somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

স্বপ্ন দেখবো বলে আমি দু’চোখ পেতেছি......

২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বপ্ন দেখবো বলে আমি দু’চোখ পেতেছি......

‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউয়ে চেপে
নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো,
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
নোনা বালি তীর ধরে
বহুদূর বহুদূর হেঁটে এসেছো।’

মৌসুমী ভৌমিকের এই গান আমার খুব প্রিয়। প্রায়শঃই শুনি, আমার বাড়ীর বারান্দায় বসে বাইরের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে। ঠিক কি আছে, গানটাতে আমি জানি না, কিন্তু শুনতে শুনতে চোখের দৃষ্টি উদাস হয়ে যায়, মনটা হু হু করে ওঠে, কেমন একটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায় হৃদয়।

মৌসুমী ভৌমিক আমার অন্যতম প্রিয় শিল্পী। বেশ কয়েক বছর আগে ফরিদপুর এসেছিলেন। তখন হোস্টের আমন্ত্রণে তার বাড়িতে সীমিত সংখ্যক অতিথিদের সাথে সামনে বসে তাঁর গান শুনেছিলাম। তিনি যখন গেয়ে ওঠেন-

‘আমি কখনো যাই নি জলে,
কখনো ভাসিনি নীলে,
কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাঙচিলে,
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে,
আমাকেও সাথে নিও,
নেবো তো আমায়, বলো নেবে তো আমায়?’

এ আর্তি বাতাসকে চিরে প্রতিধ্বনিত হয়, চোখ ছাপিয়ে যায় জলে, মাথার মধ্যে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে’ কে যেন কথা কয়, ‘নেবে তো আমায়? নেবে তো?’
যতবার গানটা শুনি, এ লাইন গুলো শুনলেই কেমন যেন আনমনা হয়ে যাই- কত কথা মনে হয়, কতজনের কথা ভাবি- কিছু না দেখার কথা, কিছু তৃষিত আকাঙ্খার- সবই ঐ সমুদ্র নিয়ে।

একজন সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলো তার মা-বাবার কথা। ছেলের কাছে বেড়াতে এসেছেন তাঁরা। ছেলে, ছেলে-বৌ, নাতিরা মিলে সযত্নে নিয়ে গেছে মা-বাবাকে সমুদ্রসৈকতে। সমুদ্র-দর্শনে দু’জনেই উল্লসিত ও উদ্ভাসিত। ছেলে স্মিতমুখে বাবা-মাকে বলছে, ‘আগে বঙ্গোপসাগরের ঘোলা পানি দেখেছেন, এবার আটলান্টিকের নীলজল দেখলেন- কোনটা বেশি ভালো?’। ছেলেকে অবাক করে দিয়ে মা-বাবা জানালেন যে এর আগে দু’জনের কেউই সাগর দেখেননি।

পুত্রটি হতবাক! প্রতিষ্ঠিত পরিবার, মা- বাবা দু’জনেই ভালো চাকুরে ছিলেন, কিন্তু এর আগে কোনদিন সমুদ্র দেখেননি! অথচ দেশে থাকতে ছাত্র জীবনেই বাবা-মা'র থেকে টাকা নিয়ে ছেলেটি কতবার কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা গেছে বন্ধুদের সঙ্গে। অথচ তার মা-বাবা এর আগে সমুদ্র দেখেননি! কিছুটা লজ্জিত হয়ে মা’কে প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘চাকরি, সংসার, তোমাদের ভাই-বোনদের সামলিয়ে সময় হয়নি’।



আমার প্রিয় বন্ধু দেবু ওদের মা (আমি কাকীমা ডাকি) যখন ভীষন অসুস্হ, তখন দেবু ওর মা’কে জিজ্ঞেস করেছিল, 'মা তোমার কি খেতে ইচ্ছে করে?'
খুব নরম স্বরে তিনি বলেছিলেন- "দেবু, আমি সমুদ্র দেখিনি- আমার সমুদ্র দেখা এবং সমুদ্র স্নানের খুব ইচ্ছে হচ্ছে।"
দেবু নিজে ড্রাইভ করে ওর মা'কে কক্সবাজার নিয়ে গিয়েছিলো। সাথে দেবুর স্ত্রী এবং ওদের একমাত্র ছেলে। তখন কাকীমা হাঁটতে পারতেন না তাই তাঁকে একটি রিক্সা ভ্যানের পাটাতনের ওপরে বসিয়ে সাগরের পানি আর ঢেউয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।

দেবু আমাকে বলেছিল- সমুদ্রের দিগন্ত রেখার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মা'র দু’চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। তিনি মৃদুস্বরে বলেছিলেন, ‘তিনি কল্পনায় যে সমুদ্র দেখেছেন, তার চেয়ে বাস্তবের সমুদ্র অনেক বেশী সুন্দর।’ সবাই মিলে রিক্সা ভ্যানটিকে জলে নামালে সমুদ্রের ঢেউ লোনাজল তাঁকে সিক্ত করে দিয়েছিল- মায়ের চোখেমুখে তৃপ্তির ঝিলিক। বহুকালের একটি লালিত আকাঙ্খা তাঁর পূরণ হয়েছিল। এ ঘটনার পরে তিনি আর বেশীদিন বাঁচেননি- বলতে বলতে দেবু কান্না করছিলো.....

