somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কঙ্গোর ‘মিনারেল’ গৃহযুদ্ধ

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১০:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আপনি যে মোবাইলটা ব্যবহার করছেন অথবা সম্প্রতি কিনেছেন সেটি কঙ্গোর কোন এক সশস্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থের যোগান দিচ্ছে পরোক্ষ ভাবে। মোবাইলে ব্যবহৃত একটি খনিজ পদার্থের নাম কোল্টান আর পৃথিবীর মোট কোবাল্টের ৮০ শতাংশ পরিমান রয়েছে এই কঙ্গোতে (তথ্যসূত্রঃ ওয়ারচাইল্ড ডট অর্গ ডট ইউকে/কঙ্গো কনফ্লিক্ট মিনারেল)। দেশটির পূর্বাঞ্চলে খনিজ সম্পদের অবৈধ উত্তোলন ও পাচারের মাধ্যমে সশস্র গোষ্ঠী নিজেদের অর্থায়ন করছে। খনিজ সম্পদের এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও ভীতি প্রদর্শনের জন্য ব্যাপক খুন খারাপি,নারী ধর্ষণ ও লুটতরাজ নিয়মিত ব্যাপার। কঙ্গোর অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে এ অঞ্চলে সংঘাত স্থায়ী রূপ লাভ করেছে । এক গবেষণায় দেখা গেছে ২০০৬ সাল থেকে কঙ্গোতে চলমান গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রান হারিয়েছে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষ,ধর্ষিতা হয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ নারী আর বাস্তু হারা হয়েছে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষ।এ দেশের ‘মাইনিং ল’ অমান্য করে গোল্ড, ডায়মণ্ডের পাশাপাশি টিন(কাসটেরাইট), টেণ্টেলাম (কোল্টান), টাঙ্গেস্টেন পাচার করে স্বঘোষিত এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো বছরে শত মিলিয়ন ডলার আয় করে। আর সমগ্র অর্থ খরচ হয় বিপুল পরিমান আগ্নেয়াস্র কেনার কাজে যা দিয়ে সাধারন মানুষের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
টিন বা কাসটেরাইট সকল প্রকার ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস বানানোর কাজে , টেণ্টেলাম মোবাইলে বিদ্যুৎ সঞ্চয় রাখে আর টাঙ্গেস্টেন ফোন ভাইব্র্যাটের কাজে এবং সার্কিট বোর্ডে ব্যবহৃত হয়। এত সব মূল্যবান জিনিস মোবাইল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পোঁছায় ধাপে ধাপে। বলা হয়ে থাকে কঙ্গোর শনাক্তকৃত ২০০ খনির মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি দেশি বিদেশী বিভিন্ন সশস্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রনে রয়েছে ।অস্রের মুখে অত্যন্ত অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খনির অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে অসহায় মানুষ। দৈনিক এক, দুই ডলারের বিনিময়ে হাত আর হাতুড়ি দিয়েই বড় পাথর ভাঙ্গার কঠিন কাজটি করতে হয় । বিদ্রোহীরা লোকালয় থেকে ছোটো ছেলেদের তুলে নিয়ে জোরপূর্বক খনিতে কাজ ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদ্রোহী বানায় এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের দিয়ে পতিতাবৃত্তির মতো অপরাধমূলক কাজ করার। জীবিকা নির্বাহের জন্য যে সব সাধারণ মানুষ অন্য জায়গা থেকে কাসটেরাইট , কোল্টান সংগ্রহ করে তাদেরকে উচ্চহারে চাঁদা দিতে হয় ।
সাপ্লাই চেইনের অন্য ধাপগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় খনি থেকে বুকাভু বা গোমা শহরে ‘মেইজঁ দাসাত’ ট্র্যাডিং হাউসগুলোতে নিজেদের মিনারেল পরিবহন ও বিক্রি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্রোহী গ্রুপ। স্থানীয়দের অনুমান গত বছর প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে এই চক্রটি । সাবেক উপনিবেশ বেলজিয়াম ছাড়াও মালয়েশিয়া ,থাইল্যান্ড,চীনসহ অন্যান্য দেশের আন্তর্জাতিক রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করে থাকে । তারপর বৈধভাবে অল্প কিছু আর অবৈধ পথে বাকিটা পার্শ্ববর্তী দেশ উগান্ডা,বুরুন্ডী ও রুয়ান্ডা দিয়ে রিফাইন বা পরিশোধন করার জন্য পূর্ব এশিয়ায় চলে আসে । অন্যান্য দেশের পণ্যের সাথে মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর কঙ্গোর খনিজ পদার্থগুলো আর চেনার উপায় থাকে না । রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রক্রিয়াজাত করা মিনারেল বিক্রি করে দেয় ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানিদের কাছে । কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলের মিনারেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হচ্ছে এই ইলেক্ট্রনিক্স প্রতিষ্ঠান । পরে সার্কিট বোর্ড , কম্পিউটার চিপ , মোবাইল ফোন তৈরি করা প্রতিষ্ঠান নকিয়া, ইন্টেল ,এপল, হিউলেট প্যাকারডের মতো বাকি প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যায় । তাতে তৈরি হয় মোবাইল ফোন, মিউজিক প্লেয়ার, ভিডিও গেমস, ল্যাপটপের মতো পণ্য।