ইয়ো প্রজন্মঃ গন্তব্য কোথায়?
(প্রিয় তরুণ বন্ধুরা, আমার এই লেখা ইয়ো প্রজন্মের বাস্তব চিত্রের খন্ডাংশ মাত্র। লেখা পড়ে কেউ কস্ট পেলে আমি ক্ষমা প্রার্থী)
ধানমন্ডির রাইফেলস স্কয়ার। এক্সট্রা সিলিন্ডার লাগানো দুটি অদ্ভুত দর্শন গাড়ি ছুটে আসছে দুরন্ত গতিতে। কে কার আগে যেতে পারে। গাড়িতে মিউজিক চলছে- "গুলশান-বনানী আবার জিগায়"। আরেকটিতে দুর্বোধ্য ইংরেজি গান। বিডিআর গেটে এসে রেসিং কারের মতো ঘসাং করে ব্রেক চেপে থামল গাড়ি দুটো। দু গাড়ি থেকে নামল দুজোড়া তরুণ-তরুণী। তবে উপস্থিত অন্য সবার থেকে আলাদা ওরা। একবার দেখলে যে কেউ দ্বিতীয়বার তাকাবেন তাদের কীর্তিকলাপ দেখার জন্য। ছেলে দুটোর গায়ে বাহারি রঙের টি-শার্ট। একাধিক জায়গায় ছেঁড়া জিন্সপ্যান্টটি কোমরের ছয় ইঞ্চি নিচে ঝুলছে। বলাবাহুল্য প্যান্ট যাতে খুলে পরে নাযায় সেজন্য বেল্ট দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। মেয়ে দুটির একটি পরেছে শর্ট কামিজ আরেকজন টি-শার্ট। তবে দুটোই দারুণ আঁটসাঁট। ছেলে দুটোর প্যান্ট ঝাড়ুদারদের সঙ্গে বোধকরি বন্ধু ভাবাপন্ন। কারণ প্যান্টের নিচের অংশটুকু পায়ের তলায়। আর মেয়ে দুটোর প্যান্ট গোঁড়ালি থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে ফোল্ড করা। জুতার সাইজ পায়ের মাপের চেয়ে এক দুই সাইজ বড়। কয়েকটা ভাঁজ দিয়ে দাঁড়িয়ে। কানে ইয়ার ফোন, হাতে একাধিক সেল ফোন। দেখতে অদ্ভুত কিমাকার!
প্রিয় পাঠক। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কাদের কথা বলছি। হ্যাঁ, এরাই "ইয়ো প্রজন্ম"। কখনোও কঠিন ভাব আবার কখনো জটিল মুডে থাকে। বয়সে এরা টিনএজার। অধিকাংশই ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র। ইয়ো প্রজন্মে দুই শ্রেণীর ছেলে-মেয়েরাই থাকে। শতকরা সত্তর থেকে আশিভাগ ধনীর দুলাল। প্রতিদিন কমপক্ষে হাজার টাকা খরচ করে গাড়ির তেলের পেছনে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যেন তাণ্ডবলীলা চালায়। কেউ আহত হলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। এদের আচার-আচরণে প্রভাবিত হয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও "ইয়ো" হতে চায়। কিন্তু তাদের পরিবারের এই বিলাসিতা করার আর্থিক সক্ষমতা নেই।
পড়াশোনাঃ
ইয়োরা পড়াশোনায় কিন্তু ভালোই। তবে অধিকাংশই পড়াশোনা করে সার্টিফিকেটের জন্য। ইংলিশ মিডিয়ামকে এরা পছন্দ করে নাকি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তারা ইয়ো হয় এটা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে একথা সত্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজগুলোতেই এদের সংখ্যা বেশি। এ-লেভেল, ও-লেভেল করে ভর্তি হয় ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। এদের কেউ কেউ যে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেত না তা না। কিন্তু এরা পাবলিক ইউনিভার্সিটিকে বাঁকা চোখে দেখে। কারণ পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে এরা নিজেদের মতো করে চলতে পারবে না।
দ্রুত পরিবর্তনশীল রুচিঃ
ইয়োদের রুচি বদলায় দ্রুত। সেটা পোশাক-আশাক স্টাইল থেকে শুরু করে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সবকিছুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অত্যন্ত খরুচে এই প্রজন্ম বেশ আড্ডাবাজ, ফ্যাশনদুরস্ত। চোখে ইয়াবড় সানগ্লাস কানে হেডফোন। তবে সবই সাময়িক। একটি গানের জনপ্রিয়তা এদের কাছে আরেকটি জনপ্রিয় গান আসার আগ পর্যন্ত। তবে এই গানগুলোর জনপ্রিয়তার মাপকাঠি কিন্তু তারাই- আমজনতা এই গানের আগামাথা কিছুই বুঝবে না। লিংকিন পার্ক, বোম্বে রকার্স আর র্যাপ গান গোগ্রাসে গিলে খায় ইয়োরা। তবে হজম করতে পারে না।
