আলাপ
"আসুন, বসুন
কতদিন পর দেখা হল
কিছু আলাপ না হলে চলে?"
"শেষবার যখন দেখা হল
মনে আছে কিছু?" বলতে গিয়েও
আটকে গেল ঠোঁটে
তার মুখে স্নিগ্ধ হাসি
ম্লান করে দেয়া সাজে না
বললেন, "কি করেন আজকাল?
থাকেনই বা কোথায়?"
তার চোখ, চোখের চাহনি
পাঁচ বছর আগে থেকে সুদীর্ঘ সময়
বিনিদ্র রজনী নির্দয় শকুনের মতো
হৃদয়পটে উড়ে বেড়িয়েছে।
কখনো খুবলে খেয়েছে মগজ,
কখনো হামলে পড়েছে বুকে,
চুপসে যাওয়া হৃদয়পিন্ড কখনোবা স্থান পেয়েছে সরু ঠোঁটে।
স্তম্ভিত ছিলাম কিছুক্ষণ
সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত ছিল তার চোখে
সম্বিত ফিরে পেয়ে দৃষ্টি ঘুরাই অন্যদিকে,
"বলতে পারেন অবকাশ জীবন।
ইচ্ছে হলে কিছু করি…"
"ভালই হল" তার চোখে স্মিত হাসি,
"যেমনটা চেয়েছিলেন আপনি
রুটিনবাঁধা জীবন তো একে বলা যায় না।"
"হুম, তবে এতে আমাদের সংসার কি চলত?"
ভুলটা ধরতে পারলাম পরে।
ঠিক হয়নি বলা
তবে অসত্য কিছু বলিনি
ও চাইত আমি কিছু করি,
একটা ফেমিলি চালানোর মত পর্যাপ্ত মাইনে
পকেট পুরে নিয়ে আসি মাস শেষে।
উদাসীন আমি নিশ্চিন্তে তখন ঘুরে বেড়াই,
ইচ্ছে হলে দু'ছত্র লিখে রাখি নোটে।
আলোচনা মোড় নেয় অন্যদিকে
বললাম, "একভাবে চলে যায় সংসার।
ছেলেটা এখনও পড়তে শেখেনি,
ভেবেছি ওকে আর ইশকুলে পাঠাব না।
বড় হয়ে ছাইপাঁশ লিখে
টেনেটুনে সংসার চালাবে না।"
"সবাই যে বড় হয়ে ওরকম হবে এমনতো নয়
হতে পারে বড় কোন ডাক্তার
পাইলট কিংবা ইঞ্জিনিয়ার
আগে লেখাপড়াটা শিখুক।"
"এখনই কবি কবি ভাব
ভাবুন একবার, জানালা খোলা পেলে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে,
মনে হয় আমাদের পিচ্চি রবিদা।
বিদ্যে কিছু থাকলে হয়ত দু 'এক লাইন এখনই লিখে ফেলত।"
আমার কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সে
"কবি হওয়ার ভয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে ফেলে দেবেন ওকে
যার যা হওয়ার সে তো হবেই
লেখাপড়া না জানা কবি কি দুনিয়ায় নাই!"
আমার ব্যাপারে এমন আকাশ পাতাল সে ভাবেনি,
দিনে ক'পয়সা পকেট পুরে নিয়ে আসব ভেবেছে,
ডাল, ভাত, লাকড়ি কেনার সামর্থ্য হবে কি না ভেবেছে,
প্রতিমাসে না হোক তিন মাস অন্তর আলনার কাপড়গুলো পাল্টাবে কি না ভেবেছে।
"সে যাই হোক", বললাম আমি "বাদ দিন ওসব।
তবে ছেলেকে ফেরানো যাবে না
কবি হয়েই জন্মেছে সে।
তার রাত পছন্দ
যদি আকাশে চাঁদ থাকে,
সকালের কোমল রোদ ভাল লাগে
মেঘ যদি সূর্যকে ঢেকে না ফেলে।
সে ভালবাসে বৃষ্টি
ভালোবাসে শিশিরে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে বেড়াতে।
লোভ দেখিয়েও ফেরানো অসম্ভব
শুধু মায়ের কথা বললে…
মায়ের লোভ এখন আর দেখাই না
এতটা নির্দয় হওয়া যায়!"
"আপনার স্ত্রী কোথায়?
ছেড়ে গেছে?
যেতেই পারে
টানাপোড়ন সংসারে সবার কি সুখ মেলে!"
আমার ছেলের মা'র অর্থলোভ ছিল না একদমই
তারপরও বলতে পারিনি কিছুই।
আমি যা চেয়েছিলাম পেয়েছি
ধরাবাঁধাহীন স্বাধীন জীবন।
সে চেয়েছিল একটা স্বচ্ছল সংসার
পেয়েছে।
আবার অনেক কিছুই পায়নি
দুজনের কেউই।
মুখোমুখি অনর্গল বলে গেলেও
মনে মনে টের পাই ঢের
দুজনের ভেতরেই একটা অংশ জুড়ে
এখনও ফাঁকা, প্রানহীন মরুভূমি।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১:২৫