(ফোটো- গুগুল)
বাঁশের গিঁঠ ফাটে ফটাস ফটাস শব্দে। পানি ঢালতে গেলে হরমুজ আলি আর তার সঙ্গের লোকজন বাধা দেয়। কেউ কেউ পানিভর্তি বালতি টেনে ফেলে দেয়। কেউ বা ভেঙে ফেলে পানিভর্তি কলস। সেদিন হরমুজ আলির লাগানো আগুনে এবং আগুন নেভাতে বাধা দেবার কারণে চোখের সামনে পুড়ে গিয়েছিল রিয়াজুদ্দিন মাস্টারের বসত বাড়ি। সে সঙ্গে পুড়ে গিয়েছিল তার শিক্ষা জীবনের সকল অর্জন।
টিভি সংবাদে যুদ্ধাপরাধী মীর কাছিম আলীর ফাঁসি কার্যকরের সংবাদ দেখে আবেগে কেঁদে ফেলেন রিয়াজুদ্দিন মাস্টার। চোখ মুছতে মুছতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা ভাবেন। আর ভাবেন, মোটে অল্প কয়েকজনের ফাঁসি হলে কী আর হবে। জাতি কি আর পুরোপুরি মুক্ত হতে পারছে যুদ্ধাপরাধীদের হাত থেকে? তালিকাভুক্ত অল্প কয়েকটি রাজাকার-আলবদরের বিচার হলেও তালিকার বাইরে থেকে যাবে আরো হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধী। তাদের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক লক্ষ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও তো আছে। আছে আরো কয়েক লক্ষ ছুপা রাজাকার। সময় সুযোগে যারা মুক্তিযুদ্ধকে তাচ্ছিল্য করবার নানা ফন্দি খোঁজে। যাদের দাপটে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা হয়ে আছে স্বাধীনতার কয়েক বছর পর থেকেই।
জেলগেট দিয়ে মীর কাছিম আলীর মরদেহ বের করে নিয়ে যাবার দৃশ্য দেখে রিয়াজুদ্দিন মাস্টারের মনে পড়ে যায়, তার ভাই এজাজুদ্দিন গোপনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবার সংবাদ কোনোভাবে হরমুজ আলি আর তার লোকজনের কানে পৌঁছে গিয়েছিল। আবার এও হতে পারে যে, এজাজুদ্দিনকে গ্রামে দেখতে না পেয়ে ব্যাপারটা অনুমান করে নিয়েছিল। তারপর দিনে দিনে নানা প্রশ্নের জালে ফেলে নির্যাতনের সাহস অর্জন করে নিয়েছিল হরমুজ আলিরা।
ভাগ্য ভালো রিয়াজুদ্দিন মাস্টারের স্ত্রী আয়েশা বাড়িতে ছিল না বলে বেঁচে গিয়েছিল সেদিন। তারপর থেকেই গ্রামের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছিল আর হরমুজ আলিদের আস্ফালন বেড়ে যাচ্ছিল দেখে আগেভাগেই নারীমন হয়তো আঁচ করতে পেরেছিল আসন্ন বিপদ। ঘরের টাকা-পয়সা আর গয়নাগাটি নিয়ে বাতাকাশী বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল।
শ্মশানের মতো দেখতে আগুনে পোড়া বসত ভিটা সহ্য হচ্ছিল না রিয়াজুদ্দিন মাস্টারের। একদিন রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন ছোটভাই এজাজুদ্দিনের সঙ্গে। তার দিন পনের পরেই হরমুজ আলিদের হাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন তাদের মহম্মদপুর গ্রাম। এখন তিনি বেশ বুঝতে পারেন যে, সাহস করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেই হয়। শত্রু যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাদের কোনো না কোনো অক্ষমতা আর দুর্বলতা থাকেই।
সংবাদ শুনতে শুনতে আর গণমানুষের প্রতিক্রিয়া দেখতে দেখতে ফের চোখ মোছেন রিয়াজুদ্দিন মাস্টার। পত্রিকায় পড়েছেন যে, কাদিরা মোল্লার কবরে লেখা আছে শহিদ। কিন্তু রুমী, আলতাফ মাহমুদ, আঃ রউফ, এমন হাজারো শহিদের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের কোনো পার্থক্য থাকে না তাহলে। সঠিক সময়ে সঠিক ইতিহাস রচিত না হলে, একশ বছর পরের প্রজন্ম হয়তো বঙ্গবন্ধু আর গোলামজমের কৃতকর্মে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবে না। এই কি আমাদের জাতীয় মূল্যবোধ? এই কি আমাদের দেশপ্রেম? তার ইচ্ছে হয়, একছুটে শাহবাগ চলে যেতে। গণজাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়, শোনো বীর বাঙালি, আমার একটাই দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের কবরে তাদের নামের আগে যুদ্ধাপরাধী কথাটা যেন সরকারীভাবে লাল রঙ দিয়ে লেখা থাকে। আগামী প্রজন্ম যাতে মুক্তিযোদ্ধা আর যুদ্ধাপরাধীদের কবর চিনতে ভুল না করে।
