ফ্যাসিজম..............
জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, স্পেনের ফ্র্যাঙ্কো, চিলির পিনোচেত এদের শাসন বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করে রাজনৈতিক লেখক ড. লরেন্স ব্রিট ২০০৩ সালে ফ্যাসিজম বা যেকোন ফ্যাসিস্ট সরকারের চরিত্রের ১৪ টি বৈশিষ্ট্য এক জায়গায় জড়ো করেছিলেন। ড.ব্রিট পরিষ্কার লিখেছিলেন এই ১৪টি বৈশিষ্ট্যই ফ্যাসিজিম চেনার উপায়।
(১) শক্তিশালী উগ্র জাতীয়তাবাদের একটানা প্রচারঃ ফ্যাসিবাদীরা বা ফ্যাসিবাদী সরকার লাগাতার উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান, গান, সিনেমা ও বিভিন্ন রকমের অর্ধসত্য লেখা/রচনা প্রচার করে চলে। পতাকার ব্যবহার খুব বেশি করা হয়।পোশাকে, রাস্তার মোড়ের বিলবোর্ডে সর্বত্র এসবের ব্যবহার দেখা যায়।
(২) মানবাধিকার রক্ষায় চূড়ান্ত অনীহাঃ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার দোহাই দেখিয়ে এবং সর্বোপরি ‘শত্রু’র ভয় দেখিয়ে জনগণকে এটা বুঝানো হয় যে সবসময় মানবাধিকারকে রক্ষা করার কোনও প্রয়োজনই নেই।‘দেশ রক্ষার’ তাগিদে মানুষ এসবে অভ্যস্ত হতে শুরু করলে এরপরের ধাপে আসে আইন বহির্ভূত বিচারসহ হত্যা, গুম, খুন, বিনা বিচারে জেল ইত্যাদি।
(৩) শত্রু চিহ্নিতকরণঃ উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রোতে ভেসে মানুষ দলবদ্ধ হয়ে মিছিল করে শাস্তি দাবি করে শাসকেরই তৈরি করে দেয়া কোনও ‘শত্রু’র বিরুদ্ধে, কোন উদার মতবাদের বিরুদ্ধে এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে।
(৪) যুদ্ধ সরঞ্জাম/প্রতিরক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দঃ দেশজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্রের অপ্রতুলতা, বেকারি বৃদ্ধি কিংবা অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা না থাকলেও প্রতিরক্ষা খাতে প্রয়োজনের চেয়েও বিপুল পরিমাণে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয় এবং সকল সময়ে দেশবাসীর সামনে সেনাবাহিনীর কাজকে গর্ব সহকারে মডেল হিসাবে পরিবেশন করা হয়।
(৫) প্রচন্ড পুরুষতান্ত্রিক সমাজঃ ফ্যাসিস্ট সরকার শাসিত সমাজ প্রায় পুরোটাই পুরুষকে প্রাধান্য দেয়। এক কথায় চূড়ান্ত রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক।
(৬) গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণঃ ফ্যাসিস্ট সরকার নিজেদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে গণমাধ্যম অর্থাৎ খবরের কাগজ ও টেলিভিশনকে রাখে।কোনও সংবাদমাধ্যম তাদের বিরুদ্ধাচারণ করলে অথবা মনমতো খবর পরিবেশন না করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। যুদ্ধের সময় কিংবা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর হয়।
(৭) জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে সর্বদা একটা চিন্তার আবহাওয়া তৈরি করাঃ এই অকারণ চিন্তার আবহাওয়া তৈরি করার জন্য সর্বদা একটা অমূলক ভয়ের/ আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয় সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
(৮) ধর্ম এবং সরকারকে এক করে দেয়াঃ দেশের মধ্যে প্রচলিত প্রধান ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষের আসল সমস্যা বা মতামতকে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় শব্দবন্ধ বা কাল্পনিক ধর্মীয় ঘটনার উল্লেখ শোনা যায় সরকারি নেতা মন্ত্রীদের তরফ থেকে।অথচ সেই ধর্মে উল্লিখিত বা নির্দেশিত ভালো কাজকর্মের সাথে সরকারি কাজকর্মের বিন্দুমাত্র মিল থাকে না। এক্ষেত্রে স্রেফ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মানুষকে উলটোপথে চালনা করা হয়।
