A Short-story of LOVE...
চারপাশে অন্ধকার। রক্ত। বুলেট। মৃত্যু। সেই আশ্চর্য মহালগনে, ওদের দুজনের দেখা হয়েছিল।
জের্জি বিয়েলেস্কি রোমান ক্যাথলিক, ইহুদীদের সাহায্য করার অপরাধে ওকে বন্দী করে আনা হয়েছিল আউৎস্ভিৎস-এ। সাইলা সাইবুল্স্কা অবশ্য নিজেই ইহুদী, ফলে তাকে তো মরতেই হবে আজ না-হয় কাল। তার পরিবারের সবাইকে তারই সামনে একে একে হত্যা করা হয়েছে। এবার একদিন তার পালা।
ওই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের সহ-বন্দী হিসেবে অনিবার্য এক মৃত্যুনদীর কিনারে দাঁড়িয়ে ওদের যখন প্রথম একে অন্যকে ভালো লাগছিল অল্প অল্প করে, তখন ওরা দুজনেই একটা কথা খুব ভালো করে জানত: শিগগির একদিন গ্যাস চেম্বারের ভিতর ঢুকে যাওয়ার আগে শেষ অভিবাদন জানাতে হবে একে অন্যকে!
যেদিন কড়া-চোখের গার্ডগুলোকে লুকিয়ে সাইলাকে প্রথম চুমু খেয়েছিলাম, সেইদিন হঠাৎ মনে হয়েছিল, দুজনে মিলে একবার বাঁচার শেষ চেষ্টা করলে কেমন হয়!
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। প্রায় আট মাসের ঝুঁকিপূর্ণ গোপন চেষ্টায় জোগাড় হল এস.এস. গার্ডদের একটা ইউনিফর্ম আর দুটো নকল পাস। ১৯৪৪ সালের ২১ জুলাই সাইলার হাত ধরে বিয়েলেস্কি মৃত্যুক্যাম্পকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল পথে। দশদিন একটানা অরণ্য-মাঠ-নদী পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছল এক আত্মীয়ের বাড়ি।
কিন্তু এখানে অনির্দিষ্টকাল থাকা খুব নিরাপদ নয়। আর দুজনে একসঙ্গে একই জায়গায় লুকিয়ে থাকাও অসম্ভব। বিয়েলেস্কি সাইলাকে একটা নিরাপদ আস্তানায় রেখে যখন শেষবারের মতো চলে যাচ্ছিল নিজের জন্য একটা ভিন্ন ঠিকানার খোঁজে, সাইলা বলেছিল, "অপেক্ষা করব তোমার জন্য। বিয়েলেস্কি বলেছিল, নতুন ভোরে দেখা হবে সাইলা"।
কিছুদিন পির গোপন ডেরায় বসেই খবরটা পেল সাইলা- পোলিশ রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপের সঙ্গে নাজি সৈন্যদের গুলি বিনিময়ে মৃত্যু হয়েছে বিয়েলেস্কির। ও আর কখনও ফিরবে না!
সাইলা বেরিয়ে পড়ে পথে। ওয়ারশ হয়ে, সুইডেন হয়ে একটা সময়ে ও আমেরিকা চলে যায়।
আসলে সাইলার কাছে পৌঁছোনো খবরটা ছিল মিথ্যা। প্রায় ৪০ কিলোমিটার লম্বা বরফে-ঢাকা-পথ পেরিয়ে বিয়েলেস্কি যেদিন সাইলাকে নিয়ে যেতে সেই গোপন ডেরায় এসে পৌঁছোল, তার চারদিন আগে সাইলা ওখান থেকে চলে গেছে!
বিয়েলেস্কি সাইলার অনেক খোঁজ করেছিল নানা জায়গায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত, খবর আসে, সুইডেনে পৌঁছে সাইলার মৃত্যু হয়েছে।
বলা বাহুল্য যে, এই খবরও ভ্রান্ত!
তারপর যেমন হয়। জীবন তার ছন্দে বয়ে চলে। দুজনেরই নতুন প্রেম, বিয়ে, সংসার, সন্ততি সবই হয়। আর দুজনেই একে অন্যকে ধরে রাখে ব্যক্তিগত স্মৃতিতে। অবশ্য পুরোটা ব্যক্তিগত না। স্বামী-স্ত্রী-নাতি-পুতিদের কাছে এই গল্প ভাগ করে নিতে ভালোবাসত ওরা দুজনেই।
১৯৮৩ সালের মে মাসের এক দিন, এইরকমভাবেই, নিউইয়র্কে নিজের বাড়িতে বসে সাইলা এই গল্পটা বলছিল দু-একজনকে। কথাগুলো বাড়ির পরিচারিকার কানে যেতেই তিনি থমকে যান। বলেন, 'ম্যাডাম, আপনার এই গল্পটা আমি অন্য একজনের মুখে শুনেছি!'
- "কার মুখে?"
- 'একটা টিভি চ্যানেলে এক ভদ্রলোক ঠিক এই গল্পটাই বলছিলেন একদিন। তাঁর জীবনের গল্প!'
টিভি চ্যানেলের সূত্রে বিয়েলেস্কির ঠিকানা আর ফোন নম্বার জোগাড় করতে সাইলাকে পরিশ্রম করতে হয়েছিল বটে....
১৯৮৩ সালের ৮ জুন পোল্যান্ডের ক্রাকো এয়ারপোর্টে সাইলা যখন নামল, ধীরে ধীরে তার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল বিয়েলেস্কি। ষাঠোর্দ্ধ এক প্রৌঢ় সর্বসমক্ষে হাঁটু-মুড়ে বসল সমবয়সী এক নারীর সামনে। তার হাতে ছিল ৩৯টা রক্তগোলাপ। বিয়েলেস্কি বলল, "গ্রহণ করো, সাইলা।"
দুজনের শেষবার দেখা হয়েছিল ৩৯ বছর আগে!
তারপর কী হল?
সব গল্পের শেষে সবসময় কিছু হতেই-বা হবে কেন?
নিউইয়র্কে ফিরে যাবার আগে সাইলা বলেছিল, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে একবার-যে তোমার সঙ্গে দেখা হল, জীবনের কাছে বড্ড কৃতজ্ঞ লাগছে আজ! বিয়েলেস্কি বলেছিল, ভালো থেকো সাইলা।
এরপর ওরা ফিরে গেল নিজের নিজের দেশে।
দেশ তো নয়, দুটো আলাদা মহাদেশ। মধ্যিখানে অতলান্ত সমুদ্র। তাতে অনেক ঢেউ। আমৃত্যু ওরা এইটুকু বিশ্বাস করত, অনেক দূরে ওদের একজন বন্ধু আছে। সে-ও এক মস্ত ‘থাকা’!
এই হল মৃত্যু-অতিক্রমী জীবনবোধ। সহজ করে, সাদা করে জীবনকে দেখতে পারার এই এক আশ্চর্য ক্ষমতা। সহজের সাধনা আসলে ততটা সহজ না।
বেশ কয়েক বছর আগে পড়া ‘ব্ল্যাক বুক অব পোলিশ জিউরি’ - থেকে একটি ঘটনা নিজের মতো করে প্রকাশ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:৩৪