আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা....
"ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল"- প্রসিদ্ধ হলেও বরিশালে পেয়ারা, আমড়া, নারিকেল, সুপারিও প্রচুর ফলে। অবশ্য সেটা বৃহত্তর বরিশালের ইতিহাস। বৃহত্তর বরিশাল ভাগ হয়ে এখন ছয়টি জেলা হয়েছে। যথা- বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনা। বৃহত্তর বরিশালে ঐতিহ্যও এখন ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গিয়েছে।

একদা দেশে পেয়ারার মূল চাষাবাদ হতো বরিশাল জেলায় এবং সেই পেয়ারা দেশের বড়ো একটা চাহিদার যোগান দিতো। পেয়ারা চাষের মূল এলাকা বর্তমানে পিরোজপুর জেলার সরুপকাঠী থানা এবং ঝালকাঠি জেলার সদর উপজেলার কিছু এলাকা। বৃহত্তর বরিশালের সেই ঐতিহ্যবাহি পেয়ারা বলতে গেলে প্রকৃতিক দান। যা চাষাবাদ করে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহার করা হতোনা। সেই পেয়ারা 'আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা' নামেই স্থানীয় ভাবে পরিচিত। তবে এখন হাইব্রিড পেয়ারাও ব্যপক ভাবে চাষ হচ্ছে। আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারার আলাদা একটা স্বাদ এবং ঘ্রাণ আছে যা অন্য পেয়ারা থেকে সহজেই আলাদা করা যায়।

আমার ছাদ এবং বারান্দায় তিনটি পেয়ারা গাছ আছে। যার একটা আটঘর কুড়িয়ানা থেকে আনিয়েছিলাম। সেই গাছে এ বছর ১৪ টা পেয়ারা ধরেছে। পেয়ারাগুলো মোটামুটি বড়ো হতেই গাছটা ছাদ থেকে বারান্দায় নিয়ে এসেছি। হাইব্রিড থাই পেয়ারা গাছে ২৮ টা এবং রাজশাহী জাতের গাছে ৪৫ টা পেয়ারা ধরেছে।

আমার ছাদবাগানের নতুন জাতের থাই পেয়ারা পাকলে ভেতরে গোলাপি এবং লাল রঙ হয়। কিন্তু স্বাদ ঘ্রাণ নাই বললেই চলে বরং পানসে। রাজশাহী জাতের পেয়ারা সুস্বাদু তবে ঘ্রাণ কম। অন্যদিকে বরিশালের (বর্তমান পিরোজপুর জেলার সরুপকাঠী- নেছারাবাদ থানাধীন আটঘর কুড়িয়ানা) পেয়ারা অত্যন্ত সুস্বাদু এবং অত্যাধিক সুঘ্রাণ। দুই ছেলে ও নাতনীকে আটঘর কুড়িয়ানার কাচা এবং পাকা পেয়ারার আলাদা স্বাদ বোঝাতে তিনটা পেয়ারা গাছেই পাকানো হয়েছে।

আটঘর কুড়িয়ানা শুধু পেয়ারার জন্যই বিখ্যা নয়। আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং দেয়া হতো। এই এলাকাটা মূলত হাওর/বিল এলাকা। চারিদিকে ছোট ছোট খাল এবং গভীর পেয়ারা বাগান বেষ্টিত। এলাকার ৭০ ভাগ বাসিন্দাই সনাতনধর্মাবলম্বী। অত্যন্ত দূর্গম এলাকা বিবেচনায় এখানে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিল। যারা এখানে ট্রেনিং নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন করে আবার এই এলাকায় ফিরে আসতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা ছিলো- এই দূর্গম এলাকায় পাক সেনারা আসবেনা। কিন্তু সেই ধারণা বিফল প্রমাণীত করে পাকসেনারা বারবার এই এলাকার নিরীহ জনতার উপর বর্বর হত্যা ও ধর্ষণযহজ্ঞ চালিয়েছে। এলাকার নারীমুক্দেতি যোধাদের একটা সাহসী একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করবোঃ-
"ডেডলাইন ১১ জুলাই, একাত্তর। বৃষ্টি পড়ছে টিপ টিপ। রাতের অন্ধকারে কোমরে রিভলভার আর হ্যান্ড গ্রেনেড গুঁজে নৌকায় উঠে বসেন দুই তরুণী। লক্ষ্য কুড়িয়ানার কাছে লঞ্চঘাটে নোঙর করা পাকবাহিনীর ৩টি ছোট গানবোট। একটা গানবোটে ছিল কুখ্যাত ক্যাপ্টেন এরশাদ। গানবোটের সার্চলাইটের আলোয় আলোকিত নদীর জল। কিছুক্ষণ পর দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা নৌকা থেকে নেমে কচুরিপানায় আড়াল করে নিঃশব্দে সাঁতার কেটে এগিয়ে চললেন। সামনেই মৃত্যু দূত। সামান্য ভুলেই মেশিনগানে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে শরীর।
আরেকবার সার্চ লাইটের আলো এসে পড়ার আগেই তারা মিশে যান মাঝখানের গানবোটের সঙ্গে। আর সময় নষ্ট নয়। দাঁত দিয়ে গ্রেনেডের পিন খুলেই ছুঁড়ে মারেন গানবোটের ওপর। মুহূর্তের মধ্যেই আগুনের গোলায় পরিণত হয় গানবোটটি। তীরের দিক থেকে হামলা হয়েছে ভেবে সেদিকে গুলি ছুড়ে অন্য লঞ্চ দুটিতে থাকা পাকসেনারা। কৌশলে ঘাটের পাশের সিঁড়ির অন্ধকারে আশ্রয় নেন ২ সাহসী তরুণী। গুলি থেমে গেলে ফিরে যান মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। যাকে হত্যা করতে জীবন বাজি রেখে ওই দুঃসাহসী অভিযান চালিয়েছিলেন সেদিনের তরুণী বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণা। কিন্তু সেই কুখ্যাত খুনি এরশাদ বেঁচে যায়। তবে মারা যায় কয়েকজন পাকসেনা।
মহান একাত্তরে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন দেশের নারীরা। কেউ লড়েছেন অস্ত্র হাতে, কেউ যোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পাকবাহিনীর গোপন খবর। কেউ চিকিৎসক হিসেবে, সেবিকা হিসেবে আবার কেউ রাঁধুনী হিসেবেও কাজ করেছেন স্বাধীনতার জন্য। তবে নারীরা যে পরিমাণ অবদান রেখেছেন সেই সম্মান তারা পাননি। ইতিহাস মনে রাখেনি বীথিকা বিশ্বাস ও শিশির কণার মতো সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে। বিজয়ের পর বিয়ের সূত্রে ভারতের ওড়িষায় চলে যান বীথিকা বিশ্বাস। আর শিশির কণা পিরোজপুরে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি নেন।"-("-"এই অংশটুকু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে সংগৃহীত)।
দেশে খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুজন আর গেজেটভুক্ত নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩২২ জন। উল্লেখ্য যে, আটঘর কুড়িয়ানা এবং বৃহত্তর বরিশাল জেলায় নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৮৮ জন! ক্যাপ্টেন সেতারা(বীর প্রতীক) মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হায়দার বীর উত্তম এর ছোট বোন। ক্যাপ্টেন সেতারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর হেড কোয়ার্টার বুকাবুনিয়ায় এসেছিলেন- তখন তাঁকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমারও।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