ইয়োদের নিজস্ব পৃথিবীঃ
ইয়োদের নিজস্ব ভাষা আছে। নিজস্ব সঙ্গীত আছে। বিভিন্ন কাজের বিভিন্ন নাম আছে। এদের আগ্রহের তালিকা বেশ বড় তবে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। প্রেম, সেক্স এগুলো ইয়োদের কাছে সাধারণ ব্যাপার। সবদিক দিয়ে নিজেকে আলাদা রাখা কিপ আউট। পুরনো বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে নতুন বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড জোটানোর নাম "নকআউট"! হঠাৎ বিপরীত লিঙ্গের কাউকে নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া "হাইড আউট"! গাড়ির ভেতর, বাসায় বা আলোআধারী ফাস্টফুডে ঘনিষ্ঠতম অবস্থায় বসাকে তারা বলে "মেক আউট"! প্রায়শই তারা ডিসকোর আয়োজন করে। পার্টির নামে রাতভর উদ্দাম নৃত্য আর ড্রিংকস করা এদের ভাষায় "নাইট আউট"! এরা বাংলাদেশকে আমেরিকা ইউরোপের মতো দেখতে চায়। তবে পজিটিভ দিকটা নয় নেগেটিভ দিকটা এরা গ্রহণ করে বেশি। ইয়োরা একজন বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বেশিদিন থাকে না। প্রয়োজন ফুরালে অর্থাৎ রুচির পরিবর্তনে ফিনফিনে সম্পর্কের ভাঙন। এদের ভাষায় "ড্রপ আউট"!
বর্তমানের কোনো কিছুই যেন তাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। বের করতে পারে না তাদের ইয়ো পৃথিবী থেকে। গণিত অলিম্পিয়াড, বিতর্ক চর্চা, শিল্প, সংস্কৃতি, কোনো কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। দেশীয় শিল্পচর্চায় এদের তেমন দেখা যায় না। বাংলা সিনেমাকে এক অর্থে তারা ঘৃণা করে। এমনকি বর্তমান সুস্থধারার বাংলা সিনেমাগুলোকেও। তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় গত বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবির নাম কী? তারা উত্তর দিতে পারবে না। কিন্তু হলিউড, বলিউডের টপচার্ট মুখস্ত, ঠোঁটস্থ, কন্ঠস্থ এবং অন্তস্থ! কবির ভাষায় "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া"।
প্রজন্ম পার্থক্য স্বাভাবিক। কিন্তু যেভাবে তারা বেড়ে উঠছে সেখানে মেধা মননের চর্চা নেই। নেই চিন্তাশীল কাজ। মেক আউট, কিপ আউট, নক আউট এত আউটের ফলে তারা না আবার মেন্টালই আউট হয়ে যায়!
ওরাও বন্ধুঃ
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ইয়োরা সত্যি মেধাবী। তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এরা বেশ পরিপক্ব। মোবাইল ফোন এদের কাছের বন্ধু। এদের ঘর আলাদা, বন্ধুরাও আলাদা, অন্যরকম। অথচ এরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একটি অংশ।
আমি ইয়োদের পরিবারকে কোনো পরামর্শ দিতে চাই না। তবুও কথা প্রসঙ্গে বলতেই হয় ইয়োদের বাবা-মা কী সত্যি সত্যি তাদের নিয়ে সুখী? বোধকরি না। কাজেই তাদের জন্য কিছু করা খুবই জরুরি। আজকাল প্রায়শই দেখা যায় অবিন্যস্ত পোশাক কোমর থেকে পড়ে যাচ্ছে যেন, পকেটের ইয়ত্তা নেই। কতদিন গোসল করেনি সেটা হয়তো খেয়াল নেই- ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। ওদের মুখের বাংলা ভাষাও অন্যরকম- আমি "টোমাকে বালভাসি" স্টাইলের! আর কথায় কথায় "হাই ম্যান" অথবা "ইউ নো"র ব্যবহার। এদের সাথে দেশের সমগ্র তরুণ সমাজের একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা মোটেই কাম্য নয়। আমরা কলেজ, ভার্সিটিতে আড্ডা-আলোচনায় দেখতে চাই হাস্যোজ্জ্বল তরুণ-তরুণীর মুখ। ইয়ো প্রজন্মের ধুয়া তুলে কাউকে সরিয়ে দিতে চাই না। কারণ ওরাও আমাদের বন্ধু- দেশের ভবিষ্যৎ। ওদের জন্য আমার আপনার কী করণীয় ভাবুন তো একবার।
(আমার এই লেখাটা পুর্বে একটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ২:১৯