১
সুমনার খুব অস্থির লাগছে। সজল বাড়িতে গিয়েছে। বলেছে, বাবা-মার সাথে কথা বলবে। বিষয়টা চূড়ান্ত করতে হবে। অবশ্য ওর বাসাতে জানেই আগে থেকে। তবু। একটা আনুষ্ঠানিকতা!
সন্ধ্যা থেকে কয়েকবার ফোন করলো সজলের নাম্বারে। ফোনটা বেজেই চলেছে। আজব! "ফোনটা ধরেনা কেন?" কিছু সময়ের ব্যবধানে আরো কয়েকবার চেষ্টা করে, দেখে ফোন বন্ধ। "ধ্যাত!! তুমি ফোন বন্ধ করে রাখতে পারো। আমি পারিনা?" বলে নিজের মোবাইলটাও অফ করে রেখে দিলো।
২
রুনা বাংলাদেশ ব্যাংকে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকায় এসেছে। সুমনার হোস্টেলে উঠেছে। ঢাকায় আর কেউ নেই।
সকালে উঠে সুমনা চলে গেলো অফিসে। রুনা ইন্টারভিউ দিতে। ইন্টারভিউ শেষ করে তমালকে সাথে নিয়ে রুনা এলো সুমনার অফিসে, "এই শোন্, আমরা আজ তোকে সাথে নিয়ে দুপুরের খাবার খাবো।"
সুমনা বললো, "তোরা আজকে খেতে যা রে। আজকে আমি বাসায় চলে যাবো।"
"আজ আমাদের সাথে যেতেই হবে। আজ আমাদের লাভ ডে।" রুনার এই কথাটিকে ফেলতে পারলোনা সুমনা। এমনিতে সজলের অনুমতি না নিয়ে সে কোথাও কখনও যায় না।
কিন্তু, আজ তো অভিমান করেছে। সজলের কিছুদিনের ব্যবহারে ও দ্বিধান্বিত!
সকালে দশটায় একবার মোবাইল অন করে দেখেছিল, ওর ফোনটা অন নাকি অফ! তারপরে আবার ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
খাওয়া-দাওয়ার পর রুনা বললো, "চল্ তো একটু মার্কেটে যাই।" সুমনার মন ভালো নেই। ও যাবেই না। কিন্তু, রুনা জোর করে নিয়ে গেলো। মার্কেটের উছিলায় দুই বান্ধবী একসাথে কিছুক্ষণ থাকাও হবে। ও আবার আজ রাতেই চলে যাবে। আবার কবে দেখা হবে ঠিক নেই। হোস্টেলে রুমমেটদের সামনে এত কথা বলাও যায় না। তাছাড়া, ওর বয়ফ্রেন্ড তমালেরও অন্য কাজ আছে। একা একা শপিং এর চেয়ে সুমনাকে পাশে পেলে ভালো লাগবে।
সুমনার মন পরে রয়েছে সজলের দিকে। মন মানছিলো না মার্কেটে যেতে। তবু, যেতে হলোই। রুনার আসার কথা তো জানাই আছে ওর। পরে সব খুলে বললেই হবে! ভেবে মনকে শান্ত্বনা দিয়ে রুনার সাথে চললো।
৩
মার্কেট থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে। সুমনার এতক্ষণে মনে পরলো মোবাইলটা যে বন্ধ। ফোন অন করতেই,
- কি হলো, এতক্ষণ ধরে মোবাইল বন্ধ ক্যানো?
- একটু মার্কেটে গিয়েছিলাম রুনার সাথে।
- মার্কেটে গেলে মোবাইল বন্ধ রাখা লাগে?
- তোমার ও তো বন্ধ ছিলো কালকে। তুমি কেন...
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সজল বলে উঠলো, "এক্ষণি নিচে আসো।"
- ও তুমি ঢাকায় এসে পরেছ? বলে উড়ে চলে এলো যেনো হোস্টেলের নিচে, গেটের কাছে। সারাদিনের রাগ অভিমান সব পানি।
- কখন এসেছ তুমি?
- তুমি কাল রাত থেকে আজ এখন পর্যন্ত কি কি করেছ বল।
সজলের গলায় রাগ। সুমনা সব বলে গেলো একের পর এক। ওর অভিমানের কথাও বাদ দিলো না। কিন্তু, সজল একটা কথাও বিশ্বাস করলোনা।
- তুমি ইচ্ছে করেই এইসব নাটুকে কাহিনী বানিয়েছ।
- সজল, কি বলছ তুমি এইসব? সুমনা অবাক!
- তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। আজ থেকে আর কোন সম্পর্ক নেই।
- সজল...কথা শোন
- রাখো তোমার কথা! আর কখনও আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেনা। বলে পরনে সুমনার নিজের কাজ করে দেয়া একটা ফতুয়া ছিলো সেটা খুলে সুমনার হাতে ফিক মেরে দিয়ে থুয়ে চলে গেলো।
ঘটনাটা কি ঘটলো ও বুঝলোই না প্রথমে। যখন হুঁশ ফিরে পেলো সামনে কাউকে দেখতে পেলো না। সজল কোন্ পথে গিয়েছে জানা নেই। তবু, অনেকক্ষণ আঁতিপাতি করে বেহুদাই খুঁজলো ওকে পাগলের মত। দৌঁড়ে দৌঁড়ে এ গলি,ও গলি। কিন্তু, পেলো না কোত্থাও। যেন হারিয়ে গেছে।
হোস্টেলে ফিরে ফোন করে আবারও কিছু গালাগাল শুনলো। এবং সেই একই কথা, আর কখনও আমার সাথে যোগাযোগ করবেনা। কথাটা মনে রেখো।
৪
অটবীতে একটা ইন্টারভিউ আছে। ভালো করে পড়তে হবে। একটা ভালো চাকরির জন্যই তো ঢাকায় আসা। এইরকম একা একা পরিবার থেকে দূরে থাকা। সজলের সাথে বোঝাপরা পরে হবে। ক'দিন পরেই ওর সব রাগ পানি হয়ে যাবে। এইসব সাত পাঁচ ভেবে কয়েকদিন পার হলো।
অটবীর ইন্টারভিউ শেষ। চাকরিটা কনফার্ম হতেই আর থাকতে পারলো না। সজলের অফিসে গিয়ে দেখা করলো। ঠিক ও যা ভেবেছে তাই। সজল অফিস থেকে বের হয়ে ওর সাথে খুবই স্বাভাবিক ব্যবহার করলো। দুজনে এক সাথে অফিসের নিচের হোটেলে বসে চা-সিঙ্গারা খেল। তারপরে ইন্টারভিউ এবং কবে নিয়োগ হবে ইত্যাদি কথা বলেটলে ওকে রিকশায় উঠিয়ে দিলো। পাশাপাশি কিছুদূর সাথেও এলো। নেমে যাবার আগে কপালে একটা চুমু খেয়ে বললো, "ভালো থেকো।"
চাকরিতে জয়েন করে প্রথম ক'দিন বেশ ভালোই কাটলো। অফিসে ও একাই মহিলা অফিসার। সবাই বেশ আন্তরিক ব্যবহার করছে।
আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে অফিস থেকে বের হলো সুমনা।
- এই শুনছো, তুমি কোথায়? কেমন আছ?
- আমি ব্যস্ত। ভালো আছি। কি বলবা তাড়াতাড়ি বলো।
- কেমন আছ?...
- এক কথা দুইবার বলো কেন? বললামনা ভালো আছি। তবু...
- ও মা, কি বলছ তুমি? এত কিসের রাগ! হবু বউয়ের সাথে কেউ এমন ব্যবহার করে!
- কে হবু বউ?
- মানে?
- মানে আবার কি! তোমাকে আমি বিয়ে করছিনা। কথাটা খুব ভালো করে শুনে রাখো।
সুমনা চুপ!
- আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়ে তোমার চেয়ে অনেক সুন্দরী। দয়া করে আমার সাথে আর যোগাযোগ করবেনা। ডিসগাশটিং!
- হ্যালো! হ্যালো!
লাইনটা কেটে গেছে। আরেকবার চেষ্টা করে ফোন বন্ধ পেলো। সুমনার মাথায় আকাশ ভেংগে পরেছে। কি বললো সজল। ওকি সত্যি শুনলো। ওহ্!! সজলের বিয়ে! পাত্রী ও নয়! রাস্তায় পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজনের সাথে জোরে ধাক্কা খেলো! দেখে চলতে পারেন না?
