বুমকেশ তাহার কক্ষে শয়নপূর্বক সিলিং ফ্যানের পাখা গুনিতেছিল । আলোর উৎস ছিল একখানা টেবিলল্যাম্প । এক দুই তিন গুনিয়া চক্ষু মুদিয়া সে আবার চক্ষু খুলিতে এবং পুর্ববত গণনা কার্যে লিপ্ত হইতে আরম্ভ করিতে লাগিল । রাত্রির বিস্তরণ বাড়িয়া চলিলেও তাহার যেন হুশ ছিল না । যদ্যপি সে তাহার কার্য লইয়া ব্যস্ত রহিয়া গেল । হঠাৎ তাহার মাথায় কি এক চিন্তা খেলা করিতে লাগিল । সে অনুচ্চ কণ্ঠে আবৃতস্বরে বকিতে লাগিল । তাহার কতকটা নিম্নরূপ :
"আমি নেপোলিয়ন হইতে চাহিয়াছিলাম কিন্তু খুন করবার সাহস নাই তাই হইতে পারিলাম না । আপন মনের কোণে খুন লইয়া বাঁচিয়া রহিয়াছি । আমি খুনে নই , নই আজ্ঞাবহ কৃতদাস । স্বাধীনতা আর পরাধীনতা এই দুয়ের মধ্যে আমার বসবাস । পক্ষীকুলের বক্রডানায় অসীমেরে ধরিতে চাহি মনে মনে । বৃত্ত , সেই বৃত্ত আজও আমায় কভু নাহি ছাড়ে ।"
হঠাৎ করিয়া সে যেন তাহার কথার জবাব পাইতে শুরু করিল । সহসা সে শুনিতে পাহিল,
"জন্জালপূর্ণ বৃত্তে ঘুরপাক খাইতে খাইতে সৌন্দর্য খুজিয়া লইবার বাসনা তীব্র হইতে তীব্রতর হয় । বৃত্তে অসীমতা সে আবার কেমন করিয়া হয়? এতো দেখছি পাগলের প্রলাপ ভিন্ন অন্য কিছুই নয় !"
কথাগুলা বুমকেশের নিজ কল্পনাও হইতে পারে । আবার বাস্তবিকই সে দৈবশব্দের শ্রবণ পাইয়াও থাকিতে পারে । বুমকেশ আমার বন্ধু ছিল । বুমকেশের রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর এই ডায়েরীখানা আমার হাতে আসিয়া পড়ে । আমি তাহার কাছের বন্ধু ছিলাম বলিয়া তাহার পরিবার আমায় এই ডায়েরীখানা দিয়া ইহার পাঠোদ্ধার করিয়া বুমকেশকে ফিরিয়া আনার ব্যবস্থা করিতে বলিল । আমি হৃষ্টচিত্তেই ইহার পাঠোদ্ধারে ব্যাতিব্যস্ত হইয়া পড়িলাম । তাহার ডায়েরী হতেই উপরিউক্ত কথামালার সুচনা করিলাম । পাঠকবৃন্দ আমার নিক দেখিয়া সন্দিগ্ধ হইতে পারেন এই ভাবিয়া যে আমিই বুমকেশ । তাই আগেই বলিয়া নিলাম যে আমি বুমকেশ নই । বরং তাহার বন্ধু । বুমকেশের অন্তর্ধান রহস্যের সমাধানে এই ঘটনায় আমার আবির্ভাব ।
যাহাই হউক , এইবার মুল কাহিনীতে ফিরিয়া আসি ।
দৈবসন্দেশ লাভ করিয়া বুমকেশ তড়াক করিয়া লাফিয়া উঠিল । তাহাকে কতকটা ভীত মনে হইতেছিল । তবে ভীতির কাছে কৌতুহল জয়যুক্ত হইয়া তাহার হস্তে লাইটের সুইচ আনিয়া দিল । সুইচ টিপিয়া তের ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালাইয়া বারংবার এদিক ওদিক চাহিয়াও দৈবশব্দের কোন কুলকিনারা করিতে না পারিয়া সে এইবার সত্যসত্যই ভীতির সাগরে নিজেকে আবিষ্কার করিল । কার্তিক মাসের হালকা শীতের রাতে সে যেন মাঘের শৈত্যপ্রবাহের শিকার হইল ।
ক্ষণকাল পর সে মনে একটু সাহসের আগমনবার্তা পাইয়া পুবের জানালাখানা খুলিয়া উঁকি মারিল । ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সামনের রাস্তার অধিকাংশই তাহার দৃষ্টিগোচর হইল । কিন্তু কোন জনপ্রাণির দেখা সে পাইল না । জানালা বন্ধ করিয়া সে বিছানায় আসিয়া বসিল । তাহার কেমন যেন ঘুম পাহিল । কিছুক্ষণ ব্যাপারটা নিয়া চিন্তা ভাবনা করিয়া সে ঘুমাইয়া পড়িল ।