রিয়াজুদ্দিন মাস্টার খুব অস্থির বোধ করছিলেন। তার মনে পড়ে যে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মৃতদেহের ওপর বিক্ষুব্ধ জনতা থুতু আর জুতো ছুঁড়ে মেরেছিল। এখনও তার তেমনই কিছু একটা করবার রূঢ় ইচ্ছে জেগে ওঠে কাছিম আলীর ক্ষেত্রেও। হৃদয়ে চেপে রাখা ঘৃণা প্রকাশ হবার উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে এক সময় তা প্রবল আক্রোশে রুপান্তরিত হয়। এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে, সেবার মুখোমুখি যুদ্ধে হরমুজ আলি আর তার দলের লোকেরা যখন সবাই মারা পড়ে, গ্রামের বিক্ষুব্ধ জনতা আরো লাঞ্ছিত করেছিল তাদের। মৃত হরমুজের গলায় দড়ি বেঁধে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে খালপাড়ে নিয়ে যাবার সময় মেয়েরা ঝাঁটা হাতে দাঁড়িয়েছিল দু পাশে। একটিবার হলেও লাশের গায়ে ঝাঁটা দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করেছিল তারা। জনরোষ থামানো যাচ্ছিল না কোনো ভাবেই। লাশগুলোকে একে একে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল খালের পানিতে। গ্রামের কোথাও তাদের কবরের জায়গা হয়নি। কেউ তাদের জন্যে কবর খুঁড়তে সম্মত হয়নি। তাদের নিকটজনকে কোনো কবর খুঁড়তেও দেয়নি। আর এভাবেই একটি গ্রামের নাম লেখা হতে পারতো ইতিহাসের পাতায়, যে গ্রামে কোনো যুদ্ধাপরাধীর কবর নেই।
রিয়াজুদ্দিন মাস্টার যা জানতে বা যে সংবাদটি শুনতে এতদিন অপেক্ষা করে ছিলেন আর বিশেষ করে আজ টিভি খুলে সংবাদ প্রবাহ শুনবার জন্য যতটা আগ্রহ নিয়ে বসেছিলেন, তা শোনা হয়ে গেছে। এখন আর কিছু শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মুহূর্তে তার মন ছুটে গিয়েছিল মহম্মদপুর গ্রামে। যেখানে তার বাল্যবন্ধু ও সহযোদ্ধা কৃষক আলতাফ মিয়া এখনো মনে মনে লালন করেন যে, একদিন বাংলাদেশ রাজাকারমুক্ত হবে। যুদ্ধাপরাধী আর ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার হবে।
তিনি নিজেও বিশ্বাস করেন যে, এদেশের মানুষ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আর কোনো রকম আত্মীয়তার বন্ধনে জড়াতে একদিন লজ্জা বোধ করবে। দেশের শত্রু এসব অপগণ্ডদের সহায়-সম্পদ জমা হবে মুক্তিযোদ্ধা-তহবিলে। যেখান থেকে সার্বিক সুবিধা পাবে হতাহত মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরবর্তী সাত প্রজন্ম।
বন্ধু আলতাফের বিশ্বাস, যারা একসময় নিম্নবর্গের যোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হতো উচ্চপদের সামরিক অফিসারদের কাছে, তাদের কারো ভাগ্যে জোটেনি বীরশ্রেষ্ঠ বা বীরবিক্রম উপাধি। আলতাফের জিজ্ঞাসা, তারা পাকিস্তান মেলিটারির চাকরি করে নাই বইল্যা?
রিয়াজুদ্দিন মাস্টার কেন, আরো অনেকেই আলতাফের সে জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব দিতে পারেনি। আর কেউ কোনোদিন পারবে এমন কোনো সম্ভাবনা তিনি নিজেও দেখতে পান না।
আলতাফের কথা মনে পড়তেই তিনি সেল ফোনটা খুঁজতে থাকেন। কিন্তু হাতের কাছে পান না। এদিক ওদিক তাকিয়েও দেখতে পান না। এক ধরনের উত্তেজনা বোধ থেকে সিগারেটের জন্য পকেট হাতড়াতে থাকেন। ঠিক তখনই মোবাইল সেটের রিংটোন বাজতে আরম্ভ করলে টেবিলের ওপর পত্রিকাটার নিচে সেটার ডিসপ্লে জ্বলে উঠতে দেখেন। পত্রিকাটা সরিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখতে পান আলতাফ মিয়ার নামটি ঝলমল করছে।
কল রিসিভ করতেই তিনি আলতাফ মিয়ার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শুনতে পান, মাস্টার, আরেকটা হাইওয়ান কমলো!
