somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনার প্রয়োজনীয়তাঃ

২৩ শে নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা: একটি বাস্তবসম্মত বিশ্লেষণঃ

চট্টগ্রাম বন্দর শুধু একটি অবকাঠামো নয়- এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র। দেশের মোট আমদানি- রপ্তানির প্রায় ৯২% এই বন্দর নির্ভর। এই একটিমাত্র জায়গার কার্যকারিতা কতটা উন্নত বা অকার্যকর- সরাসরি তার প্রভাব পড়ে দেশের বাজারদর, শিল্প উৎপাদন, বৈদেশিক বাণিজ্য, মুদ্রাস্ফীতি, এমনকি জিডিপির উপর।

কিন্তু কয়েক দশক ধরে প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা, অদক্ষ মানবসম্পদ, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর সেই সম্ভাবনার অর্ধেকও কাজে লাগাতে পারেনি।
যেখানে আধুনিক বিশ্বে কনটেইনার আনলোড করতে লাগে ২৪–৪৮ ঘণ্টা, সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরে একই কাজ শেষ করতে লাগে ১২-১৬ দিন।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের স্বার্থে প্রশ্ন একটাই উঠে আসে—
এই বন্দর কি কেবল দেশীয় ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন সম্ভব, নাকি এখানেই বিদেশী অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা জরুরি?

বাস্তবতা বলছে-
বিদেশী অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব ছাড়া এই বন্দরের রূপান্তর সম্ভব নয়।
কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

(১) প্রযুক্তি ও দক্ষতার ভয়াবহ ঘাটতিঃ
বাংলাদেশে এখনো-
বিশ্বমানের বন্দর ইঞ্জিনিয়ারিং, অটোমেটেড টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট,বডীপ-ড্রাফট জাহাজ হ্যান্ডলিং, রোবোটিক স্ট্যাকিং, বার্থিং উইন্ডো ম্যানেজমেন্ট- এসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষ জনবল তৈরি হয়নি।

অন্যদিকে, যেসব বিদেশী প্রতিষ্ঠান ৩০-৬০টি বিশ্বমানের বন্দর পরিচালনা করছে, তাদের আছে-

৫০-৭০ বছরের accumulated experience, advanced logistics algorithms, modern equipment & lean operation system, real-time digital terminal operating software বাংলাদেশের প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা এখনো এসব প্রযুক্তি শেখার প্রাথমিক ধাপে। এই দক্ষতা ট্রেনিং সেন্টারে নয়-কার্যক্ষেত্রে শেখা যায়, এবং তা সম্ভব কেবল তখনই যখন বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান এখানে অপারেশন চালাবে এবং আমাদের জনবলকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেবে।

(২) বন্দর আধুনিক করতে দেশের নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা সীমিতঃ

একটি আধুনিক গ্রীন ও অটোমেটেড পোর্ট টার্মিনাল নির্মাণে বিনিয়োগ লাগে- ৩,০০০-৫,০০০ মিলিয়ন ডলার (৩০,০০০–৫০,০০০ কোটি টাকা) যা দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থার জন্য এই বিনিয়োগ বহন করা অত্যন্ত কঠিন। বিদেশী অপারেটররা নিজেরাই প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও অপারেশনাল খরচ বহন করে নেয়।
ফলে- সরকারের ওপর আর্থিক চাপ কমে, বিদেশী বিনিয়োগ দেশে আসে, ঝুঁকি ভাগ হয়ে যায়, প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়িত হয়, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য এটি অত্যন্ত লাভজনক।

(৩) অদক্ষতা, আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি—বন্দরের মূল বাধাঃ
চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে- সিন্ডিকেট,শ্রমিক-নেতাদের হাতে জিম্মি, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঘুষ–প্রথা, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রভাব- এই সবকিছু মিলেই বন্দরকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধীরগতির জায়গা বানিয়ে রেখেছে।
কারণ ধীরগতি মানেই- লোডিং–আনলোডিং বিলম্ব, প্রতিটি কনটেইনারে বাড়তি খরচ, আমদানি-রপ্তানিতে অতিরিক্ত চার্জ, সিন্ডিকেটের অবৈধ আয়।

একটি স্বচ্ছ ও বিশ্বব্যাপী পরিচিত বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অধীনে এই দুর্নীতির সুযোগ শূন্যের কাছাকাছি হয়ে যাবে।
এই কারণেই স্বার্থান্বেষী মহলরা প্রাণপণে বিরোধিতা করছে।

