বিকেল সাড়ে চারটা। দরজা খুলে আনিতাকে দেখে চোখেমুখে বিরক্তির আভা ফুটিয়ে আনাফ বলে- আপু তুই?! এই না গেলি!
আনিতা আনাফের বিরক্তির কারণ বুঝতে পারে- কলিংবেলের শব্দ শুনে আনাফ ভেবে নিয়েছিলো- আম্মু ফিরেছেন'। তবুও চিপসের প্যাকেট'টা ভ্যানিটিব্যাগ থেকে বের করতে করতে জিজ্ঞেস করে, আম্মু এখনো আসেনি?
আনাফ চুপচাপ বসে থাকে। তার বিরক্তির পরিমাণ আরো কিছুটা বেড়ে যায়। নিজের প্রতি রাগ হয়। ঘরে একাএকা মায়ের অপেক্ষা না করে আনিতার সাথে বাইরে গেলে কতকিছুই না দেখতে পারতো। রাজমহল থেকে ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম খেতে পারতো....
জবাব না পেয়ে কয়েকসেকেন্ড পর আনিতা আবারো জিজ্ঞেস করে, কিরে আম্মু আসেনি?
আনিতার প্রশ্নটা এবার আনাফের কাছে কাটাগায়ে নোনের ছিটার মতো মনে হয়। সে লাউডলি জবাব দেয়, 'না আসেনি'।
'বলছিলাম না, আম্মু আসার আগেই চলে আসবো। তুই তো গেলি না....' বলতে বলতে আনিতা নিজের রুমে চলে যায়।
আনাফ চিপসের প্যাকেট হাতে নিয়ে চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে বসে মায়ের অপেক্ষা করে। মা ফিরলে চিপস খেতে খেতে মোবাইলে "আংরিবার্ড" খেলবে। চিপস খেতে খেতে আংরিবার্ড খেলবার মজাটাই অন্যরকম! আজ সকালে আংরিবার্ডের নতুন একটা লেভেল শুরু করেছে আনাফ। মা ফিরলে সন্ধ্যার পূর্বেই সে এই লেভেলটা জিতে যেতো। সন্ধ্যা হয়ে গেলেই তো আবার পড়তে বসে হবে...
পড়তে বসবার কথা মনে পড়তেই মনটা আরো খারাপ হয় আনাফের। আনিতার কাছে গিয়ে অনুনয় করে বলে, 'আপু আম্মুকে একটা কল না'
ট্যাম্পুর ইঞ্জিনের শব্দে মোবাইলের কথাগুলো স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও আমেনা বেগম বুঝতে পারলেন ছেলে কথা বলছে। তাই মধুকন্ঠে বলেন, এইতো বাবা। মা এখন গাড়িতে। নেমে কল ব্যাক করি।'
রাফিয়া মেডাম জিজ্ঞেস করে, কে? ছেলে!
-আর বলিয়েন আপা। যা দুষ্টুমি করে। ইদানীং গেম খেলা শিখেছে। অপেক্ষা করছে, আমি বাসায় গেলেই গেম খেলবে। বলেন আমেনা বেগম।
- কি গেম খেলে? খেয়াল রাইখেন। আজকাল ইন্টারনেটে আজেবাজে... কথাটা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় টেম্পুটা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে রাস্তার পাশে।
আমেনা বেগম অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখেন পাশে রাফিয়া ম্যাডামের নিস্তব্ধ শরীর পড়ে আছে। তিনি চোখে মেলে রাখার চেষ্টা করেন। শুনেন কেউএকজন পাশে কাতরাচ্ছে। কিছু মানুষ এক্সিডেন্ট এক্সিডেন্ট বলে এগিয়ে আসছে।
তারপর কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা শেষে এম্বুলেন্সের হুইশেল ভেদ করে মোবাইলের চেনা টিউনটা আবারো তার কানে আসে- "মা! ফোনটা ধরো না; মা......"।
***
উপরের গল্পের শিক্ষিকা চরিত্র আমেনা ও রাফিয়া বেগমের মতো গত ৩ আগস্ট বিকেলে স্কুল থেকে টেম্পুযোগে 'গল্প করতে করতে' বাসায় ফিরছিলেন রাঙ্গুনিয়া নোয়াগাও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিক্ষিকা। তাদের একজনের নাম 'সোমা ঘোষ'। সোমা ঘোষের ছেলেটা বাসায় বসে বসে মায়ের ফেরার প্রহর গুনছিলো। সোমা ঘোষ ঐদিন আর বাসায় ফেরেন নি। উনাদের গাড়িটি শুলকবহর এলাকায় পৌছুলে পেছন থেকে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় উল্টে যায়। এবং ঘটনাস্থলে নিহত হন আমেনা বেগম নামের এক শিক্ষিকা। গুরুতর আহত আরো এক শিক্ষিকা চিকিৎসারত অবস্থায় একসপ্তাহ পর অবস্থায় মারা যান। এবং আজ ভোরে মারা যান 'সোমা ঘোষ'। । (সূত্র: প্রথমআলো)
এভাবে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। দুইদিন আগে 'rtv'র'একটা নিউজে দেখলাম- শুধু 'ঈদুল আযহা' উপলক্ষে সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে ১৩৫+ মানুষ মারা গেছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গতবছর আমাদের দেশে বড় আন্দোলন হয়েছে। সরকারের উচ্চমহল থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনো 'ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করার তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। আরো কতো আন্দোলন, আর কতো প্রাণ ঝরলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে??????
ছবি: অন্তর্জল
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১০:৫১