ঐশীর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ঐশী তার বাবা-মাকে খুন করল আর আমিও আমার গল্পের প্লট খুঁজে পেলাম। দীর্ঘদিন প্লটহীন থাকায় ঐশীর কাছে আমার এ অশেষ কৃতজ্ঞতা!
আমার গল্পের প্রধান চরিত্র রুমাও ঐশীর বয়েসি। ঐশী যেভাবে দুদিন পর আত্মসমর্পন করল, সেভাবে কিন্তু আমাদের রুমা আত্মসমর্পন করেনি। এক মাস ধরে তাকে পাকড়াও করার চেষ্টা করতে করতে যখন পুলিশ, গোয়েন্দা, র্যাব একেবারে গলদঘর্ম হয়ে গিয়েছিল তখনই রুমা ধরা পরে। রুমা যদি নিজ থেকে তার মামার সাথে দেখা করার জন্য মামা বড়ি না যেতো তবে তাকে ধরতে পারা কোনভাবেই সম্ভব হতো না। এটা রুমাও যেমন বিশ্বাস করে, পুলিশও করে। মামার বাড়ি পৌছার পরই মামা নিজেই পুলিশের কাছে রুমাকে ধরিয়ে দেন। নিজ বাবা-মা হত্যাকারী রুমা কখনো ভাবতে পারেনি তার আপন মামা তাকে এভাবে ধরিয়ে দিবেন!
সরকাল দলীয় জনপ্রিয় রাজনীতিদি আজমত সাহেব ও তার স্ত্রী তাদের একমাত্র মেয়ে রুমা দ্বারা খুন হবার পর থেকে এমনিতেই ঘটনাটা টক অব দি কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছিল । রুমা ধরা পরার পর ঘটনাটা লাউড টকে পরিণত হল।
-নিজের বাবা-মাকে মারল মেয়েটা ! এটা কিভাবে সম্ভব!
-নিশ্চয়ই ঐশীর মতো ইয়াবা খাইতো সে! এই মাদক পোলাপানগো একেবারে ধংস কইরা দিল!
-ওরেব্বাস!ঐটুকুন একটা মেয়ে! কিভাবে করলো! হিন্দি সিরিয়ালের পরিচালকেরাও এইরাম কাহিনী দেখাইতে হাত পা কাঁপবো!
-ও একা করেনি নিশ্চয়ই! এর মধ্যে আর কেউ আছে।
শেষ বক্তব্যের সাথে অবশ্য পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনেক মিলে যায়। ধরা পরার পর থেকেই রুমা কেবল একটা কথাই বলছে। আমি বাধ্য হয়ে খুন করেছি।
এছাড়া সে আর কিছু বলতে নারাজ। পুলিশ দীর্ঘদিন তাকে রিমান্ডে রাখল। তবু কিছু উদ্ধার করতে পারল না। রহস্যের কুল কিনারা করতে পুলিশ যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, তখনই রুমা মুখ খুলল।
হঠাৎ করে একদিন রুমা বলে উঠল, আমি সব বলবো যদি আমার স্বীকারোক্তি সবগুলো টিভি চ্যানেলে লাইভ ট্যালিকাস্ট করা হয়। রুমার কথা শুনে সংশ্লিষ্টরা আশ্চর্য হলেও টিভি সম্প্রচারের ব্যবস্থা হলো।
-তুমি খুন করেছো? সঞ্চালক রুমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
-হ্যা।
-কিভাবে পারলে! তারা তো তোমার জন্ম দিয়েছেন! তাদের খুন করতে কি একবারো হাঁত কাপলো না তোমার?
-আমি বাধ্য হয়ে খুন করেছি। হাত কাঁপলেও করার কিছু ছিল না। রূমা দৃঢ়স্বরে উচ্চারণ করল।
-কেন করেছো জানতে পারি কি?
-আপনারা জানেন বাবা জনপ্রিয় একজন রাজনীতিবীদ।একদিন লাকিলি বাবার একটা টেলিফোন কনভারসেশন শুনে ফেলেছিলাম। শুনলাম তিনি বলছেন, আগামী পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান চলাকালীন তিনি রেড সিগন্যাল দিলেই বোমা বিষ্ফোরন ঘটাতে হবে। আরো জানতে পারলাম, বোমাটা নাকি খুব শক্তিশালী। এতে নাকি অনেক মানুষ মারা যাবে। আজ বৈশাখের দশ তারিখ। আমি যদি কাজটা না করতাম তবে হাজার হাজার মানুষ মারা যেতে পারতো!
