তামান্না আজকে বাস থেকে নামার সময় পড়ে গিয়েছিল। কিছুটা অবশ্য ছিল তার নিজেরই ভুল। তখন পর্যন্ত বাসটি পুরোপুরি থামেনি। যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে নামছিল। বাসের হেলপার হাঁক দিচ্ছিল- ‘আগে বাম পা, আগে বাম পা।’ ঠেলাঠেলিতে সে বাসের পাদানিতে ডান পা রাখার আর সুযোগ পায়নি। রাস্তায় প্রথমে পড়ে তার ডান পা। আর এতে যা ঘটার তাই ঘটলো। একটা মোচড় দিয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়। এই সুযোগে তাকে উঠানোর ছুঁতোয় কয়েক জোড়া পুরুষের হাত তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ স্পর্শ করেছে। বাসের হেলপাররা এ সুযোগটা সবসময়ই নেয়। মেয়েদেরকে বাসে উঠানো বা নামানোর সময় সে গায়ে হাত দিবেই। আজকেও হেলপার নামার সময় তাকে প্রায় ঠেলে দিচ্ছিল। তারা প্রায়শই এমনটা করে থাকে। পিছন থেকে আসা কোনো গাড়ির চাপা খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। তারপরও তাদের এ ব্যাপারে কোনো সচেতনতা নেই। যাত্রীদের প্রতি তাদের বেজায় ক্ষোভ। এক কন্ট্রাক্টরকে সে বলতে শুনেছিল- যারা বাসভাড়া দিয়ে যায়না তারা যেন গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মরে। তামান্নার ক্ষেত্রে অবশ্য তা খাটেনা। কারণ সে সেধে সেধে বাসের ভাড়া দিয়ে আসে। প্রায়ই এমন হয়, কন্ট্রাক্টররা তার কাছে ভাড়া চায়না । এর কারণ এটি নয় যে, সে কোনো সেলেব্রিটি। বাসের কন্ট্রাক্টররা হয়তো ভুলে তাকে এড়িয়ে যায়।
ওভারব্রিজ পার হতে তামান্নার বেশ কষ্ট হয়েছিল। রিকশা পর্যন্ত এসেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রিকশায় উঠে সে আরেকবার পরখ করে সাথে থাকা জিনিসগুলো ঠিকঠাক মতো আছে কিনা! আজকে তার এইচএসসির শেষ পরীক্ষা। সমাজ কল্যাণ দ্বিতীয় পত্র। সে মনে মনে শ্রষ্ঠাকে ধন্যবাদ দেয় এ কারণে যে, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। কারণ সে জানে তাকে টিকে থাকতে হবে। এ টিকে থাকা হচ্ছে ভুলের প্রায়শ্চিতকে পাশ কাটানো এবং জীবন সংগ্রামেও জয়ী হওয়া। সে নিজেই তার জীবনটাকে কণ্টকাকীর্ণ করে ফেলেছে। তবে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অবশ্যই সে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসবে। মেয়েদের মনোবল থাকে অনেক বেশি। আর তামান্না গড়পড়টা মেয়েদের থেকে উন্নত।
তামান্নার হাতে থাকা হ্যান্ডব্যাগে বিপ বিপ আওয়াজ হচ্ছে। সেলফোনটা বের করে দেখে তারেক কল করেছে। কলটা সে আর পিক করেনা। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েই তার সাথে যোগাযোগ করবে। সে চায়না এখন কোনো কারণে তার মনের অশান্তি শুরু হোক। সে তার শারীরিক যন্ত্রণাকেও বশীভূত করে ফেলেছে। এসবই শুধুমাত্র একটা কারণে। যে করেই হোক আজকে তাকে সহি সালামতে পরীক্ষাটা শেষ করতে হবে।
ঘন্টা তিনেক পরে তামান্না হাসিমুখেই কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসে। তাকে বেশ নির্ভার মনে হচ্ছে। তার ইচ্ছা করছে কিছুটা সময় সে নিজের মতো করে কাটাক। তবে সেটা মনে হয় আর সম্ভব হবে না। কারণ তারেক আবার কল করা শুরু করেছে। এবার সে কলটা রিসিভ করে।
‘হ্যালো।’
‘ফোন ধরতেছিলানা ক্যান। বিশ-তিরিশটার উপরে ফোন দিয়া ফালাইছি।’
‘রাগ করোনা। তুমি তো জানো, আমি পরীক্ষা দিতে আসছি।’
‘পরীক্ষার গুল্লি মারি। কাইল রাতে কী বলছিলাম সেইটা মনে আছে!’
