পরিচালকঃ মোহাম্মদ দিয়াব
আইএমডিবি রেটিং: 7.2
আইএমডিবি লিঙ্কঃ 678 (2010)
অফিসে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ফাইজা। প্রতিদিনের মত আজকেও তার ভ্রুদুটো টেনশনে কুচকে আছে; বাসে কি ভীড় ঠেলে উঠতে পারবে, নাকি আবার সেই ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে? গাদাগাদি করে ঠাসা লোকাল বাসে মানুষের গা ঘেষে দাড়িয়ে যেতে হবে পুরোটা পথ, ভাবতেই মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠে। ট্যাক্সিতে গেলে অনেক আরামে আর দ্রুত যাওয়া যায় ঠিক আছে, কিন্তু এই বিলাসিতা কি তার মানায়? একেবারেই মধ্যবিত্ত পরিবারের স্ত্রী আর দুটি ফুটফুটে বাচ্চার মা ফাইজা এইসব ভাবতে ভাবতেই দৌড় লাগায় সদ্য আসা বাসের হ্যান্ডেল ছুতে।
সুগঠিত দেহবল্লরী জড়িয়ে আছে টকটকে লাল রঙের ট্র্যাকস্যুট; চৌম্বকীয় আকর্ষণে আকর্ষিত হচ্ছে মুগ্ধতা, লোভাতুর দৃষ্টি আর টুকরো অশ্লীল মন্তব্য, “কঠিন একখান মাল, মাম্মা !!” জগিং শেষে ফিরছে সেবা। নামকরা জুয়েলারী ডিজাইনার সে। স্বামী প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। সফলতা, বিত্ত আর সুখ স্বাচ্ছন্দে পরিপূর্ণ জীবন। মুচকি হাসি ঠোটের কোণায়। ভাবছে তার ফুটবলভক্ত স্বামীটি কার জন্য বেশি পাগল? তার জন্য? নাকি ফুটবল খেলার জন্য?
আজ রাতে স্বামীর সাথে স্টেডিয়ামে যাচ্ছে সেবা।
হলভর্তি মানুষ। মাইক হাতে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। মাত্রই মেয়েদের বয়স নিয়ে একটি রসিকতা করলো সে, অথচ কেউই হাসলো না!! সমস্যা কি? তার স্ট্যান্ডআপ কমিকে; নাকি একজন মেয়ে স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানকে দেখে দর্শকরা ভড়কে গেছে; উচ্ছলতা ভুলে গম্ভীর হয়ে ভাবছে নেলী। একটা কলসেন্টারে জব করলেও বয়ফ্রেন্ড ওমরের মত পার্টটাইম কমেডিয়ান হতে চায় সে।
চলন্ত বাসে দমবন্ধ করা ভীড়। শরীরের উপর যেন চেপে আসছে লোকজন সব। অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাইজা। একসময় অনুভব করলো কোমরের নিচে কিছু আংগুলের স্পর্শ। চকিত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সে; চোখে পড়ে সব মুখোশ; ভদ্রলোকের। লজ্জায় নীল হয়ে ভীড় ঠেলে সামনে এগোয়, পেছনে ফিরে দেখে এগিয়ে আসছে কেউ একজন। পরিচিত আতঙ্কে পেছন ফিরতে থাকে ফাইজা, চলন্ত বাস থেকে কোথায় পালাবে?
স্টেডিয়ামে চলছে উতসব। জনারণ্য। বিশাল সমর্থনপুষ্ট দলের জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা সমর্থকরা। চিতকারের জোয়ার উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। উত্তেজনার পারদ আকাশচুম্বী। উচ্ছসিত সেবা আর স্বামী শরীফ’ও। স্লোগান দিয়ে মিছিল করে ফিরছে সবাই। কিছুদূর এগিয়ে শরীফ খেয়াল করলো সেবা নেই পাশে। হাত ছুটে গেছে কখন জানেওনা। মানুষের স্রোত ঠেলে পেছনে যাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা করতে থাকে সে। ততক্ষনে ভীড়ের মধ্যেও একজায়গায় যেন ভীড়টা কাউকে ঘিড়ে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করেছে। বৃত্তবন্দি সেই ভীড়টা যেন ঘোরলাগা একদল লালায়িত হায়েনার ভীড়। ঘূর্ণীপাকে তলিয়ে যাবার আগে সেবার সম্ভ্রম বাচানোর আশায় বাড়ানো হাতটা একনজর দেখা গেল।
মন খারাপ করে নেলী বাড়ির দিকে এগুলো। বারান্দা থেকে মায়ের হাত নাড়া দেখে হাসি ফুটে উঠলো গোমড়া মুখে। রাস্তা পার হতে যাচ্ছে এমন সময় হঠাত তার শরীরের উর্দ্ধাংশের স্পর্শকাতর স্থানে খুব জোরে খামচে ধরলো কে যেন। তীব্র ব্যাথায় নেলী চমকে উঠলো। সামনে দিয়ে চলে যেতে থাকা এক চলন্ত গাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসা একটি হাত মুঠো করে ধরে থাকলো তার জামার বুকের অংশ। ছেচড়ে যেতে লাগল নেলী গাড়ীর সাথে সাথে। কিছুদূর গিয়ে মুঠো আলগা হতেই রাস্তায় গড়িয়ে পড়লো সে। অশ্লীল হাসির আওয়াজ শোনা গেল গাড়ীর ভেতর থেকে।