এইটুকু বলেই রুমা থামল। সঞ্চালককে জানালো আজ এ পর্যন্তই থাক। বাকিটা আগামীদিন বলা হবে।
সারা দেশের সব মানুষ টানটান উত্তেজনা নিয়ে একটা নিকৃষ্টতম খুনীর স্বীকারোক্তিমূলক অনুষ্ঠান দেখছিল। ঐশীর খুনের ঘটনায় মানবাধিকার কর্মকর্তাসহ অনেকেই ঐশীর পক্ষে কথা বলেছিলেন। ঐশীর বয়েস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমাদের রুমা কিন্তু কারো কোন সহানুভূতি পায়নি। বাবা আজমল সাহেবের জনপ্রিয়তা এতোটাই বিশাল ছিল আর রুমার খুন করার প্রক্রিয়াটা এতোটাই নিষ্ঠুর ছিল যে কেউ তার পক্ষে কথা বলেনি। কিন্তু টেলিভিশনে প্রথম পর্ব প্রচারিত হবার পর থেকেই দৃশ্যপট পাল্টে গেল।সবখানে আজমল সাহেবের কুশপুত্তুলিকা দাহ করা হল আর দলে দলে মিছিল শুরু হল। রুমার নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। রুমার বাবার বিরোধী রাজনৈতিক দলও উঠেপড়ে লাগল রুমার মুক্তির দাবীতে। তাদের অবশ্য রুমাকে নিজ দলে ভিড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার প্লান হয়তোবা ছিল। কিছুদিন আগেও সবার কন্ঠে রুমা ছিল। এখনও আছে। তবে এখন সবাই রুমার প্রশংসায় পঞ্চমূখ!
-দেখো এইটুকুন একটা মেয়ে। কী তার চিন্তা শক্তি! কী স্ট্রং তার কারেক্টার!
-রুমাকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে। দেশের মানুষের জন্য তার প্রেমের পুরস্কার দেয়া উচিত।
-আমাদের রাজনীতিবীদরা যদি এমন করে দেশের মানুষদের নিয়ে ভাবতো! একজন রাজনীতিবীদের কাছে দেশের আগে দল বড়, দলের আগে ব্যক্তি। অথচ রুমার কাছে বাবা-মার আগে দেশের মানুষ! হ্যাটস অফ টু রুমা।
এবং ইন্টারেস্টিংলি এনাফ, পরদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকগুলো খুনের খবর আসল। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বাবা-মাকে তার ছেলে বা মেয়ে খুন করেছে।
খুনিদের কেউ কেউ বলল, আমার ডাক্তার বাবা টাকা রোজগারের নেশায় তার দ্বারা রোগ নিরাময় করা সম্ভব না জেনেও রোগীকে অন্য কোন ডাক্তার রেফার না করে রোগীদের মেরে ফেলে।
কেউ কেউ বলল, আমার পুলিশ বাবা ৪ বা ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে খুনের আসামীকে ছেড়ে দেয়। তারা বের হয়ে আবার খুন করে বসে। কারণ এক খুনের জন্য যে শাস্তি দশ খুনের জন্যেও সেই একই শাস্তি।
অনেকে বলল, আমার শিক্ষক বাবা টাকা খেয়ে খারাপ নোটবই কিনিয়ে ছাত্রদের জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাই হোক, এইসব খুনী অথবা টিভি দর্শক- সবার এক দাবী, রুমাকে ছেড়ে দিতে হবে।
পরদিন টিভি চ্যানেলে আবার বসা হল রুমাকে নিয়ে।
সঞ্চালক জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো বেশ ভালভাবেই আত্মগোপন করেছিলে। মামার সাথে যোগাযোগ করেই তো ধরা পড়লে। কাজটা কেন করলে?
-খুন করার জন্য!
-খুন! সঞ্চালকের চোখে বিষ্ময়! আরেকটা খুন! কাকে?
-মামাকে।
-কেন?
