somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গপসপ ব্যাডা না বেডি

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকে রাখে গফুর পাগলা। কোথাও হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছিল সে। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়ায়। বলি, ঘোমটার তলে আর কতদিন থাকবি?

দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে সে বলে, যদ্দিন বাইচ্চা থাকি।

ডিসেম্বরের ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকলেও গফুরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যায়। অবাক হয়ে বলি, তর কপাল ঘামায় ক্যান?

- গরম লাগে। হুদ্দা গরম!
- ল যাই, গাছের নিচে যাইয়া বই।
- ল যাই।
গাছের ছায়ায় গিয়ে বসতেই গফুর কপালের ঘাম মোছে। তারপর একটি বিড়ি জ্বালিয়ে ফুকফুক করে টানে। ঠিক তখনই একজন হাটুরে মাথায় করে টমেটোর ঝাকা নিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার উদ্দেশ্যে বলে, টুকরিডা ধরবেন?
আমি উঠে তার ঝাকা ধরে নামাতে সাহায্য করি।

ঝাকা নামিয়ে লোকটি ঘাড় গলা আর মুখের ঘাম মোছে। আক্ষেপের স্বরে বলে, এই সময় কি এত গরম লাগে? আগের জামানায় এমন আছিলো না।

অনুমান করি লোকটির বয়স আমার কাছাকাছি। পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন। চুলদাঁড়ি ধবধবে সাদা। শক্তপোক্ত শরীরের গড়ন। আজ শনিবার। ইলিয়টগঞ্জের হাটবার। তাকে আমাদের আশপাশের এলাকায় কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তা ছাড়া আজকাল আমাদের এলাকার রাস্তায় রিকশা, ভ্যান, সিএনজি অটোরিকশা বেশ চলাচল করে। ইচ্ছে করলে তেমন কোনো বাহনে করেই বমাল যেতে পারতো লোকটি। হয়তো খরচ বাঁচাতে বা কাছাকাছি কোথাও যাবে।

গফুর হঠাৎ বলে ওঠে, স্বামীর সামনে ঘোমটা না থাকলে গোনা হয়।
আমি আরো অবাক হয়ে বলি, এই কথা পাইলি কই? স্বামীতো কাছের মানুষ, মনের মানুষ। আরও কইলে ভালোবাসার মানুষ, আদরের মানুষ। তার সামনে আবার ঘোমটা কিয়ের?

- আমার দাদি-নানি, মা-খালা-চাচি-জেডিগোরে দেখছি, মাথার ঘোমটা পড়ে নাই কোনো সমে।
- তা না হয় বুঝলাম, তারা মাইয়া মানুষ, কিন্তু তর স্বামী মানে তো হেই স্বামি না। এই স্বামী মানে মালিক। আল্লায় আমাগোও মালিক। আর জামাই অর্থে যদি কস তাইলে মা খালা চাচিগো কি দুইডা জামাই? সমাজ শরিয়ত কি এইডা মানবে?

- এত কিছু বুঝি না। আল্লায় আমার স্বামী। আমি তার মাগ। এইডাই সত্য জানি!
- আল্লায় যে পুরুষ এইডা কে কইলো তোমারে?
লোকটি হঠাৎ করেই আমাদের কথার মাঝে ঢুকে পড়ে।

আমি কিছু বলবার আগেই গফুর বলতে থাকে, আদম সুরতের কথা হুন নাই? ফিরিস্তারা আদমের নকশা কই পাইল? নাকি আল্লায় কইয়া দিছিল যে এমনে এমনে বানাইস? তাগোরে কইছে অমুক অমুক জাগা থাইক্যা মাটি আইন্যা আদম বানা। তারা বানাইছে। সামনে যেমন দেখছে তেমনই বানাইছে।

- যদি এর উলটা হয়?
- উলটা কেমুন?
- আল্লায় যদি নারী হন, তাইলে?
- তবা! তবা! আস্তাকুরুল্লা!