( তথ্যসূত্রঃ রেইজ হোপ ফর কঙ্গো ডট অর্গ)
মিনারেলগুলো কোথা থেকে আসছে সেটা সনাক্ত, পরীক্ষা নিরীক্ষা বা বিধিসম্মত কিনা তা যাচাই করা হয়না বড় প্রতিষ্ঠানে। ‘ব্লাড ইন দ্যা মোবাইল’ ডকুমেন্টারির ডিরেক্টর ফ্রাঙ্ক ফুলসেন বৃহৎ মোবাইল কোম্পানি নকিয়ার সাথে কথা বলে গ্যারান্টি চেয়েছেন যে তারা কঙ্গোর গৃহযুদ্ধ প্রবণ এলাকার মিনারেল কিনছে না এবং সেখানে পরোক্ষভাবে অর্থায়ন করছেনা । কিন্তু নকিয়া কতৃপক্ষ সে গ্যারান্টি দিতে পারেনি। প্রথম সারির অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থাও তাই। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত আইফোন সংঘাতমুক্ত এলাকার আকরিক বা খনিজ পদার্থ দিয়ে তৈরি কিনা এ প্রশ্নের জবাবে স্টীভ জবস বলেছেন নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই ।(তথ্যসূত্রঃ জেড ডি ডট কম/ব্লগ/এপল/ জবস-নো-ওয়ে.../৭৩৭৭)
তথ্য প্রযুক্তির এ সময়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি সামনে চলে আসে । ল্যাপটপ,টিভি ,মোবাইলসহ অতি প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবহার না করে এক মুহূর্তও চলা যাবে না। কিন্তু পৃথিবীর এক সমস্যাগ্রস্থ দেশের চরম অসহায় মানুষের সীমাহীন কষ্ট কিংবা হানাহানির বিনিময়ে এ সব কিছু হাতে আসুক তা নিচ্চয় কেউ চাইবেনা । বরং নিজের কেনা পছন্দের মোবাইল বা ইলেক্ট্রনিক্সের টাকা পরিণামে বিশ্বের কোন একটি দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থের সংস্থান করে এটা ভাবতেই খারাপ লাগা স্বাভাবিক । তাই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু ব্যক্তি ও ওয়াশিংটন ভিত্তিক ইনাফ ক্যাম্পেইন প্রতিষ্ঠানটি কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে । সেগুলো হল প্রথমত ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানিদেরকে সংঘাতমুক্ত অন্যান্য জায়গা থেকে উত্তোলন হওয়া মিনারেল কেনার জন্য বলা এবং ম্যাসেজ পাঠিয়ে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া । কারন ২০০৮ সালে জাতিসংঘের দুটি রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রক্রিয়াজাতকৃত মেটাল ও মিনারেল কেনাবেচার সাথে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলে সশস্র বিদ্রোহীদের হত্যা , ধর্ষণ , লুণ্ঠন সম্পর্কযুক্ত ।(তথ্যসূত্রঃ দ্যা ইউএন গ্রুপ অফ এক্সপার্টস [ডিসেম্বার ২০০৮]ও দ্যা ইউএন গ্রুপ অফ এক্সপার্টস[এস/২০০৮/৪৩ ফেব্রুয়ারী ২০০৮]),দ্বিতীয়ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কনফ্লিক্ট মিনারেলের দ্বারা তৈরি কোন ইলেক্ট্রনিক্স ব্যবহার না করা কারন ইলেক্ট্রনিক্সের উপকরন কাস্টেরাইট দখল,উত্তোলন ও পাচার করার জন্য প্রতিমাসে হাজার হাজার মানুষ খুন হচ্ছে সন্ত্রাসীদলের হাতে, তৃতীয়ত সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারনা চালানো ইত্যাদি ।
সম্পদ ইউরোপ, আমেরিকাকে দিয়েছে সমৃদ্ধি আর আফ্রিকাকে দিয়েছে অরাজকতা,সংঘাত, দুর্ভোগ আর অশান্তি । আপনা মাংসে হরিনা বৈরির মতো খনি হচ্ছে কঙ্গোর যন্ত্রণা। উপনিবেশ আমল থেকে মুক্তি পেলেও অন্য লোভীদের লুটপাট থেমে থাকেনি। কথা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন কঙ্গোলিজ আমাকে বলছে ‘আমাদের দেশটা আসলে অসুস্থ হয়ে গেছে’। কবে কীভাবে এখানকার মানুষ এ অসুস্থতা থেকে আসল মুক্তি পাবে সে প্রশ্ন তো থেকেই যায় ।

জহিরুল কাইয়ুম
সাউথ কিভু,গনতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র থেকে ।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×