আমি প্রথম বহুদূর থেকে সমুদ্র দেখি- যখন আমি ১০/১১ বছরের বালক। বাবার পোস্টিং তখন রিসালপুর এয়ার বেইসে। তিনি ছুটিতে এলে বুবু আর আমাকে নিয়ে ঢাকা থেকে গ্রীন অ্যারো ট্রেনে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে কুমীরার কাছাকাছি এলে যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কারন ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে ক্ষণিকের জন্য বঙ্গোপসাগরের এক চিলতে রূপোলী পানি দেখা যেত। বাবা আমাকে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখিয়েছিলেন। তেমন কিছু মনে হয়নি আমার, হতবাকও হইনি, সাড়া তোলেনি আমার বালক হৃদয়ে বরং সারি সারি ঝাউগাছ আমার ভালো লেগেছিল।

কিন্তু কলেজ জীবনে যখন বঙ্গোপসাগরের তীরে দাঁড়িয়েছি, তখন তার বিশালত্ব, অবিরাম গর্জন, ঢেউয়ের মাথা কুটে মরার চিত্রপটের সামনে হতচকিত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল এবং কেন জানি চোখ ছাপিয়ে পানি এসেছিল। তারপর এ দীর্ঘ পাঁচ দশকে কত সমুদ্র দেখেছি। এ জীবনে তিনটি মহাসাগর দেখেছি, অনেকগুলো সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়েছি, বহু উপসাগরের জলে পা ভিজিয়েছি। সমুদ্র এখনও আমাকে আবিষ্ট করে রাখে, তরঙ্গ এখনও আমায় টানে, সমুদ্র-তৃষা আমার আজও আকণ্ঠ।

আমি আমার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বেশ কয়েকবার কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে গিয়েছি। দেশ বিদেশে অনেক বেড়িয়েছি.....কিন্তু ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবরের পর ২০২২ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে যাওয়া হয়নি। আমাদের গোটা পরিবারের সদস্যরা এক দুঃসহ অবস্থায় ছিলাম....কিন্তু জীবন থেকে থাকে না। ২০২৩ সাল থেকে কয়েকবার সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম, ব্রাম্মণবাড়িয়া, বরিশাল, ভোলা যাওয়া হয়েছে নিতান্তই প্রয়োজনে। কিন্তু এই সময়ে আমার স্ত্রী ঢাকার বাইরে কোথাও যাননি। সকল মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর আমাদের না জানিয়েই সস্ত্রীক ছেলেরা, নাতনিকে দিয়ে সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজারে সাত দিনের ট্যুর প্রোগ্রাম করে....২০১৬ সালের পর আবারও আমরা সবাই মিলে বেড়ায়ে এলাম.....আমার পাসপোর্ট সীজ করেছিল র‍্যাব...আমার পাসপোর্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তিনটি দেশের মাল্টিপল ভিসা ছিলো....ইতোমধ্যেই আমাদের দুজনেরই পাসপোর্ট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ছেলেরাই দুজনের নতুন পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছে- আমরা দুজন শুধু নির্ধারিত দিনে ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। আমাদের ওমরাহ হজ্জের জন্য ব্যবস্থা করেছে....আলহামদুলিল্লাহ।



আবার ফিরে আসি সমুদ্রে। সমুদ্র দেখতে কি সবসময়ে জলরাশির সমুদ্রের কাছে যেতে হয়? তা কিন্তু নয়। আমাদের আশে পাশে অনেক মানুষ আছেন যাঁদের হৃদয়ে মমতার সমুদ্র, কথায় মায়ার সমুদ্র, আর চোখে স্বপ্নের সমুদ্র। সূদূ্রের জলের সমুদ্রের আকাঙ্খায় আমরা যেন আমাদের চারপাশের মায়ার, মমতার আর স্বপ্নের সমুদ্রে ডুব দিতে ভুলে না যাই। তখন মৌসুমীর গানের শেষ চরনটি মনে পড়ে যায়, ‘তাই স্বপ্ন দেখবো বলে আমি দু’চোখ পেতেছি....’।

(পুরনো লেখাটা এডিট করে হালনাগাদ করেছি)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৫৮
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×