আমি তো মনে মনে শিউরে উঠি। আল্লাহকে নিয়ে বিতর্ক আছে জানি, কিন্তু এমন অদ্ভুত কথা জীবনেও শুনিনাই।
কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে গফুর। বার কয়েক চোখ পিটপিট করে বলে, ব্যাডা না হইলে আগে আদম বানাইল ক্যান?
- আল্লায় পুরুষ হইলে তো আগে নারী বানানের কথা আছিলো। নারী না বানাইয়া বানাইলেন আদম। তাইলে হাওয়ারে ক্যান মাটি দিয়া বানায় নাই? আল্লার জাত পাক। তার লাইগ্যা হাওয়ারে বানাইলেন আদমের ছায়া থাইক্যা। কেউ কয় হাড্ডি থাইক্যা। বউ জামাই দুইজনেই মাটির হইলে সমিস্যা কী আছিলো?

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। সত্যিই তো দুইজনেই মাটির হইলে কী এমন সমস্যা হইতো?

- অই বুইড়া ক্যাডায় তুই, কোন গ্যারামের? হাচা কইরা কইবি।
হঠাৎ করেই যেন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে গফুর।

লোকটি হেসে বলে, আমি এদিকের কোনও গ্যারামের না। তয় বাপ মা আমার নাম রাখছে উজান।
- ব্যাডা, ফাইজলামি করস? উজান ভাটা আছে পানির, মানষ্যের নাম কেমতে হয়?

- আলুর নাম যদি মূলা রাখতো আর জাম্বুরার নাম রাখতো জিলাবি, তাইলেও সমিস্যা আছিলো না। এই সমস্যা করি আমরা মানুষেরা। আদম হাওয়ার জাত। ইবার মাথা ঠাণ্ডা কইরা হুনো, আদম হাওয়া দুইজন দুই কিসিমের জিনিস দিয়া কেন তৈয়ার হইল? তার পিছে ঘটনা তো একটা আছে, নাকি নাই? আছে। না থাইক্যা পারে না।

- তা হইতেই পারে। উচা নিচা জাতের ফারাক।
বলে, মিট মিট করে হাসে গফুর।

উজান বলে, তুমি কি জান আল্লার অনেক গুণ মানুষের মইধ্যেও আছে? আছে না? একটা গুণ হইল, বউরা তার সোয়ামীরে ছোট জাতের মনে করে। বউর মনে করে যেই সোয়ামীর লগে ঘর করে, তার চাইয়া আরও উচা জাতের ভালা সোয়ামী পাইতো। কোনো একটা ভুলের কারণে তারা এই সোয়ামীর ঘর করতাছে। এইডা ক্যান হইল? আল্লা পাক জাতের অহংকার তানি মাটির তৈয়ারি না। এই অহংকার পাইছে নারীরা।

গফুর মাথা দুলিয়ে বলে, এইডা নাইলে ঠিক হইলেও হইতে পারে। কিন্তু মা চাচিগো মুখে হুনছি, আল্লায় ব্যাডা দেইখ্যা বেডিগো দুখ বুঝে না। আবার হুজুররা কয় আল্লায় ব্যাডাও না বেডিও না, এমনকি হিজরাও না, তাইলে?

এবার আমি বলি, আল্লা তো নুরের তৈয়ারি।

- তার লাইগ্যাই তো হাওয়ারে মাটি দিয়া বানায় নাই। হুদাই কি কইতাছি আল্লায় নারী। হইতে পারে যুবতী। দেখ আমারে দিলো মার প্যাটে। প্যাটের ভিত্রে খাওনের ব্যবস্থা হইল। আবার মাটিতে পইড়াই খাওনের ব্যবস্থা রাখলেন মায়ের শইল্যেই। বাপের শইল্যে খাওনের ব্যবস্থা রাখতে পার তো না? আল্লায় পুরুষ হইলে ঠিকই এই ব্যবস্থা করতেন।

- আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতাছি না।
উজানকে লক্ষ্য করে বলি।

আমার দিকে তাকিয়ে সে আবার বলে, দেইখ্যা তো লাগে পড়াল্যাহা জানা মানুষ। তাইলে কও, মায়ের পায়ের তলে ক্যান সন্তানের বেহেস্ত? বাপের পায়ের তলে না ক্যান? আবার ইস্তিরির বেহেস্ত সোয়ামীর পায়ের তলে। সোয়ামীর পায়ের তলে ক্যান? মার পায়ের তলেই তো ঠিক আছিল। নাকি? তানি নারী বইল্যা পুরুষ বানাইয়া তার আশেক হইছেন। এই জাগায় নিজে ইচ্ছা নারীর উপ্রে চাপাইলেন না? আবার দেখ দশমাস দশদিন প্যাটের মইধ্যে সন্তানের বোঝা বওনের শক্তি দিয়া দিলেন। এক জাতের পাখি আছে, মায় ডিম পাড়ে বাপে ডিমে তাও দিয়া বাচ্চা ফুটায়। দেশটা বরফের দেশ। সেইখানে মায়েরে আরামে থাকনের ব্যবস্থা কইরা দিলেন। আল্লায় পুরুষ হইলে এইটা করতো? তোমরাই ভাইব্যা দেখ। একটা ইট প্যাটের লগে বাইন্ধা রাইখ্যা কয়দিন সব কাজ ঠিক রাখতে পারবা? কিন্তু মায়ে পারে। আল্লায় পুরুষ হইলে মায়্রেরে এত সাহস, ধৈর্য আর শক্তি দিতো। বাডা আল্লার না বেডিগো লগে দুশমনি। মা চাচিরা কয়।

