নের মধ্যে আবার আমরা স্বপ্নও দেখি। আর যখন এই দুনিয়াতে মানুষের মৃত্যু হয় আসলে তখন ঐ সপ্ত আসমানের দেহটির ঘুম ভেঙ্গে যায়। আর দুনিয়াতে পড়ে থাকা দেহকে আমরা মৃতদেহ ভেবে মাটির নিচে পুতে রাখি কারন তার আর প্রয়োজন থাকে না । তার এরকম ধারনা হয়েছে স্কুলের ইসলাম শিক্ষা স্যারের কাছ থেকে। স্যার প্রতিদিন ক্লাসে এসে পরকাল নিয়ে কথা বলেন আর তার ঠিক কিছুক্ষন পরেই চেয়ারে বসে হা করে ঘুম পাড়ে।
সরওয়ারের আজ আর উঠানে শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। চারদিকে ঘুট ঘুটে অন্ধকার কিছু দুরে হাসনা-হেনা ফুল গাছের ঝোপের মধ্যে ছোট ছোট আলো জ্বলাছে আর নিভছে।হাসনা-হেনা ফুল গাছটা নাকি তার মা লাগিয়েছিলো তাই অনেক যত্ব করে গাছটি বাচিয়ে রেখেছে সরওয়ার। মামি অনেকবার বাড়ির সামনে ঝোপ হয়ে আছে বলে গাছটি কেটে ফেলতে চে্যেছে কিন্তু প্রতিবারই সরওয়ার বাধা দিয়েছে।আর তার জন্য সরওয়ারকে মারও খেতে হয়েছে।
সরওয়ারের বাবা আবদ্দুর সাত্তার। একজন বদ মেজাজি কৃপন গোছের লোক। বউ পেটানো তার কাছে একটা দায়িত্ব বলে মনে হয়। তার ধারনা বউ না পেটালে বউ কি ঠিক থাকবে?। তার প্রথম বউ সরওয়ারের মা যাকে প্রতিদিনই কিছু না কিছু কারনে পেটাতো। মাথায় লম্বা চুল থাকায় তার চুলই ঘরের খুটির সাথে বেধে মার ধর করতো। হয়তো এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ৭ দিনের কলের বাচ্চা রেখে চলে গেছে মৃত্যুপুরিতে। প্রথম বউয়ের মৃত্যুর ৪৮ দিন পরেই দ্বিতিয় বিয়ে করে আবদ্দুর সাত্তার। সরওয়ার ছোট থাকায় তাকে তার নানা নিয়ে যার নিজের কাছে আর সরওয়ারের বড় দুই ভাই থেকে যায় তার বাবার বাড়িতে । এইভাবেই সে বড় হতে থাকে তার নানার বাড়ি্তে।
সরওয়ারের নানার বয়স হয়েছে অনেক। সংসারের জন্য এখন আর কোন উপার্জন করতে পারে না সে। পরিবারে আছে বউ আর একটা মাত্র ছেলে যাকে বিয়ে দিয়েছে নিজের বোনের মেয়ের সাথে। ভেবেছিলো বোনের মেয়ে নিজের মেয়ের মত হবে, বুড়া কালে দেখে শুনে রাখবে কিন্তু সে আশা আর পূরন হয়নি। সরওয়ারকে বাড়িতে রাখা নিয়ে প্রায়ই দুই কথা শুনতে হয় তাকে।উপার্জন করতে না পারা আর নিজের নামের সব জমি-জমা ছেলের নামে লিখে দেয়াতে তার সিদ্ধান্তের আর কোন মূল্য নেই সংসারে। তার নিজেরই একবেলা খাবার জটে আরেক বেলা জটে না এমন অবস্থাতে সরওয়ারের ভরন-পষোন করবে কিভাবে। এছাড়া সরওয়ারকে স্কুলে যেতে না দিয়ে মাঠে পাঠানো হয় ইদানিং। স্কুলে যেতে চাইলে উল্টা মার ধর করে।
এতো অশান্তি সহ্য করতে না পেরে সরওয়ারের বাবার কাছে যায় তার ছেলেকে তার কাছে রাখার জন্য। কিন্তু সরওয়ারের সৎ মা এতে খুব একটা খুসি হয় না সেটা বুঝতে আর বাকি থাকে না তার। প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যেই সরওয়ার কে রেখে বেরিয়ে পড়ে বাড়ির পথে আর ভাবতে থাকে সংসার এক মায়ার খেলা সম্পদ না থাকলে যেখানে কোন অস্তিত্ব থাকে না কারো কাছে......