somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

এক্টিভিজম মানেই সাফারিং!

৩০ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ৮:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
এক্টিভিজম মানেই সাফারিং!


কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এই সাফারিং-ই একদিন বদলে দেয় রাষ্ট্র ও সমাজের গতিপথ। বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো কিছু তরুণের কষ্টই হয়ে ওঠে একটি জাতির মুক্তির আলো। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গন আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, জুলাই আন্দোলন কিংবা শেখ হাসিনা বিরোধী গণআন্দোলনে- যারা মাঠে ছিলেন, তারাই জানেন এক্টিভিজম মানে কেবল স্লোগান নয়, বরং ত্যাগ ও কষ্টের আরেক নাম।

গ্রেফতার, মামলা, নির্যাতন, চাকরি হারানো, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া- এগুলোই বাস্তবতার অংশ। রাস্তায় দাঁড়ানো মানে নিরাপত্তাহীনতা বরণ করা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করা।

প্রেক্ষাপটঃ স্বৈরশাসক এরশাদ- স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ছিলো এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। ছাত্র-জনতার রক্ত, ত্যাগ আর অবিরাম সংগ্রামের পথ বেয়ে পতন ঘটে এক সামরিক স্বৈরশাসকের। শহীদ জেহাদ, শহীদ নূর হোসেনের বুকে লেখা- “গণতন্ত্র মুক্তি পাক”- আজও আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। গণতন্ত্রের জন্য সেই সংগ্রাম শুধু ইতিহাস নয়, আজও প্রাসঙ্গিক। কারণ গণতন্ত্রকে দমন করতে চায় যারা, তাদের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যই চূড়ান্ত শক্তি।

স্বৈরশাসক এরশাদের পতন কোনো হঠাৎ ঘটনা ছিল না; ছিল রক্তে লেখা সংগ্রামের ফল। ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে দেওয়া সেই আন্দোলন ছিলো জনতার ঐক্যের মহাকাব্য- যেখানে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক সবাই এক কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলো- "একদফা এক দাবী, এরশাদ তুই কবে যাবি"!

আজও যখন গণতন্ত্রকে কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা দেখি, তখনই শহীদ দেলোয়ার, শহীদ জেহাদ, শহীদ ডাক্তার শামসুল আলম, শহীদ নূর হোসেনদের রক্ত ঝলসে ওঠে বুকের ভেতর। কারণ গণতন্ত্র কখনো দয়া ভিক্ষায় আসে না- আসে সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।

বর্তমান প্রজন্মের যারা মাঠে আছেন, তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই- ত্যাগ ছাড়া কোনো বিজয় আসে না। ২০০৭ সালে ১/১১ সরকার তথা সেনাতত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল ছদ্মবেশী সামরিক শাসন ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে তরুণদের জেগে ওঠা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রাজপথ- সর্বত্রই আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার, মামলা, লাঠিপেটা, হয়রানি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। অনেকেই শিক্ষা হারিয়েছেন, কেউ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন, অনেকেই কর্মজীবনে স্থায়ী ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তবুও তারা পিছপা হননি। কারণ তারা জানতেন- ব্যক্তিগত কষ্টই একদিন জাতির সামষ্টিক মুক্তির ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।

এক্টিভিজম মানেই সাফারিংঃ ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ জুলাই আন্দোলন অর্থাৎ শেখ হাসিনা বিরোধী সংগ্রাম.....
বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- গণতন্ত্র, অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্রিয় এক্টিভিজম সবসময়ই চরম ত্যাগের দাবি করেছে। এক্টিভিজম মানে কেবল স্লোগান নয়; বরং জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলা। জুলাই আন্দোলন থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা বিরোধী চলমান গণআন্দোলন পর্যন্ত, সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের পথচলা ভরা কষ্ট, নির্যাতন ও বেদনার সাক্ষ্যে।