‘ আমি তো তখনই জানাইছি সেটা সম্ভব না।’
‘ আল্লার কসম। তাইলে আইজ আর বাসায় আইসোনা ওই জিনিস ছাড়া।’
‘তারেক, তুমি এভাবে বলছ কেন?’ তামান্নার গলা ধরে আসে।
‘এটাই আমার ফাইনাল কথা।’ বলে তারেক লাইনটা কেটে দেয়।
তামান্নার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। একহাতে কপালের দুপাশ চেপে ধরে। অন্যহাতে একটা রিকশা ইশারা করে।
তামান্না এসেছে মারওয়া ফুডশপে। নিঃশব্দে কর্ণারের একটা টেবিলে গিয়ে বসে। তাকে আগে কিছু খেতে হবে। এখানে বসেই সে নস্টালজিয়ায় ডুবে যায়। এটা সে জায়গা যেখানে সে তারেকের সাথে প্রথম এসেছিল। সেদিনকার আবেগ আর আজকের আবেগের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তার বাবার বাড়ি এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেদিন সে এই ফুডশপ থেকে ওই বাড়িতে ফিরে যেতে পেরেছিল। কিন্তু আজ আর তা সম্ভব নয়। কারণ গত তিনমাসে তার জীবনের পট পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। তারেকের হাত ধরে সে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সেখানে তার গমন নিষিদ্ধ। অদৃশ্য কাঁটাতারের প্রাচীর ইতোমধ্যে তোলা হয়েছে। সেই প্রাচীর টপকে আপনজনদের কাছে যাবার আর কোনো উপায় নেই। তার বর্তমান দুরবস্থা নিয়ে তারা হয়তোবা জানে। কিন্তু তামান্না আত্মসম্মানবোধহীন কোনো মেয়ে নয়। সে তার পরিবারের কাছে মাথা উঁচু করেই যাবে। সে তার জীবনটাকে গড়বে।
মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হবে। জীবনের প্রারম্ভেই সে একটা ভুল করে ফেলেছে। একটা হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু সে অবশ্যই সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তার একটা ধাপ আজকে সে অতিক্রম করতে পেরেছে। বাকি ধাপগুলোও সে ভালোভাবে উৎরাতে পারবে। তামান্না আত্মবিশ্বাসী মেয়ে। শুধুমাত্র সময়টাকে কোনোমতে পার হতে দেয়া। আর দাঁতে দাঁত চেপে কিছু লাঞ্ছনা-গঞ্জনা কিছু নির্য়াতন সহ্য করে যাওয়া। তামন্না টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে। একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে নেয়। এতে কিছুটা চলন শক্তি ফিরে পায়। কিন্তু তারেকের কাছে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।
এছাড়া সে আর কোথায় যেতে পারে! তার আপন বাড়ি বলতে তো এখন সেটিই। না চাইলেও সেখানেই তাকে ফিরে যেতে হবে। গত তিনটা মাস সে নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যুদ্ধ করেছে কিছু হীনমনা মানুষের সাথে, একজন আপনজনের সাথে। তথাপি নিজের সাথেও। মানবজীবন যে কী অসহনীয় নির্মম হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সে।