-কারণ মামা একজন খুনী।
রুমার মামা-মামীও টিভিতে রুমাকে দেখছিলেন! রুমার কথা শুনে মামা বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠলেন। মামী মামার দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন ভয়ে!
-তোমার মামা কাকে খুন করেছেন?
-মামীকে।
-তোমার মামী কি মৃত?
-না। মামী জীবিত আছেন।
-বুঝলাম না।
-মামী ছিলেন খুব ভাল একজন সঙ্গীত শিল্পী। রবীন্দ্র সঙ্গীতে বেশ কিছু পুরস্কার দেখেছি তার। শিল্পী মামী বেঁচে থাকলে তিনি রেজওয়ানা বন্যা, ইন্দ্রানী সেন এদেরকেও হার মানাতে পারতেন। মামা বিয়ের পর তাকে আর জনসম্মুখে গান গাইতে দেন নি। তিনি নিজ হাতে খুন করেছেন একজন শিল্পীকে!
-ও...। সঞ্চালক এবার সহজ হয়ে নড়েচড়ে বসলেন।
সারা দেশে রুমার প্রশংসা আরো বেড়ে গেল। চারদিকে শুধু রুমা, রুমা আর রুমা। দেশের সকল নারী সমাজ একত্রিত হয়ে রুমাকে মুক্তির দাবী জানিয়ে আন্দোলনের ডাক দিল।
এই পর্যায়ে এসে সরকার বেশ বিব্রত হয়ে পড়ল। দেশের জনমত এখন রুমার পক্ষে। সরকার কি তবে আদালতকে প্রভাবিত করবে? সামনেই যে নির্বাচন!
আদালত যদিও তার নিজ গতিতেই চিন্তা ভাবনা করছিল।
সাক্ষাৎকারের তৃতীয় দিন।
-আচ্ছা একটা ব্যাপার আমরা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। তুমি তোমার বাবাকে কী কারণে খুন করেছো, সেটা জানলাম। কিন্তু মাকে কেন খুন করলে? তিনি তো নির্দোষ ছিলেন।
-না। তিনি মোটেও নির্দোষ ছিলেন না।
-তিনিও দোষী?
গোটা দেশে তখন পিন-পতন নিরবতা। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অনুরোধেও বোধ করি এতটো নিরব ছিল না গোটা দেশ!
-হ্যা তিনিও দোষী ছিলেন। তিনি বাবার সিদ্ধান্তটা জানতেন। অথচ তাকে আটকানোর বিন্দু মাত্র চিন্তা করেননি!
চারদিকে স্লোগান বের হয়ে গেল সাথে সাথে।
‘রুমা তুমি এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে!’
‘রুমা তোমার ভয় নাই। ক্ষয় নাই, ক্ষয় নাই!
সঞ্চালক তার পরবর্তী প্রশ্ন করলেন। নিজ হাতে খুন না করে তুমি তো তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতে। পারতে না?
-দিতে পারতাম কি স্যার? উনি এতো জনপ্রিয় একজন সরকার দলীয় নেতা। আপনি নিজে কি মনে করেন, তার বিচার হতো?
পাল্টা প্রশ্নে সঞ্চালক থতমত খেয়ে গেলেন। এটা দেখে সাধারন জনগন খুব আনন্দ পেল। আন্দোলন গতি পেল। সরকার, আইন-আদালত কেউ আর মানতে চাইছে না দেখে সরকার খুব বিব্রত হল। সন্তানদের দ্বারা আরো কয়েকজন বাবা-মা খুন হলেন। সরকার থেকে নির্দেশ আসলো সম্প্রচার বন্ধ করার।
টিভি চ্যানেল বলে কথা। এতো জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া একটা অনুষ্ঠান কি কর্তৃপক্ষ আচমকা হাত থেকে ছেড়ে দিতে পারে? পরদিন তাই একটি চ্যানেল বুদ্ধি করে রুমার মামা-মামীকে নিয়ে আসলো।
সঞ্চালক মামাকে জিজ্ঞেস করলেন। আপনার ভাগ্নি যে আপনাকে দোষারোপ করল এ ব্যাপারে আপনি কি মনে করেন?
-এ কথা ঠিক যে রুমার মামীকে আমিই নিষেধ করেছি গান গাইতে। কিন্তু এটাকে কোন দোষ বলা যাবে কি না জানি না।
-এটা কেমন কথা। আপনি বলছেন, আপনি নিজেই নিষেধ করেছেন, তবু নিজেকে দোষী বলবেন না?
