পানি পড়া আর ঝাড়-ফুঁক দিয়ে ক্যান্সার-প্যারালাইসিস থেকে শুরু করে সব ধরনের রোগের চিকিৎসা দিচ্ছে ঝিনাইদহের এক কথিত কিশোরী কবিরাজ। যেকোনো রোগ নিয়ে এলেই তার কাছে রয়েছে চিকিৎসা। ব্যারেল ভর্তি পড়া পানি রাখা আছে, রোগীরা গেলাস ধরলেই দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ পানি নিতে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ হাজার নারী-পুরুষ নাসরিন আক্তার নামের এ কিশোরী কবিরাজের বাড়িতে ভিড় করছে।
কিশোরী কবিরাজের আস্তানাকে ঘিরে গড়ে উঠা প্রতারকচক্রের সদস্যরা বলছে, এ পানি খেলে ক্যান্সার, হার্টের সমস্যা, লিভারের সমস্যা, জন্ডিস, মেয়েদের নানা সমস্যা, মাথায় যন্ত্রণা, প্যারালাইসিসসহ সবধরনের জটিল রোগ ভালো হচ্ছে। গত দু’মাসে অসংখ্য রোগী ভালো হয়েছে। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে এখানে রোগী আসছে। যদিও ওই চক্রের সদস্যরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি কোন রোগীটির রোগ ভালো হয়েছে। তাছাড়া কিশোরী কবিরাজ নাসরিন আক্তারের বড় বোন নাজমা আক্তারও ছিলো কবিরাজ। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯৯৬ সালে সে মারা যায়।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বহিরগাছি গ্রামের ইসরাইল মণ্ডলের চার সন্তান। ২ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে নাসরিন আক্তার (১৬) ছোট। নাসরিন আক্তার এ বছর স্থানীয় বহিরগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ক্লাসে তার রোল ছিলো ৩৫। খুব একটা মেধাবী ছাত্রী নয় সে।
নাসরিন আক্তার জানায়, ২ মাস আগে সে এক রাতে স্বপ্নে দেখতে পায় পানি পড়া-ঝাড়ফুক করলে ৪টি রোগে অসুস্থ রোগীরা ভালো হয়ে যাবে। প্রথমদিকে সে গরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আবারও স্বপ্নে দেখানো হয় এবং বলা হয় মানুষের উপকার না করলে তার ক্ষতি হবে। এরপর সে ওই ৪টি রোগের জন্য ওষুধ দিতে শুরু করে। আস্তে আস্তে রোগীরা নানান রোগ নিয়ে তার কাছে আসতে থাকে। তাদের সেই সকল রোগেরও চিকিৎসা দিতে থাকে। চিকিৎসায় সব রোগই ভালো হচ্ছে।
সরেজমিনে বহিরগাছি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরী কবিরাজের বাড়িতে অসংখ্য রোগীর ভিড়। বেশিরভাগ রোগী মহিলা। সেখানে বেশ কয়েকটি দোকান গড়ে উঠেছে। চলছে কেনাবেচা, আর খাওয়াদাওয়া। কবিরাজ বাড়িকে কেন্দ্র করে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সেখানে একটি তত্ত্বাবধান কমিটি গড়ে উঠেছে। যার নেতা হয়েছেন কিশোরীর চাচা মসলেম আলী।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, মাঝরাত থেকে এখানে রোগী আসতে শুরু করে। সকাল হতে না হতেই হাজার হাজার মানুষ এসে উপস্থিত হয়। সকলের হাতে খালি গেলাস। আসে কবিরাজের পড়া পানি নিতে। কবিরাজকে ঘিরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রচার করছে, অসংখ্য মানুষের জটিল রোগ ভালো হয়েছে। তারা দূর গ্রামের কিছু মানুষের নাম বলে দিচ্ছে। তাদের এ প্রচারে প্রতিদিনই রোগীর ভিড় বাড়ছে। আর খুশি হয়ে যে যা পারেন দেন বলে অর্থ আদায় করা হচ্ছে।
কবিরাজের কাছে আসা পার্শ্ববর্তী মোল্লাডাঙ্গা গ্রামের রেক্সোনা খাতুন জানান, তিনি হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। ৩ দফা এখানে আসছেন। ৭ দিন পানি খাওয়ার পর ভালো হবেন বলে কবিরাজের লোকজন জানিয়েছেন। তিনি কবিরাজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে পারেননি। কালীগঞ্জ শহর থেকে এসেছেন ভ্যানচালক আব্দুল মান্নান। তার পায়ে টিউমার আছে। আশায় আছেন এ পানি পড়া খেয়ে টিউমার পালিয়ে যাবে। বহিরগাছি গ্রামের শিবুপদ বিশ্বাসের স্ত্রী নয়ন বিশ্বাস জানান, তাদের গ্রামের এ মেয়েটি কবিরাজ তা তাদের জানা ছিলো না। এখন বাইরের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ আসছে শুনে তিনিও দেখতে এসেছেন। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে খবর পেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত বদু মিয়া এসেছেন সুদূর লক্ষ্মীপুর থেকে। তিনিও ভালো হওয়ার আশায় কবিরাজের পড়া পানি খেয়ে যাচ্ছেন। ওই গ্রামের বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এটা সম্পূর্ণ প্রতারণা। মেয়েটির বড় বোনও কবিরাজী করতেন। কিন্তু তিনি নিজেই জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। বড় বোনের সেই কবিরাজি এখন নাসরিন আক্তার করছে। হঠাত করে তার এ কবিরাজী সবাইকে অবাক করেছে। তিনি আরও জানান, অনেকে দোকান গড়ে তুলে ব্যবসা শুরু করেছেন। রোগীদের থাকার জায়গা তৈরিসহ নানা অজুহাতে টাকা আদায় শুরু হয়েছে। এছাড়া খুশি হয়ে যা পারেন দেন বলে কবিরাজ টাকা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ঝিনাইদহে ইতঃপূর্বে আবির্ভাব ঘটা আনসার বাহিনীর সদস্য নুর আহাদ কবিরাজকে নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো এটিও সেই দিকে যাচ্ছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে প্রশাসনকে খেসারত দিতে হবে। শ্রীরামপুর গ্রামের রেজাউল করিম রিজু জানান, তার স্ত্রী মনজুরা বেগম বেশ কয়েকবার এখান থেকে পানি পড়া খেলেও কোনো কাজ হয়নি।
এ ব্যাপারে কবিরাজের বড় ভাই ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রবিউল ইসলাম জানান, কবিরাজী চিকিৎসায় জটিল রোগ ভালো হয়, এটা আজ আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনিও এটার বিরুদ্ধে। কিন্তু তাদের বাড়ির পার্শ্ববর্তী কিছু লোক এটাকে ইন্ধন দিচ্ছে। তত্ত্বাবধান গ্রুপের নেতা মসলেম আলী জানান, তারা মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষ উপকার পাচ্ছে তাই আসছে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১০ দুপুর ২:৫৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