তারেকের বাসা মানে তার শ্বশুরবাড়ি টঙ্গীতে। বিয়ের পর সে ওখানে গিয়ে খুব হতাশ হয়েছিল। কারণ সে অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। অন্ধ প্রেম, অন্ধ আবেগের মোহে সে অবুঝ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের আগের আবেগটা কী আর এখন আছে? তামান্না অনুধাবনের চেষ্টা করে। মেয়েদের আবেগ দীর্ঘস্থায়ী। তিনমাসে অনেকটা কমেছে। কিন্তু সবটা নিশ্চিহ্ণ হয়নি। পুরোপুরি বিলুপ্ত যে দিন হবে সে দিনটির জন্য অপেক্ষা। সেদিন তাকে কেউ ডেকেও ফেরাতে পারবে না। আর ততদিনে সে যদি কিছু যোগ্যতা অর্জন করে ফেলতে পারে।
পায়ের ব্যথাটা আবার মোচড় দিয়ে উঠেছে। বাস থেকে নামতে গিয়ে সে টের পায়। ভাবছে, বাসায় গিয়ে গোসলটা সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিবে। কারণ স্যান্ডউইচে তার পুরোপুরি ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়নি। তারপর একটা ঘুম দিবে। বিগত একটা মাস সে সকল প্রকার গালি-গালাজ, অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে মনোযোগটা ঠিক রেখেছে। একাগ্রচিত্তে পড়াশুনা করার চেষ্টা করেছে। তার মনটা লড়াই করে করে এখন বড়ই ক্লান্ত। তাকে কিছুটা বিশ্রাম দিতে হবে।
সদর দরজায় নক করা মাত্র তারেকই দরজা খুলে দেয়। তার অগ্নিমূর্তি দেখে তামান্না ভীত। রক্ত লাল জবাফুলের মতো চোখের দিকে সে তাকাতে পারছে না।
‘বেশ্যা মাগী! এত দেরি করলি যে?’
‘দেরি কই করলাম। পরীক্ষা শেষ করে সাথে সাথেই তো রওনা হলাম।’
‘টাকা আনিসনি!’
‘ওইতো! ওইটা আনতে যেটুক সময় লেগেছে।’
তামান্নার গলা শুকিয়ে কাঠ। সে তাড়াতাড়ি তারেককে পাশ কাটিয়ে এসে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খায়। ভাবছে, আজকের ঝড়টা কীভাবে সামাল দিবে! সে চাচ্ছে কিছুটা সময় নিতে। যার দরুণ সে রান্নাঘরে চলে আসে। সকালের ভাত তরকারি যা ছিল তা একপ্লেটে নিয়ে তাদের শোবার ঘরের বিছানায় এসে খেতে বসে। দু’ তিন লোকমা মুখে দিতে পেরেছে। তারেক কিন্তু তার পিছু ছাড়েনি। তামান্নার কাছে এসে উপস্থিত। তার হ্যান্ডব্যাগটার উপর হামলে পড়ে তন্নতন্ন করে কিছু খুঁজছে।
‘কিরে! টাকা কই রাখছিস!’
‘তুমি খাবার খাইছ!’
‘তোরে যা জিগাইছি তার উত্তর দে।’
‘টাকা কোথায় পাবো, বাবার কাছে টাকা চাওয়ার কী আর মুখ আছে?’
মুখে খাবার নিয়ে তামান্না হাসার চেষ্টা করে। তারেককে আর্দ্র করতে চায়। তারেক তার মুখভর্তি খাবার নিয়ে বলা কথা বা তার আবেগটা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিল কী-না সন্দেহ থেকে যায়। কিন্তু একটুকু অবশ্যই বুঝতে পেরেছে তামান্না তার দাবিকৃত অর্থ আনতে ব্যর্থ হয়েছে। তারেক অতটা নির্মম হয়নি। তামান্নাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার জন্য দীর্ঘ সময়টুকুও নেয়নি। যতটা সম্ভব কম সময়ে, চুপিসারে এবং তামান্নাকেও যতটা কম কষ্ট দিয়ে তার ক্রোধকে প্রশমিত করতে পারে। তামান্নার পরিহিত ওড়না দিয়েই সে ঘটনা সম্পাদন করে ফেলেছে। বিছানায় তামান্নার নিথর দেহ পড়ে আছে। আর তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে খাদ্যকণা। এগুলো হয়তো তামান্না তারেকের জন্যই রেখে গেছে। যে শক্তিটুকু সে ক্ষয় করেছে তা যেন পুষিয়ে নিতে পারে।
তানিম যুবায়ের