-না। ব্যাখ্যা করলে ক্লিয়ার হবে বোধ হয়। আসলে রুমার মামীকে আমি পাগলের মতো ভালবাসতাম, এখনো বাসি। ও যখন গাইতো তখন দেখতাম নানা জায়গা থেকে ওর ভক্তরা কল দিচ্ছে। পরিচিত, অপরিচিত নানা পুরুষরা তার সামনে এসে তার গানের প্রশংসা করছে। তখন বয়স কম ছিল। তাই ব্যাপারটা সহ্য করতে পারতাম না। মনে হতো ও শুধু আমার জন্য গাইবে। আসলে খুব বেশি ভালবাসতাম বলেই বোধহয় ঐ সময়টাতে এমন করেছিলাম!
এ পর্যায়ে রুমার মামী বলে উঠলেন, আসলে এটাকে কোন অন্যায় আমি বলবো না। কারণ, ও আসলেই আমাকে ভীষন ভালবাসে। অন্য কারো প্রশংসার চাইতে ওর ভালবাসার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশি। তাছাড়া, ঐ সময়টাতে সংসারে আরেকটু সময় দেয়াও জরুরী ছিল বলেই গান ছেড়েছি।
-এই যে গান ছাড়লেন, আপনার খারাপ লাগে না?
-একেবারে খারাপ যে লাগে না, তা না। মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। এরকম একটা সময়েই হয়তোবা রুমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম গান গাইনা বলে। তবে ওভারঅল আমি খুব খুশি।
রুমার মামা বললেন, আমাদের ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবন আমরা আসলেই খুব সুখে কাটিয়েছি, কাটাচ্ছি।
টিভিতে মামা-মামীর সুখের সংসার দেখে অনেক সংসারের কর্তা এবং কর্ত্রীদের খুব ইর্ষা হল। অনেকে ভাবলো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন বুঝাপড়া হয়ই না। রুমা এই মানুষটাকে খুন করলে বড্ড ভুল করতো।
পরদিন চ্যানেলটা নিয়ে আসল রুমার বাবার খুব কাছের একজন মানুষকে। তিনি তার পি.এস এবং বন্ধু জনাব, সেলিম আনোয়ার।
-আচ্ছা সেলিম সাহেব, আপনি তো রুমার বাবাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাকে কেমন মানুষ বলে মনে হয় আপনার?
-বেসিক্যালি তিনি আসলে খুব ভাল একজন মানুষ।
-বোমা ব্লাস্টের মতো এমন একটা নির্দেশ যিনি দিতে পারলেন তাকে আপনি এতোটা ভাল বলছেন?
-হ্যা। আমি বলছি তিনি মূলত একজন খুব ভাল মানুষ। কিন্তু রাজনীতির ঘোর-প্যাঁচের কারনেই তিনি বাধ্য হয়েছিলেন খারাপ হতে।
পছন্দ হয় না, তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিতে পারতেন।
-তা পারতেন। তার সে ইচ্ছেটাও ছিল। কিন্তু তিনি তার মেয়ে আর বউকে খুব ভালবাসতেন । একদিন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তিনি চান রাজনীতি ছেড়ে দিতে। কিন্তু তিনি এমন একটা পর্যায়ে ছিলেন যে ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারতেন না। তাকে মেরে ফেলাও হয়ে যেতে পারতো। তিনি মারা গেলে তার মেয়ে আর বউকে কে দেখবে। এইসব চিন্তা করেই রাজনীতি তিনি ধরে রেখেছিলেন।
আজমত সাহেবের জন্য এ পর্যায়ে জন-মানুষের আগেকার ভালবাসা আবার ফিরে আসল। সেই সাথে রুমা মুক্তির আন্দোলনও ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়ল। আদালত তার নিজস্ব গতিতে কাজ করার সুযোগ পেল।
আমার গল্প থুক্কু, রুমার গল্পও এখানে শেষ হল। ঐশীকে আবারো ধন্যবাদ।
ঘটনা- চামেলীবাগের চামেরী ম্যানশনের ঐশী তার বাবা-মাকে নিজ হাতে খুন করে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৫৬