সংসদ ভবন চত্বরে সোনালী বিকেলঃ
সূর্য পশ্চিম আকাশে একটু হেলে পড়লেই শুরু হয় লোকজনের আনাগোনা। সূর্য যত পশ্চিমে হেলতে থাকে লোকজনের ভিড় ততই বাড়তে থাকে। তবে সন্ধ্যার পর পরই আবার ফাঁকা হয়ে যায় পুরো এলাকা। বিকেল থেকেই চলে জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা। নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে যতটুকু জায়গা আছে ততটুকুই। তার সঙ্গে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে ভ্রাম্যমাণ হকার আর দোকানিরা। পসরা সাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে তারা। চটপটি-ফুচকা, বাদাম-মুড়কি, হালিম, মিনি চাইনিজ, শীতের ভাপা ও চিতই পিঠা এবং চা-কফি তো আছেই। খাবারের দোকানের পাশাপাশি রয়েছে ছোট্টমণিদের খেলনার দোকান। দোকনগুলো স্থায়ী নয়, তবুও এমনভাবে সারিবদ্ধ, দেখলে মনে হয় পরিকল্পনা করে সাজানো। রয়েছে আরো বিচিত্র সব আয়োজন। একদিন বিকেলে হাঁটতে গেলেই বার বার জায়গাটি যেন সবাইকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। অবরুদ্ধ নগরজীবনে খোলা আকাশের নিচে এমন সাজানো বাগানে কার না আসতে মন চায়? হ্যাঁ, মহানগরী ঢাকায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার এই জায়গাটির নাম সংসদ ভবন চত্বর- বুড়ো-বুড়ী, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, ছোট্টমণিদের কাছেও এ জায়গাটি পরম প্রিয়, আকর্ষণীয়। ফেসবুকে আমাদের একটা গ্রুপ আছে। গত দশ/বার বছর যাবত আমাদের এই গ্রুপটা বছরে একাধিকবার এখানে গেটটুগেদার করে আসছি!
অপেক্ষার প্রহরঃ
আমি লক্ষ্য করি- সংসদ ভবনের সামনে একটি মেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। বার বার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা। চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। একটু পরেই ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি আর মুখে অভিমানের অভিনয়। প্রিয়জন এসেই অভিমান খাড়া করে নানা অজুহাত। তারপর দু'জনের মুখে হাসি, পরে হাত ধরাধরি। খুব কাছাকাছি পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। খুঁজতে থাকে বসার জায়গা। বিকেলে নরম ঘাস। তার ওপর রুমাল বিছিয়ে দু'জন দু'জনার মুখোমুখি। চলে কথার আদান-প্রদান। অভিমান, অনুরাগ। তার সঙ্গে যোগ হয় চিনা বাদাম কিংবা চটপটি, ফুচকা। মধ্য দুপর-বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে দু'জনের বর্তমান-ভবিষ্যতের হিসাব-নিকাশ।
"ফুল নেবে গো, ফুল"- কথামালার ঝুরি নিয়ে তাদের এই পরম আনন্দ মুহূর্তে হাজির হয় ছোট ছোট শিশুরা। হাতে বনফুলের মালা। দু'জনের মধ্যে ফুল-ফুলের মালা বিক্রেতা শিশুরা বেছে নেয় ছেলেটিকে। বলতে থাকে - "আপনাদের দু'জনকে খুবই মানাইছে। ভাইয়া, আপুরে ১০ টাকা দিয়া একটা মালা কিইন্যা দ্যান। নাইলে দশটা টাকা দেন, পিডা কিইন্যা খামু"। বিরক্তিতে তাদের তাড়িয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। এমনি ধরনের অনেক জুটিই ভিড় করে এখানে। ছিন্নমূল ছোট ছোট শিশুদের ছোট ছোট বিরক্ত ছাড়া আর কোন সমস্যা নেই এখানে। এটি তাদের পছন্দের জায়াগা।
দল বেঁধে আড্ডাঃ
শীতের পড়ন্ত বিকেলে আপনজনদের মধ্যে যদি আড্ডা হয় এক খোলা আকাশের নিচে তবে তো মহাআনন্দের ! আর তাই চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ কোন রেস্তোরাঁ বা কফি হাউজে না গিয়ে অনেকেই বেছে নিয়েছেন সংসদ ভবনের সামনে খোলা মুক্ত প্রাণবন্ত এই সবুজ চত্বরটি। দল বেঁধে ছুটে আসে তারা। একে অপরকে জানা আর সুখ-দুঃখের গল্পে স্মৃতিময় হয়ে থাকে জাতীয় সংসদ ভবনের এই প্রাঙ্গণটি। আমার সাথে এখানে পরিচয় হয় চার ক্ষুদে বন্ধুর। সনি, রবিন, ঈশিতা আর সুমি। তারা প্রায়শই এখানে ঘুরতে আসে। তাদের অত্যন্ত পছন্দের জায়গা এটি। এখানকার ফুচকা-চটপটিওয়ালারা তাদের দেখলেই ফুচকা কিংবা চটপটি নিয়ে হাজির হয়।
