জীবন বোধ....
প্রতিটা মৃত্যু আমাদের পরিণত করে দেয়। কবরস্থান, জায়গাটা এমন একটি জায়গা যেখানে গেলে সমস্ত লোভ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, আশা, পাপ, পূণ্য বোধ তুচ্ছ মনে হয়। একদিন সব শেষ হবে, এই বিশ্বাস কুড়ে খায়। মহাকালের একটি ভগ্নাংশ আমাকে অধিকার করতে দেওয়া হয়েছে, সেটুকুর মধ্যেই নিজের ভালো কাজটুকু অথবা খারাপ চিহ্নটুকু রেখে যাওয়া। আর কিছুই থাকে না। প্রবহমান কালের স্রোতে যেখানে যে কোন মানুষের অস্তিত্বই তুচ্ছ, তার অসীম শক্তির অহংকার অসহায়, তার যাবতীয় আস্ফালন বা অসহায়তা বা ভালোবাসা সব হারিয়ে যায় মাটির গভীরে। ফুরিয়ে যায় সবটুকু। কালের এই নিয়মের সামনে সকলেই পরাজিত।
যারা চলে যান তারা কি ফিরতে চান?
তাদেরও বোধহয় আফসোস থাকে, ঈশ্ মেয়েটার বিয়ে দেওয়া হল না; ঈশ্ ছেলেটাকে মানুষ করা হল না; ঈশ্, এই তো বাড়িটা বানালাম, থাকা হল না; সারাজীবনের ভুলগুলো যদি আরেকবার শুধরে নেওয়া যেতো! এরকমটা মনে হয় ছেড়ে যাওয়া আত্মার?
এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত, নানা সিদ্ধান্ত, নানা গবেষণা।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার বাবাকে দেখতে পাই বহুদিন মৃত্যুর পরেও। যেন বাবা বলতে চাইছেন, "বেঁচে থাকতে খুব বেশি তোর পাশে দাঁড়াতে পারিনি, আফসোস... আফসোস, এখন থাকবো।"
মানুষের বেঁচে থাকা ঘিরে নানা অভিযোগ, এটা নেই, ওটা নেই, ক্ষুদ্র অভিযোগে আনন্দগুলোকে পার করে যাওয়া। একটা জীবন কত সময় কেটে যায় শুধু অভিযোগ করতে করতে, মুঠো থেকে জীবন বেরিয়ে গেলে হঠাৎ বোঝা যায়, যাহ্ বাঁচাইতো হল না, এই তো এত অভিযোগের পাহাড় নিমেষে শেষ!
এ যে বাজিকরের খেলা।
যিনি চলে যান তারও কতকিছু অপূর্ণ থাকে, অপূর্ণ থেকে যায়। যারা থেকে যায় তাদের স্মৃতিজুড়ে থাকে কত অপূর্ণতা। মানে জীবন থাকতে আফসোস, জীবন গেলে আফসোস। আমার এই বয়সে এসে এই শূন্যতাটা বড় আপন মনে হয়- "কিছুই কিছু না" এর বোধ।
আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার সন্তান, আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ... আসলে সে ভবিষ্যতে আমি নেই, আমরা কেউই আমাদের সন্তানের ভবিষ্যতে চিরস্থায়ী নই, আমাদের ভবিষ্যত বলে কিছু কাল না থাকতে পারে, দপ্ করে নিভে যেতে পারে প্রদীপ।
তবে কেন এত দৌড়ঝাপ?
এই ভগ্নাংশ কাল যেটা আমাকে অধিকার করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে নিজেকে জাহির করার অপপ্রয়াসে কখন যেন ধাঁম করে চলে যায় জীবনটা, প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে দুদন্ড বসে হেসে কথা বলা হয়না।
আমার বড় ও ছোট চাচা মারা গেছেন কমবেশি সত্তর বছর বয়সে। বাবা আরও কম বয়সে। আমার বাবা চাচা, মামা মামী, খালা খালু, শশুর শাশুড়ী অনেক আগেই মারা গেছেন। কয়েকজন চাচাতো ভাই ছাড়া মুরব্বি স্থানীয় কেউ বেঁচে নেই আমাদের বৃহত্তর পরিবারে। স্নেহ পেতে দাঁড়ানোর জায়গাগুলো কমছে। অভিভাবক শব্দটার খুব গুরুত্ব, যত বয়স বাড়ছে। প্রিয় মানুষেরা চলে যায়, আর আমার মধ্যে জেগে ওঠে প্রতিবার এক তুচ্ছতার বোধ, এক শূন্যতা, আফসোসে ভরা একটা জীবনের প্রতি করুণা।
একজনের পর একজন কাছের লোককেই হারাচ্ছি। এখন আর শুধু পেশাগত ভাবে আত্মীক সম্পর্কের নয়, সরাসরি অতি ঘনিষ্ঠ মানুষদের অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থা বা জীবনাবসনের সংবাদ প্রায় নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়ত আমরা এমনিতেই জীবনসায়াহ্নে এসে পৌঁছেছি.... আমাদের অনেকের এই বয়সে ইনিংস শেষ করার কথা। After all.."we have attained the dieable age"..। অদ্ভুত ভাবে দেখা যাচ্ছে, কোনো সতর্কতা ছাড়াই বেশীর ভাগ মানুষ আরামে রয়েছে আবার সতর্কতা সত্বেও কিছু মানুষের ক্ষেত্রে morbidity ও mortality অত্যন্ত বেশী। বাছাই বা selective কিছু মানুষ কেনই বা most vulnerable তার কোনো না কোনো কারণ তো নিশ্চয়ই আছে, যদিও এই মুহূর্তে তা আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে অধিগত নয়। কেবলমাত্র co-morbidity দিয়ে সমস্তটার ব্যাখ্যা আদৌ যুক্তিগ্রাহ্য হবে বলে মনে হচ্ছে না।
গত দুই বছরে কোভিডে এবং প্রাকৃতিক নিয়মেই আমরা আমাদের অনেক সেরাদের হারিয়েছি। এখনো হারাচ্ছি। মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। যা কখনই কাম্য ছিল না তাই মেনে নিতে হচ্ছে অনেক কষ্টে........
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