৫
গত কয়েকদিনে সজলের আচরণ এখন পরিস্কার। আসলে বাড়িতে গিয়েছিলো নিজের বিয়ের মেয়ে দেখার জন্য। আর ও ভেবেছিলো ওদের দুজনের বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে যাচ্ছে। ওহ্, কি বোকা আমি!! আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কি! ভাবতে ভাবতে ডিসিশন যা নেওয়ার নিয়ে নিলো। বাড়ি ফেরার পথে হোস্টেলের কাছেই ডিসপেন্সারী থেকে ২০টা ঘুমের বড়ি কিনলো। তারপরে, বাড়িতে ফোন দিলো। ধরলো সুমনার মেজ'পা।
- হ্যালো, সুমনা, সজলের সাথে কথা হয়ে গেছে?
- বাবা-মা কোথায় রে? দে তো একটু কথা বলি।
- তোর কি হয়েছে রে? গলার স্বর এমন কেন?
- "কিছুই হয়নি রে। আমাকে তোরা সব ক্ষমা করে দিস্" বলে এবার ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো।
মেজ আপাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলো। হোস্টেলে ফিরে স্বাভাবিক ভাবে অন্যান্য দিনের মত নামাজ পড়ে নিলো। তারপরে রান্নাঘরে গিয়ে সবার অলক্ষ্যে গিয়ে সবগুলো বড়ি একসাথে পানি দিয়ে খেয়ে নিয়ে সবার সাথে বসে বিছানায় গল্প করতে লাগলো। এর পরের কাহিনী ওর জানা নেই।
পরে মেজ আপার কাছে শুনেছে। তবে অনেক দিন পর।
৬
মেজ আপাকে কিছু না বলে লাইন অফ করে দেয়ার পর উনি ফোন করেছে হোস্টেলের রুম মেট লাকিকে,
- এই লাকি, সুমনা আছে?
- না আপু। ও তো এখনও ফেরেনি। বেশ দেরী হচ্ছে আজ।
- আচ্ছা, তোমরা একটু কষ্ট করে ওকে চোখে চোখে রেখো তো।
সবাই বিছানার ওপরে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। হঠাৎ লাকি দেখে সুমনা বিছানায় চিত হয়ে পরেছে। দৌঁড়ে কাছে এসে অনেক ডাকাডাকি করেও জ্ঞান ফিরাতে না পেরে, সুমনার বাড়িতে ফোন দিয়ে তাৎক্ষণিক জানায়। হোস্টেল সুপারকে জানিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে প্রাণ হাতে করে নিয়ে এলেও ও নাকি পরিণত হয়েছিলো মানসিক রোগীতে। উল্টাপাল্টা কথা বলত। মেজ আপা সেই রাতেই ঢাকা রওয়ানা হয়ে গিয়েছিলেন। বোনের খবর জানিয়ে সজলকেও ফোন করেছিলেন। কিন্তু, জানালেই কি হবে, ও তখন নিজের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত। পাত্তাই নাকি দেয়নি। উল্টো শাসিয়ে দিয়েছে।
৭
সেই ঘটনার পর থেকেই সুমনা বাড়িতে। মাঝের অনেকটা সময় খুব খারাপ কেটেছে সুমনার। ডাক্তার ও কবিরাজের চিকিৎসা করে বর্তমানে ও সুস্থ।
ইদানিং ওর বিয়ের ধুম পরেছে। কালই ছেলে আর ছেলের দুই বন্ধু এসে বাসায় দেখে গিয়েছে। সজলের তুলনায় সবদিক থেকেই ভালো। যেমন ফ্যামিলি। তেমন ছেলে ভালো চাকরি করে। রেনেটা কোম্পানির ম্যানেজার। বিয়ের আগেই নিজের সংসারের সব গুছিয়ে নিয়েছে একাই। আর, কি অমায়িক ব্যবহার! কি দেখে যে সে সজলের প্রেমে মজেছিলো। কোন মানে হয় না। মন বড় আজব জিনিস!
কিছুদিন হলো সুমনা এখানেই কাছের এক কলেজে জয়েন করেছে। লেকচারার হিসেবে। পোড়া দাগ শুকানোর চেষ্টা করছে প্রাণপনে। অসুস্থ থাকা অবস্থায় বাবা-মাকে দেখেছে হাউমাউ করে পাশে বসে কাঁদতে। কত স্বপ্ন ছিলো মেয়েকে নিয়ে। সব ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। একটা শয়তান প্রতারককে ভালোবেসে সে বাবা-মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আর দেবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ১১:১২