উপমহাদেশে নারী সৌন্দর্যায়নের ইতিহাস....
সোস্যাল মিডিয়ায় অনেক ছেলেই চটুল চপল মন্তব্য করে - "মেয়েরা আটা, ময়দা মুখে মাখে", "ম্যদা সুন্দরী"- ইত্যাদি!
প্রসাধনের নামে এরকম অবজ্ঞা সুচক কথা বলে অর্ধ-শিক্ষিত ছেলেরা কতটা আনন্দ পায়, সেটা জানিনা, তবে মেয়েরা কিন্তু যথেষ্টই আঘাত পায়। প্রসাধনী বাপারটাকে এত হেয় করে ভাববার কোন অবকাশ নেই।
উপমহাদেশে দুই ভারতীয় দিকপাল পুরুষ যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে এই শিল্পের বিষয়ে ভেবেছিলেন এবং সেই অনুসারে কাজও করেছিলেন। তাদের হাত ধরেই উন্মুক্ত হয়েছিলো সৌন্দর্যায়নের ক্ষেত্রে নতুন দিশা।
ভারতীয় নারীদের সৌন্দর্যের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। উপমহাদেশের নারীদের কোমল কমনীয়তা ও সৌন্দর্যের পিছনে প্রসাধনীর একটা বড় ভূমিকা আছে। সেই পৌরাণিক কাল থেকেই ভারতবর্ষে আয়ুর্বেদীয় রূপচর্চায় সুন্দরীকে আরো সুন্দরী, মোহময়ী করে তুলতে অনেক বেশী এগিয়ে ছিলো। কালের পরিক্রমণ কারো ছোট একটু আধটু খুঁত মেকআপ করে নিতে প্রসাধনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নারীদের সৌন্দর্যকে সম্পুর্ন রূপে ফুটিয়ে তোলার এই জাদুকাঠিরূপ প্রসাধনী তৈরির একটা ইতিহাস আছে।
ইংরেজ বিদায়ের পর ভারতীয় অর্থনৈতিক, সামাজিক সকল প্রেক্ষাপটেই পুনর্গঠনের কাজ চলছে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আসীন হয়েছেন কাশ্মিরী সৌন্দর্য প্রেমী জওহরলাল নেহেরু। তিনি অনুভব করলেন মধ্য এবং নিম্নবিত্ত ভারতীয় নারীদের সাজ সজ্জার সরঞ্জামের বড় অভাব। দেশীয় কোন প্রস্তুতকারক সংস্থা নেই। সম্পুর্ন ভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা দ্রব্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাতে যে পরিমান খরচ হয় তা কেনার সাধ্য সাধারণ ভারতীয় নারীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর দেশীয় নারীর ত্বক বা তার ধরণ সমন্ধে কোনরূপ ধারণা না থাকা বিদেশী প্রস্তুত কারক এবং বিদেশী কাঁচামালে তৈরি দ্রব্যের ওপর কতটা বিশ্বাস রাখা যায়, সেই ব্যাপারেও নেহেরু সন্দিহান ছিলেন। দেশীয় বাজারে প্রসাধনীর চাহিদাও যথেষ্টই ছিলো।
যৌবন, সৌন্দর্য দীর্ঘ স্থায়ী রাখতে, সুন্দর হতে সব কালেই সবাই চায়। এসব ভেবে নেহেরু দেশের এক নম্বর শিল্প উদ্যোক্তা JRD Tata এর কথা। ১৯৫২ সালে এক অনুষ্ঠানে টাটা এর সাথে দেখা হলে নেহেরু কথাটি পাড়লেন তার কাছে। বললেন - 'দেশ তৈরির জন্য লৌহ ইস্পাত তো অনেক বানালেন এবার ভারতীয় রমনীদের সুন্দর করে তোলার বিষয়ে কিছু করুন। সাজ সরঞ্জামের চাহিদা থাকলেও, দেশীয় কোন প্রতিষ্ঠানই কিন্তু নেই।'
ব্যবসায়ী টাটার মাথাতেও বিদ্যুৎ খেলে গেলো। তিনি প্রতিত্তরে বললেন, "খুব ভালো, মহতী একটি প্রস্তাব আপনি করেছেন পন্ডিতজী। আমি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি"।
সেই বছরই টাটা প্রতিষ্ঠা করলেন দেশের প্রথম বিউটি প্রোডাক্ট প্রস্তুত কারক সংস্থা - Lakme India, বর্তমানে যার নাম জানেনা তেমন ভারতীয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ল্যাকমে শব্দটা এসেছে ফ্রেঞ্চ অপেরা Lakmé থেকে। ভারতীয় শব্দ লক্ষ্মী (ধন সম্পদ ও রূপের দেবী) কথাটির ফ্রেঞ্চ ভার্সন হচ্ছে Lakmé। প্রথমে টাটা সুন্দরী নারীর প্রতিমূর্তি 'লক্ষ্মী' নামটির কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু দেবীর নামে লক্ষ্মী কাজল, লক্ষ্মী লিপস্টিক কিনতে ভারতীয় নারী স্বছন্দ্য বোধ নাও করতে পারে। তাই ঠিক হল দেশীয় লক্ষ্মীর ফ্রেঞ্চ ভার্সন Lakme, যার মধ্যে আধুনিকতা ও আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া থাকবে।
অর্থাৎ ভারতীয়দের ঘরের লক্ষ্মীদের কথা ভেবে, তাদের জন্য তৈরি হয়েছিলো প্রসাধন উৎপাদক সংস্থা ল্যাকমে। সেই শুরু, তারপর তো দেশীয় বাজারে প্রসাধন উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে গেছে। চাহিদার কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে বড়, ছোট বহু কোম্পানি - যেগুলোর ব্যবহারে শুধু নারীরা নয়, পুরুষরাও সমান ভাবে আগ্রহী।
পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনি লিভারের সাথে পাল্লা দিয়ে কেয়া কসমেটিকস, স্কয়ার টয়লেট্রিজ ছাড়াও ছোটো বড়ো অনেক কসমেটিকস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নিম্নবিত্ত'- নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের চাহিদার যোগান দিচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ১০:১৮