জুলাই আন্দোলনের পর্যবেক্ষণঃ
শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলন ও বাস্তবতা....
শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনও সেই ধারাবাহিকতার অংশ। এখানে সক্রিয় এক্টিভিস্টরা গ্রেফতার, গুম, মিথ্যা মামলা, শারীরিক নির্যাতন ও সামাজিক অপবাদ— প্রতিটি ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকের চাকরি নেই, অনেকেই পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নিরাপদে থাকতে পারেননি। অথচ তারা সহজেই সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তারা বেছে নিয়েছেন সংগ্রামের পথ- কারণ তারা বিশ্বাস করেন, গণতন্ত্রের জন্য ব্যক্তিগত ত্যাগই ইতিহাসকে বদলে দেয়।

[আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাঃ
আমি নিজেই এই সাফারিং-এর এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী। শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে আমাকে গুম করা হয়েছিল। গুম অবস্থায় আমার শরীরে বারবার বিদ্যুৎ শক দিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। পায়ের আংগুলের নখ তুলে ফেলে, হাঁটুতে, মেরুদণ্ড, এবং হাতের আংগুল ভেংগে দেয়। এরপর আমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একসাথে চারটি মামলা দেওয়া হয়। সেই মামলার অজুহাতে আমাকে সাত মাস কারাগারে বন্দি থাকতে হয়েছে।

এই দীর্ঘ গুম-গ্রেফতার-কারাবাস শুধু আমার ব্যক্তিগত জীবনকে নয়, আমার পরিবারকেও অসহনীয় কষ্ট দিয়েছে। প্রিয়জনেরা প্রতিদিন ভয়ে কাটিয়েছে- আমি আদৌ ফিরে আসব কি না। সমাজে নানাভাবে অপবাদ ছড়ানো হয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে স্ত্রী সন্তান ঢাকা মেট্রোর বিভিন্ন থানায়, আইজি, র‍্যাব ডিজি, ডিএমপি কমিশনার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অফিসে, বাড়িতে ধর্ণা দিয়েছে। আমার নিখোঁজ বিষয়ে থানায় একটা জিডি পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। জেল থেকে বের হলে খুব কম কথা বলা আমার স্ত্রী এক নিঃশ্বাসে ঝরঝর করে বললো- "দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে যেয়ে অজ্ঞাত নামা লাশগুলোর মধ্যে তোমার মুখটা খুঁজেছি....খবরের কাগজে যেখানেই অজ্ঞাতনামা লাশ পাওয়ার খবর দেখতাম- সেখানেই ছুটে গিয়েছি...." - তখন মনে হলো অমন বাকরুদ্ধ কষ্টের কাছে আমার উপর নির্মম নির্যাতনের কষ্ট কিছুই না! আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই সামাজিক ভাবে আমাদের এড়িয়ে গিয়েছে ভয়ে।

কিন্তু আমি এখনো বিশ্বাস করি, এই কষ্ট বৃথা যায় নাই।
ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে- ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন- প্রতিটি সংগ্রামেই ব্যক্তিগত কষ্ট ও ত্যাগের ওপর দাঁড়িয়েই এসেছে বিজয়। যারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে নির্যাতিত, গুম বা গ্রেফতার হয়েছেন, তারা নিছক রাজনৈতিক কর্মী নন; তারা ভবিষ্যতের ইতিহাস রচয়িতা। তাদের কষ্ট, ত্যাগের মহিমা হয়ে উঠবে ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রেরণা।

আমি আবারও বলবো-
এক্টিভিজম মানে কষ্ট; এক্টিভিজম মানে সাফারিং। কিন্তু সেই সাফারিং-ই একদিন সমাজ ও রাষ্ট্রকে নতুন রূপ দেয়। জুলাই আন্দোলন তথা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনের- প্রতিটি কর্মী ইতিহাসের ভবিষ্যৎ অধ্যায়ের নির্মাতা। সবাইকে রাজনীতি করতে হবে না। আর আমার মতো অসংখ্য কর্মীর ব্যক্তিগত সাফারিংই একদিন জাতির সামষ্টিক মুক্তির আলো হয়ে উঠবে। সেজন্য রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক হতে হবে না। আমরা সবাই রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক হবো, নাগরিক দায়িত্ব পালন করবো- তবেই আমরা আমাদের অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম হবো।
ধন্যবাদ সবাইকে।

(আজ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন কতৃক অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় "গুম সংস্কৃতি এবং এক্টিভিজম মানেই সাফারিং" আমার বক্তব্যের অংশ বিশেষ)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২৫ রাত ৯:০২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×