(৪) সার্বভৌমত্ব হারানোর দাবি একটি মিথ ও বিভ্রান্তিঃ

বিশ্বের ৩০-৪০টি দেশ, যেমন- সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, চীন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ছাড়াও আরও অনেক দেশ তাদের প্রধান বন্দরগুলো বিদেশী কোম্পানিকে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে।
কোথাও কি তারা সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে?
অবশ্যই না।

কারণ-
অপারেশনাল ম্যানেজমেন্ট সার্বভৌমত্ব ঠিক থাকে-
নৌবাহিনী, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, নিরাপত্তা সংস্থা৷ কোস্টগার্ড- সবকিছু সরকারের হাতে থেকেই যায়।
বিদেশী কোম্পানি শুধু- অপারেশন, দক্ষতা, প্রযুক্তি, গতি
ব্যবস্থাপনা- এগুলো উন্নত করে।

(৫) দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি কমবে, শিল্পকারখানা সুবিধা পাবেঃ
একটি জাহাজ ১৬ দিনের বদলে যদি ৪৮ ঘণ্টায় আনলোড হয়-

★ বাজারে দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট কমবে
★ শিল্পকারখানায় কাঁচামালের সরবরাহ দ্রুত হবে
★ তেলের মতো পণ্যে অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি কমবে
★ আমদানি–রপ্তানি পরিবহনে খরচ কমবে
★ রপ্তানি পণ্যের প্রতিযোগিতা বাড়বে

অর্থাৎ বন্দর আধুনিক হওয়া মানে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্লাস শিল্প উৎপাদনে গতিশীলতা বাড়ে।

(৬) বিদেশী অপারেটরের সরাসরি ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানঃ
এপিএম টার্মিনালের মত প্রতিষ্ঠান- ৫০০-৭০০টি সরাসরি চাকরি, ১৫০০-২০০০টি পরোক্ষ চাকরি তৈরি করবে।
এর সঙ্গে আছে- আধুনিক প্রকৌশল প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন, বৈদেশিক বন্দরে কাজের সুযোগ বাংলাদেশি শ্রমিকদের global mobility এই অভিজ্ঞতা আগামী ২০ বছরে বাংলাদেশি জনবলকে বিশ্ববাজারে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।

(৭) লজিস্টিকস খরচ কমলে GDP বাড়ে- এটি প্রমাণিত অর্থনৈতিক সত্য। একটি দেশের জিডিপি বাড়াতে হলে-
পণ্য পরিবহনের সময়, বন্দর–কাস্টমস বিলম্ব, কনটেইনার হ্যান্ডলিং খরচ এসব কমানো সবচেয়ে কার্যকর কৌশল।


চট্টগ্রাম বন্দর আধুনিক হলে- GDP ১–১.৫% বাড়তে পারে, রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে, বিদেশী বিনিয়োগে গতি আসবে, বাংলাদেশ আঞ্চলিক ট্রানজিট হাবে পরিণত হবে।
অর্থাৎ এটি শুধু বন্দর উন্নয়ন নয়—
জাতীয় অর্থনীতির রূপান্তর।

(৮) যারা বিরোধিতা করছে, তারা মূলত কারা?
এই কাজে বাধা দিচ্ছে- সিন্ডিকেট–মাফিয়া, শ্রমিক নেতা যারা অদক্ষতা বজায় রেখে সুবিধা নেয়, দুর্নীতি- নির্ভর গোষ্ঠী, অতীত স্বৈরাচারের দোসর- যারা বন্দরের ধীরগতি থেকে কোটি কোটি টাকা কামায়। এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি লড়াই করতে চায়, তাহলে বিদেশী অপারেটরই হলো সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র- কারণ তাদের সাথে দুর্নীতি করা যায় না।

সর্বশেষ কথাঃ
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের কেন্দ্রবিন্দু। একটি অকার্যকর, দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রযুক্তিহীন বন্দরে দেশ কখনোই সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো এগোতে পারবে না। বিদেশী অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের হাতে অপারেশন গেলে- প্রযুক্তি আসবে, দক্ষতা বাড়বে, দুর্নীতি কমবে, সময় কমবে, খরচ কমবে, GDP বাড়বে এবং বাংলাদেশি জনবল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দক্ষ হবে

অতএব,
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনা করা আজ সময়ের দাবি, অর্থনীতির দাবি এবং জাতীয় উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×