ঘর মন জানালা ......
খবরের কাগজ পড়া এবং রেডিওতে দেশ বিদেশের সংবাদ শোনার নেশা আমার সেই ছেলে বেলা থেকেই। স্বাধীনতার আগে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, করাচি এবং ইসলামাবাদ থেকে বাংলা, উর্দু এবং ইংরেজিতে সংবাদ প্রচারিত হতো। এর মধ্যে 'রেডিও পাকিস্তান' থেকে অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি ও ইসলামাবাদ থেকে।

আসলে সেই শিশু কিশোর বয়সে সংবাদে ততটা নয়, রেডিওর রহস্যময় যান্ত্রিক কৌশল, বিজ্ঞাপনের জিংগেল এবং সংবাদ পাঠকেরা আমাকে খুব আকর্ষণ করতো। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে বাংলা সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে সরকার কবীরউদ্দীন, ইমরুল চৌধুরী, নূরুল ইসলাম সরকার এবং নারী কণ্ঠে দিলারা হাশেমের সংবাদ পাঠ আমার ভালো লাগতো। ইংরেজি নিউজ তেমন শুনতাম না(আসলে বুঝতাম না, তবুও পরিবারের বড়োদের নির্দেশে ইংরেজি নিউজও শোনা হতো)। ইংরেজী সংবাদ পাঠে এরিক বোনার, রিজওয়ান ওয়াস্তির নাম আমার মনে আছে।
'আকাশবানী'র' দেব দুলাল বন্দোপধ্যায়, বিজন বোসের গম্ গমে্ কণ্ঠ শুনতে যা ভালো লাগতো। সেই সময়ে বাংলায় যে দু'জন নারী সংবাদ পাঠকের কথা আমার স্মৃতিতে আছে, তাঁরা হচ্ছেন 'আকাশবাণীর' নীলিমা স্যান্ন্যাল ও ইভা নাগ। ইভা নাগের কণ্ঠে এক যাদুকরী আমেজ ছিলো। মনে হতো তিনি এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে আদ্র কণ্ঠে সংবাদ পাঠ করছেন।
রেডিও পাকিস্তান থেকে 'খবর পড়ছি দিলারা হাশেম'- কণ্ঠের সঙ্গে কৈশোরে আমার পরিচিতি যখন তিনি রেডিও পাকিস্তান করাচী থেকে সংবাদ পাঠ করতেন। কী মিষ্টি মোহনীয় ছিলো সেই কণ্ঠস্বর! সত্তুর দশকে বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠানে এবং পরবর্তীতে ভয়েস অব আমেরিকা থেকেও দিলারা হাসেম সংবাদ পাঠ শুনেছি।

আমার কাজীন অকাল প্রয়াত কবি আবুল হাসান। খুব স্বল্প সময়ের জন্য হলেও আমি ছিলাম তার ন্যাওটা। সম্ভবত ৭৫ সনে ঈদের ছুটিতে ক্যাডেট কলেজ থেকে বাড়ি এসে হাসান ভাইয়ের হাতীরপোল মেসে(হাসান ভাই এবং তার কয়েকজন কমুনিস্ট বন্ধুদের নিয়ে একটা টিনশেড ঘর ভাড়া নিলেও বেশীর ভাগ সময় তিনি একাই থাকতেন) দেখা করতে যাই। হাসান ভাই আমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের চেয়ারম্যান সুরাইয়া খানমের রুমে যান। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হট টপিকস এবং শহরের সাহিত্যাংগনে রমরমা আলোচ্য বিষয় ছিলো- সুরাইয়া ম্যাডামের সাথে তাঁর ৮ বছরের ছোট ছাত্র কবি আবুল হাসানের প্রেম! সেখানেই সামনা সামনি দেখা হয় বিখ্যাত সংবাদ পাঠিকা দিলারা হাশেমের সংগে! ততদিনে দিলারা হাশেমের একাধিক বই বেরিয়েছে। এতোদিন যার সংবাদ পাঠ শুনে বিমোহিত হয়েছিলাম- সেই দিলারা হাশেম আমার চোখের সামনে! ইতোমধ্যেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ঘর মন জানালা' বইটি আমাকে ভীষণ রকম আকর্ষণ করেছিল। দিলারা-সুরাইয়া-হাসান মূলত কবিতা-সাহিত্য নিয়েই কথা বলছিলেন। এই সব কথার মাঝেই ঝকঝকে সুন্দরী তন্বী এক মহিলা ঢুকেন। আমি মহিলাকে চিনি মনে হচ্ছে- কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিনা। তখন হাসান ভাই আমাকে তার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিলেন- "ইনি হচ্ছেন দীলশাদ খানম, রক্ত কবরীর নায়িকা- এনারা তিন বোন। সবার ছোট দীলশাদ"!
দিলারা হাশেমের ছোট বোন নাট্যশিল্পী দিলশাদ খানমের অভিনয় আশির দশকে তরুণদের পাগলপারা করে দিয়েছিলো। দিলারা হাশেম, সুরাইয়া খানম এবং দীলশাদ খানম তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন।
দিলারা হাশেম ছিলেন এক পরিশীলিত আধুনিক মানুষ। তাঁর সাজ-সজ্জায়, কথা-বার্তায়, চলনে-বলনে, জীবন-যাপনে একজন আধুনিক ব্যাক্তিত্বের ছাপ ছিল পরিস্ফুট। সেই সঙ্গে মিশেছিলো তাঁর পরিশীলিত রুচি - লেখা-পড়ায়, গান ও চিত্রকলায় তথা পেশাগত জীবনে। এ সব মিলিয়ে দিলারা হাসেম ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এক অনন্য মানুষ।
দুই দিন আগে, অর্থাৎ ১৯ শে মার্চ ইন্তেকাল করেন 'ঘর মন জানালা'র দিলারা হাশেম। আমার চেতনায় ভেসে ওঠা 'রেডিও পাকিস্তান। খবর পড়ছি দিলারা হাসেম'।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