(৯) কর্পোরেট শক্তিকে সুরক্ষা প্রদানঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই নির্দিষ্ট দেশের প্রধান প্রধান শিল্পপতিরা নিজেদের সর্বোচ্চ মুনাফার স্বার্থেই ফ্যাসিবাদী শক্তিকে অর্থ সরবরাহ করে, নতুন নেতা তৈরি করে এবং সর্বোপরি সবরকম সরকারি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে।
(১০) শ্রমিকের অধিকার ও সুরক্ষায় ব্যাপক কাটছাঁটঃ যেহেতু একমাত্র সংগঠিত শ্রমিক শক্তিই ফ্যাসিবাদের ভয়ের কারণ হয় তাই হয় শ্রমিক সংগঠনগুলো একেবারে ভেঙ্গে দেয়া হয় কিংবা শ্রমিকদের যাবতীয় অধিকার ক্রমাগত খর্ব করা হতে থাকে।
(১১) বুদ্ধিজীবী এবং শিল্প সাহিত্যের প্রতি অনীহাঃ ফ্যাসিস্ট সরকার সবসময়েই উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণামূলক কাজে অনীহা প্রকাশ করে। এরকম সরকারের অধীনে মুক্ত চিন্তা প্রকাশের জন্য শিক্ষক অধ্যাপকদের পুলিশি হয়রানি ও জেলে যাওয়া খুবই সাধারণ ব্যাপার। সাহিত্য বা শিল্পকর্মে স্বাধীন মতামতের জন্য আক্রমণও নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।ফ্যাসিস্টদের নিয়ে কার্টুন/মশকরা করা যায় না। শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সরকারি অনুদানও বন্ধ করে দেয়া হয়।
(১২) অপরাধ, সাজা ও পুলিশ রাষ্ট্রঃ ফ্যাসিবাদী শাসনে পুলিশকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়া হয় আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। দেশপ্রেমের টোটকায় বুঁদ রেখে মানুষকে প্রায়শই নাগরিক স্বাধীনতা থেকে দূরে রাখা হয়।পুলিশের অত্যাচার কিংবা এনকাউন্টার ইত্যাদিকে বৈধতা দেয়া হয়।ফ্যাসিস্ট শাসনের পরিপূর্ণ বিকাশে জাতীয় পুলিশ বাহিনীও তৈরি করা হয় যাদের হাতে অভূতপূর্ব সীমাহীন আইন বহির্ভূত ক্ষমতা দেয়া থাকে।
(১৩) অবৈধ নিয়োগ এবং দুর্নীতিঃ ফ্যাসিস্ট শাসন সবসময়েই একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের মানুষ ও তাদের সহকারীদের দ্বারা পরিচালিত হয় যারা নিজেদেরই একে অপরকে সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে নিয়োগ করে থাকে। সরকারি নেতাদের দ্বারাই ফ্যাসিস্ট জমানায় সরকারি সম্পত্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি করা নিত্যদিনের ঘটনা।
(১৪) নির্বাচনে জালিয়াতিঃ কিছুক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট শাসনে নির্বাচনকে সম্পূর্ণরূপেই প্রহসনে পরিণত করা হয়। আবার অন্যসময় কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তিহত্যা ঘটিয়ে বা অন্যকোনও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটিয়ে নির্বাচনের অভিমুখ পালটে দেয়া হয়। কখনও আইনের অপব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচকমন্ডলীর সংখ্যার ক্ষেত্রে গণ্ডি টেনে দেয়া হয়। কখনও মিডিয়াকে দিয়ে ইচ্ছাকৃত ভুল খবর পরিবেশন করিয়ে জনমত অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। ফ্যাসিস্ট শাসনের অন্যতম আর একটা বৈশিষ্ট্য হলো বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে নির্বাচনে কারচুপি চালানো।
লেখকঃ বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য এর অনুবাদে-
(‘প্রকৃতি, সমাজ এবং চিন্তা’ বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন ‘শিখা অনির্বাণ’ এর বত্রিশতম সংখ্যা, মার্চ ২০২০ )
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২২ সকাল ৯:৫৭