পরিবারের সদস্যরাও খুঁজে বেড়ায় একটু শান্তিময় খোলা জায়গা। সুযোগ পেলেই পরিবারের সদস্যরা মিলে ছুটে যায় সংসদ ভবন চত্বরে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে হাজির হয় কেউ কেউ। ছোট্টমনিরা বাবার হাত ছেড়ে ঘুরে বেড়ায় একা একা। কখনও ছোট ভাইয়ের হাত ধরে। বাবা-মা কোন এক কোণে বসে বাকি জীবনের হিসেব যেন সেরে নেয়। কখনো কখনো ছেলে আবদার করে বেলুন কিংবা ছোট ছোট খেলনা কিনে দেয়ার জন্য। ছেলের আবদার রাখতে দর-দাম করে দোকানিদের সাথে। এখানে কিছু সংঘবদ্ধ টাউট ফেরিওয়ালা আছে-যারা জোড় করে খাবার গছিয়ে দিয়ে পরে গলাকাটা দাম দিতে বাধ্য করে। ওদের সাথে পুলিশের আন্ডারস্টান্ডিং আছে। ওদের মেইন টার্গেট নিরীহ ভদ্র ফেমিলী এবং কিশোর কিশোরী কপোত-কপোতী।
ভিন্ন চেহারায় নামে সন্ধ্যাঃ
সূর্য ডোবার সাথে সাথে পাল্টে যেতে থাকে সংসদ ভবন এলাকার চিত্র। বিকেলের ক্ষণিকের অতিথিরা ফিরে যায় ঘরে। দোকানিরা সবকিছু গুছিয়ে নেয় বাড়ি যাওয়ার জন্য। বেড়ে যায় যায় পুলিশের টহল। বিকেলে তাদের কাজের মধ্যে থাকে দোকানিদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা তোলা। সন্ধ্যার পর চলে যায় একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত্রি শুরুর সাথে সাথে আসতে থাকে ভাসমান দেহপসারীরা। খদ্দেরের আশায় অপেক্ষা করতে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। এখানে এক শ্রেণীর দালাল আছে। যারা যৌনকর্মীদের খদ্দের যোগাতে ব্যস্ত থাকে। রাস্তার একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। খদ্দের আসলে চুক্তি হয় তাদের মধ্যে। পুলিশ টহল থাকার পরেও সন্ধ্যার এই দৃশ্য দেখা যায় প্রতিদিন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দেয়া হয় তাদের।
দোকানিদের সুখ-দুঃখঃ
বাহারি নামের দোকান দেখে মুগ্ধ না হওয়ার কারণ নেই। নাম শুনেই অবাক হতে হয়। "ইয়ানতুন খাই যান", "চায়না টাউন", "ধুম-ধাড়াক্কা" আর "ইভিনিং ভ্যালি" নাম। কিছু চটপটি-ফুচকার দোকান, কিছু মিনি চাইনিজ। ফুচকা আর গরম গরম হালিমের চাহিদাই আলাদা। দিনে হাজারো লোকের আনাগোনা এখানে। যত বেশি মানুষের ভিড়, তত বেশি দোকানিদের আনন্দ। বিশেষ করে শুক্রবারের তথা ছুটির দিনের অপেক্ষায় থাকে তারা। শুক্রবার এলেই দুপুর থেকেই নেমে পড়ে খাবার নিয়ে। কোন কোন দোকানি আসে শুধু খেলনা নিয়ে। কেউ আসে ওজন আর দৈর্ঘ্য মাপার যন্ত্র নিয়ে। কেউ বা নানা রং-বেরংয়ের বেলুন নিয়ে। বিকেলে লাল, নীল, গোলাপী রংয়ের এই বেলুনগুলোই শোভা পায় ছোট ছোট শিশুদের হাতে। দাম নিয়ে কারো কোন আপত্তি নেই। তবে দু'একজনের সেই চিরন্তন অভিযোগ-"গলা কাঁটা দাম"! কিম্বা- "তুলনামূলক একটু বেশি। আর তাতো হবেই"।
শীত বিকেলে পিঠার মজাই আলাদা। গরম গরম ভাপা আর চিতই পিঠা। পিঠা তৈরির নানা সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয় গুটি কয়েক দোকানি। হাফিজউদ্দিন নামের এক পিঠা দোকানদারদারের সাথে কথা বলে জানলাম- প্রতিদিন পিঠার পসরা নিয়ে হাজির হন এখানে। দিনে ৫শ' থেকে ৬শ' টাকা বিক্রি। এতে লাভ হয় ৫০%। তবে প্রতিদিন পুলিশকে দিতে হয় ৫০-১০০ টাকা। চটপটি দোকানিরা দেয় পঞ্চাশ টাকা।
সংসদ চলাকালীন বেচা-কেনা কম হয়। তারউপড় সংসদ চলাকালীন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার যুবক নেতারা হয়ত একশত টাকার খেয়ে ২০ টাকা দিয়েই চলে যায়- বলে জানালেন কয়েক দোকানদার(এই পলিটিক্যাল ভবঘুরে নেতাদের এখানকার ভ্রাম্যমান হকার/দোকানীরা 'চ' বর্গের "বিশেষ" একটা নামে সম্বোধন করে-যা এখানে লিখা সম্ভব নয়)।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