- এত রাইতে ফোন দিছ, ঘুমাও নাই?
- তুমিও তো ঘুমাও নাই। মরলে তো কত লক্ষ বছর ঘুমামু তার ঠিক নাই। খবরটা দেখনের লাইগা বইয়া আছিলাম।
- খুশি হইছ তুমি?
- মোট্টেও না। আরো যে হাজার হাজার হাইওয়ান বাইচ্যা আছে!
- এখন অল্প কইরাই খুশি হও। যেখানে এক ব্যাটায় সবগুলারে মুক্ত কইরা দিছিল, এমন বিচার-আচার যে হইব এইটাই তো কল্পনায় আছিল না। শুরু যখন হইছে, আজ হোক কাইল হোক সব বিচারই হইব। যেই শুরুটা দরকার আছিল, সেইটা তো হইছে। এখন যুগটা এমন যে, কারো কোনো কীর্তি আর লুকাইয়া রাখা সম্ভব না।
- এইটা একটা খাঁটি কথা কইছ মাস্টার। এখন মরলেও একটা মনের বুঝ নিয়া কবরে যাইতে পারমু যে, বিচারের শুরুটা দেইখ্যা গেলাম। নাকি কও মাস্টার?
- ঠিক। শুরু হইছে। আস্তে-ধীরে হইলেও বিচারের কাজটা চলতাছে। কোনো একদিন হয়তো কমপ্লিট হইবো। আমরা না থাকলেও কাজটা শেষ করবো আমাগো নাতি-পুতিরা। নিজের রক্তে বিশ্বাস রাইখো দোস্তো!
রিয়াজুদ্দিন মাস্টার আলতাফ মিয়ার মনের অবস্থাটা নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারেন। সে সঙ্গে অনুমান করতে পারেন স্বাধীন-বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বাকি মানুষদের মনের অবস্থাও।
ফোন রেখে দিতেই ছেলের বউ রিয়া দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলে, এক কাপ কফি দিবো, আব্বা?
রিয়াজুদ্দিন মাস্টার সোৎসাহে বলে ওঠেন, নারে মা, এক কাপে হবে না। পুরো এক মগ লাগবে!
- বেশি খেলে কি ঘুমটা ভালো হবে আব্বা?
- আরে মেয়ে, ঘুমানোর সময় পাওয়া যাবে, কফির মজাটা পরে আর পাবো না!
রিয়াজুদ্দিন মাস্টারের উজ্জ্বল মুখ আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কফির মগে চুমুক দিয়েই স্থান-কাল ভুলে গিয়ে বারান্দায় যাবার বদলে ঘরের ভেতরই সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে আরম্ভ করেন।
কফিতে চুমুক দিয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রিয়াজুদ্দিন মাস্টার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, আগামীকাল সকাল সকাল উঠেই গ্রামে চলে যাবেন। আলতাফের সঙ্গে কাটাবেন পুরো সপ্তাহ। না কোনো ওষুধ, না কোনো বার্ধক্যের শৃঙ্খলা। নিজেদের মতো করে সময় কাটাবেন দুজনে। সেই দুঃসময়ে, উনিশ-শ একাত্তরের রণাঙ্গনে যেভাবে সময় কাটাতেন নিজেদের মতো করে।
ভাবতে ভাবতে রাত বাড়ে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল থাকে না তার। ছেলেটা নিজে শুয়ে পড়বার আগে বাবাকে ঘুমিয়ে পড়বার তাগাদা দিয়ে গেছে তাও অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়তেই আরেকটা ভাবনা এসে তার মন খারাপ করে দিয়ে যায়। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, যুদ্ধাপরাধীরা এতটা সঙ্ঘবদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধারা কেন নয়? কত অভাবী মুক্তিযোদ্ধা এখনো রিকশা চালায়, ভিক্ষা করে। কেউ বা মজুরি করে। তাদের স্ত্রী-সন্তানরা অনেকেই আজ সুবিধা বঞ্চিত। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ভেতর এমন কোনো করুণ দৃশ্য নেই কেন?
রিয়াজুদ্দিন মাস্টার আলো নিভিয়ে দিয়ে দুচোখ বন্ধ করলেও আরো হাজার হাজার প্রশ্ন বোধক চিহ্ন তার ভাবনার দেয়ালে মাথা কুটতে থাকে। এলোমেলো করে দিতে থাকে তার ঘুমানোর যাবতীয় প্রস্তুতিকে। অসহায়ের মতো অন্ধকার ঘরে ছাদের দিকে এক ঠায় তাকিয়ে থাকেন তিনি। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পান না। হয়তো সে চেষ্টাও করেন না।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:২৬