শিরোনামহীন.....
ফেসবুকে আমার পোস্টে একটা শিরোনাম থাকে কিন্তু এই পোস্টের কোনো শিরোনাম দিতে পারছিনা.... আমার তথা আমাদের ছেলেবেলার ফ্রেন্ডস সার্কেলে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ চারজন হারুন আছেঃ হারুন অর রশীদ, হারুন উর রশীদ, হারুন আল রশীদ এবং আহমেদ হারুন। তবে আমাদের কাছে সবাই হারুন হলেও ওদের কিছু মুদ্রাদোষ ইংগিত করে নামের আগে পিছে কিছু বিশেষণ লাগিয়ে আলাদা করা আছে সেই ছেলে বেলা থেকেই। যেমন, ড্যাব্রা হারুন(হারুন অর রশীদ), মুতা হারুন(হারুন উর রশীদ), কাউস্যা হারুন(হারুন আল রশীদ) এবং কৈতর হারুন(আহমেদ হারুন)!
ড্যাব্রা হারুনঃ ন্যাটা (Left-handed) বাম হাতে খেতো, লিখতো তথা ৮৫% হাতের কাজ বাম হাতে করে। খুব ভালো গীটার বাজাতো। ওদের হোম ডিস্ট্রিক্ট কুমিল্লা। জিগাতলার বাসিন্দা। ওল্ড গ্রেগরিয়ান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সহপাঠী। সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরে গিয়েছে। বর্তমানে বেগম পাড়ায় স্থায়ী নিবাস।
মুতা হারুনঃ কিছুক্ষণ পরপরই প্রশ্রাব করতে যেতো। ওরা উত্তর বংগের হলেও ঢাকার কলাবাগানে স্থায়ী নিবাস। ছেলেবেলা আমরা একসাথে কলাবাগান এবং ধানমণ্ডি মাঠে খেলতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার সহপাঠী, লোকপ্রশাসনে অনার্স-মাস্টার্স করে কয়েক বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরে ল' পাশ করে। আইনজীবীর ছেলে, নিজেও প্রখ্যাত আইনজীবী।
কাউস্যা হারুনঃ ছেলে বেলা থেকেই ওর কাশির সমস্যা ছিলো। ওর পাশে দাঁড়ালেও ওর বুকের/গলার ভিতর কাশির শব্দ শোনা যেতো। গলায় বেশ কয়েকটি তাবিজ-কবচের অলংকার ছিলো...বয়স বাড়ার সাথে এবং বিয়ের পর কাশির ব্যারাম ভালো হয়ে গেলেও আমাদের কাছে কাউস্যা হারুনই থেকে যায়। ইংন্ডেন্টিং ব্যাবসায় সফল।
কৈতর হারুনঃ আদি ঢাকাইয়া। কবুতর পুষতো... সেখান থেকেই কৈতর হারুন। সেই আদিকাল থেকে এখনো ওদের বাড়িতে প্রতিদিন সকালে বিরিয়ানি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে। কৈতর হারুন ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুলে পড়তো। ভয়ংকর ডানপিটে কবুতরের পিছনেই ঘুরেঘুরে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সেই ৭২ সনে যখন স্কুলের টেবিল চেয়ার এবং বাড়ির কাজের বুয়াও পরিক্ষা নাদিয়ে 'মেট্টিক পাশ' করেছিলো তখন ওদের ব্যাচে ফেলকরা দুইজন বিখ্যাতদের একজন ছাত্র কৈতর হারুন! আরও দুইবার পরিক্ষা দিয়েও একই রেজাল্টের হ্যাট্রিক করে। ওদের পরিবার ওকে বিয়ে করিয়ে দেয় ওর আপন মামাতো বোনের সাথে (ঢাকার একদা খুব বিখ্যাত নাজিমুদ্দিন লাচ্চা সেমাই কোম্পানির মালিকের মেয়ে। নাম 'মিস বিউটি বেগম', আমরা মজা করে ডাকি- "বিউটিফুল ভাবী" কখনো "কৈতুরি ভাবী")।
কৈতর হারুন আজিমপুরের বিখ্যাত বেবী আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মালিকের ছেলে। ওদের চুড়ির কারখানা, হারিকেনের চিমনি, গ্লাস ফ্যাক্টরি, ফাউন্ড্রি ফ্যাক্টরি ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যবসার সহযোগী হয়ে পরবর্তীতে আরও বড়ো ব্যবসায়ী। সত্যিকারের লায়ন হার্ট মানুষ! হারুনের স্ত্রী ইডেন কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
আমাদের এই সার্কেলের কৈতর হারুন বছর তিন চারের বড়ো, আর সবাই প্রায় সমবয়সী এবং ক্লাসমেট। ছাত্রজীবন শেষে, পেশাগত জীবনে কার কি পেশা, কে কত ধনী কিম্বা আর্থিক ভাবে কমজোরি - সেটা কখনোই মূখ্য ভূমিকা রাখেনি। বরং আমাদের বন্ধুত্বের বন্ডিংসটাই প্রধান পরিচয় হয়ে আছে।
ব্যক্তি জীবনের নানান টান পোড়নে অনেক দিন কোনো হারুনের সাথে যোগাযোগ করা হয়না। কাল একটা মামলায় হাজিরা দিতে এসে মুতা হারুন (হারুন উর রশীদ) এডভোকেট এর সাথে দেখা। অনেকটা টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় ওর চেম্বারে। স্বাভাবিক নিয়মেই অন্য হারুনদের প্রসঙ্গ চলে আসে। হঠাৎই কৈতর হারুনকে ফোন দেই। প্রথমবার ফোন রিসিভ করেনি। ১৫ মিনিট পর আবার ফোন করলে ওপ্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ করতেই বলি- "আবে কৈতর, সুবাকালে বিরিয়ানি খিলাইছোস, আর অহন উপ্তাকালে নিদাও?"
(কৈতর হারুনের সাথে আমরা ওর মতোই ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করি)।
ওপ্রান্ত নিরুত্তর! আবারও আমি চিল্লায়ে বলি, "আবে হালায় কতা কয়না কিলা, কানের ভিত্রে ভি তূলা সান্ধাইয়া থুইছোচ?"
এবার ফোনের অপর প্রান্তে ফুফিয়ে কাঁদছে... "হিমু ভাই, আপনাগোর কৈতর হারুন আর কথা কইবোনা...ও আইজগা চাইদ্দিন অয় মইরা গেচে!"
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহী রাজিউন।
(২০২০ ফেসবুক মেমোরি থেকে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