প্রতিদিন এই অস্বস্তি, আতঙ্ক আর লজ্জার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়তে থাকে ফাইজা। সঙ্কীর্ণমনা স্বামী আদিলের সাথে সে পারেনা কোন কিছুই শেয়ার করতে, এমনকি ফাইজা হারিয়ে ফেলে যৌনইচ্ছাও। আদিলকে গ্রাস করতে থাকে অসন্তুষ্টি রাতে একান্তে স্ত্রীকে কাছে না পেয়ে। সংসারে শুরু হয় কলহ।
বেচে থেকেও যেন মরে গেছে সেবা। দুঃসহ স্মৃতিগুলো ফিরে ফিরে আসছে বারবার; তাড়া করে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। সবাই পাশে দাড়িয়েছে তার, কিন্তু শরীফ আসছেনা কেন? ফোন ধরছে না কেন সে? সেকি ইচ্ছা করেই হারিয়ে গেছে? একদিন মুখোমুখি হয় সেবা তার স্বামীর। যন্ত্রনাক্লিষ্ট শরীফ চোখে চোখ রাখতে পারেনা। “সেবা, তুমি জান না, আমি কিসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই ওরা তোমাকে নিয়ে কি করেছে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিনা। আমার সুস্থির হতে সময় দরকার।” অবাক হয়ে তাকায় সেবা স্বামীর দিকে। তার স্বামী তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
নেলীর উপর হামলাকারী কাপুরুষ রমজান ধরা পড়েছে। থানায় পুলিশ মামলা নিচ্ছে ভায়োলেন্সের অভিযোগে। কেন? ক্ষোভে ফেটে পড়ল নেলী। কেন যৌন হয়রাণীর অভিযোগ নেয়া হবেনা? সবাই যুক্তি দিয়ে বোঝালো, আরে, এই অভিযোগ জানাজানি হলে সমাজে মান সম্মান থাকবে? সবাই তো ছি ছি করবে! তরুণী সাহসিকা এর শেষ দেখবেই। সে চায়, সবাই তার মত সাহসী হোক, প্রতিবাদী হোক। কিন্তু একদিন নেলীও অবাক বিস্ময়ে দেখলো, কিভাবে তার পরিবার, তার প্রেমিক ওমর ও কাছের সব মানুষজন তার থেকে দূরে সরে গেল।
যৌন হয়রানী। এই অভিশপ্ত সাপের দংশনে দংশিতরা যেতে পারেনা কোন যাদুকর ওঝার কাছে, যারা নিমিষেই নামিয়ে দেবে বিষ। গোপনে পুষতে থাকে দংশনের জ্বালা। কেউ জেনে ফেললে যে তাড়িয়ে দেবে দূর দূর করে। একঘরে হয়ে যাবে সমাজ থেকে। বিষক্রিয়ায় দংশিতরা হারিয়ে ফেলে সাহস, আত্মসম্মান, বেচে থাকার ইচ্ছা। তিলে তিলে শারীরিক আর মানসিক যন্ত্রনায় দগ্ধ হয়ে শেষ হয়ে যেতে থাকে। সামাজিক অবস্থান, শিক্ষাদীক্ষা কিম্বা বিত্ত - যতই ভিন্নতা থাকুক, যৌন নিগ্রহের অভিশপ্ত ছোবল সবাইকেই বন্দী করে ফেলে অদ্ভুত এক অন্ত্যমীলে; যেখানে দংশিতদের চোখের পানির রঙ এক।
আপাতদৃষ্টিতে মিসরের ভিন্ন তিন সমাজের তিন নারী’র জীবন একই ছন্দে ছন্দ্যোবদ্ধ হবার গল্প এই সিনেমা। কিন্তু বাস্তবতা হোল এই তিন নারীর চরিত্রগুলো যেন বাংলাদেশের সব নারীর জীবনযাত্রার; ভিনদেশী রূপায়ন।
মনুষত্ব্যকে আর মানবিকতাকে প্রশ্নের মুখে দাড় করিয়ে দেয়া এই অন্যায়ের প্রতিকার কি? সুশিক্ষা দিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের মূল্যবোধ গড়ে তোলা; নাকি পাল্টা আক্রমন করা? প্রতিবাদী হওয়া? জনমত গড়ে তোলা, সচেতনতা বাড়ানো?
কিন্তু কতজন পারে ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে? সাহস নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে? নিজেদের নিজে রক্ষা করার তেজ কি সবার থাকে? কতজন পারে ফাইজা’র মতো শরীরে অযাচিত স্পর্শকারীর পুরুষত্বে আঘাত করতে? কেই বা পারে সেবা’র দৃঢ় মানসিকতাকে নিজের ভেতর ধারন করতে? কিম্বা কয়জনের আছে নেলীর মত একা পথ চলার মনোবল?
ডাউনলোড লিঙ্কঃ kat.ph
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:৫৬