আমার ভাবনা চিন্তা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। ভাবনার এত ভার নিতে পারছিলাম না যেন। তখনই হঠাৎ চেচিয়ে উঠে গফুর বলে, তোমারে দেহি ভালামতনই শয়তানে পাইছে। অনেক হাজার বছর আগে দুই বেডিতে মিল্যা বাচ্চা পয়দা করতে পারতো। এক শিক্ষিত মানষ্যের মুখে হুনছিলাম। অখন নারী পুরুষে মিল্যা যেমন বাচ্চা হয় তেমনই দুই বেডিতে বিয়া হইত। তখন দুনিয়া ভরা মাইয়াই পয়দা হইত। মাইয়ারাই চাষবাস সব করতো। এইটাও কিন্তু আল্লার একটা ক্ষমতা। যেইটা তানি নারী বা বেডি বইল্যাই হাওয়ার জাতেরে সম্মান করলেন। কিন্তু দুই ব্যাডায় বা দুই পুরুষে মিল্যা বাচ্চা পয়দা করনের ক্ষমতা পুরুষরে দেন নাই। ঠিক কইলাম না বেঠিক কইলাম?
আমি আর ভাবতে পারছিলাম না। ব্যাপারটা প্রথমে গুরুত্ব না দিয়ে ভুলই করেছি মনে হচ্ছে। আমি কিছু বলার আগেই গফুর বিড়ি ধরিয়ে ঘন ঘন ধোঁয়া টানে আর ছাড়ে। কিন্তু কিছু বলে না।

উজান ফের বলে, কইবা ক্যাম্নে? এই মাথা কি তোমাগো আছে? এই দুনিয়াতেই দ্যাহ না, যেই দ্যাশে মাইয়াগো ইজ্জত নাই কদর নাই, হেই দেশের উন্নতি নাই। দেশের কথা কী আর কমু, যেই যেই ঘরের বউ মাইয়া কষ্ট পায় হেই ঘর উজায় না। আরেকটা মজার কথা হইল যে, যেই ব্যাটায় বউয়ের আঞ্চল ধইরা থাকে, বউয়ের কথায় নড়ে চড়ে হেই হালায় ভালাই থাকে।

- ঠিক ঠিক!
গফুর বিড়িতে শেষ টান দিয়ে ফের বলে, মাইগ্যা সবুর ট্যাকাপয়সার অভাব নাই। জমি জিরাত দলানের কমতি নাই। পোলাপাইন সব বিদ্বান।

- এইবার বুইঝ্যা দেখ আল্লায় ব্যাডা না বেডি।

বলেই উজান উঠে পড়ে আমাকে ইশারা করে তার মাথায় টমেটোর ঝাকা তুলে দিতে। আমিও তাই করি।

ঝাকা মাথায় সে গফুরকে বলে, কথস আরও আছে। কিন্তু আমার টাইম নাই।

গফুর বলে, আমি আর হুনমু না। মাথাডা কেমন জানি আউলাইয়া যাইতাছে।

বলতে বলতে, হঠাৎ পি পি ভুউউউউউ শব্দ করতে করতে পাখির ডানার মতো দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষেতের আইল ধরে ছুটতে থাকে সে।
আমি কি করবো বুঝতে পারি না। উজানের কথাগুলো ঠিক না গোঁজামিল তাও যেন আমার বোধের বাইরেই থেকে যায়। আশপাশে দৃষ্টি ঘোরালেও গফুর কিংবা উজান কারও দেখা পাই না।

১৫.১২.২০১৯
কারবালা।


সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:১৬
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×