somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন হযরতের জন্য

২৩ শে এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খুবই ছোট একটি খবরে জানতে পেরেছি, সম্প্রতি ছিনতাইকারীর গুলিতে হযরত আলী নামের বেসরকারি একটি অফিসের একজন কর্মচারী নিহত হয়েছেন। ৬ এপ্রিল প্রাতর্ভ্রমণে বের হওয়া রাজধানীর মিরপুরের রাইনখোলায় তিনজন নারীকে ছিনতাইকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি ছিনতাইকারীদের ছোড়া গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। জানা গেছে, ওই তিন নারী যখন ছিনতাইয়ের শিকার হন, তখন আশপাশের লোকজন কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে না এলেও এই সাহসী মানুষটি সামান্য একটি ইট নিয়ে অপরাধীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। আমাদের সমাজে অহরহ এ ধরনের অপরাধ ঘটছে। কিন্তু সেসব অপরাধের প্রতিবাদ তো আমরা করিই না, বরং চোখ বন্ধ করে প্রকারান্তরে অপরাধীকে নিরাপদে স্থান ত্যাগের সুযোগ করে দিই। কিন্তু হযরত আলী নামের এই মানুষটি সমাজের অন্য দশজনের মতো অবলীলায় অপরাধটি সহ্য করেননি। তিনি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ অনেক সংবাদের ভিড়ে সেভাবে সবার দৃষ্টিগোচর হয়নি। এমনকি ১৫ দিন অতিক্রান্ত হলেও ঘটনাটি নিয়ে প্রতিবেদন আসেনি। আমরা যতটুকু জেনেছি, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
অন্যদিকে, হযরত আলীর পরিবারে বিপর্যয় নেমে এসেছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাঁর দুটি সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হতে চলেছে। বিপন্ন পরিবারটি ঢাকা শহর ছেড়ে সাতক্ষীরার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একজন সাহসী-নির্মোহ মানুষের মৃত্যুতে আমাদের সমাজকে কি কোনো নাড়া দিয়েছে? ছোটখাটো ঘটনায় আমাদের রাজনীতির রাজা-বাদশাহরা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও এ ধরনের একটি অনন্য আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন? রাজনৈতিক দাঙ্গা-ফ্যাসাদে জড়িয়ে নেতা-কর্মীর মৃত্যুতে নেতা-নেত্রীরা কর্মীর বাড়িতে ছুটে গিয়ে তাঁর পরিবারকে সহমর্মিতা প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন। আমরা নিকট-অতীতে দেখেছি, রাজনৈতিক পরিচয়ধারী কর্মীর বাড়িতে ডাকাত পড়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ছুটে যেতে, কেবল সেই দলীয় কর্মীকে সমবেদনা জানাতে। এই মানুষের পরিবারের কাছে গিয়ে সেভাবে কেউ কি সমবেদনা জানিয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর—না। ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার একটি যথার্থ মন্তব্য করেছেন, ‘হযরত আলী যদি উন্নত কোনো দেশের নাগরিক হতেন, তাহলে তাঁর আত্মদানকে রাষ্ট্র অভিনন্দিত করত। তিনি জাতীয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি পেতেন।’
কিন্তু আমাদের দেশে তা হলো না। অথচ অনেক সাধারণ মানুষ বলছে, হযরত আলীর এই মৃত্যু অন্য আর দশটি মৃত্যুর ঘটনা থেকে আলাদা। কেননা, তিনি একটি অন্যায় প্রত্যক্ষ করে নীরব থাকেননি। এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আর প্রতিবাদ করতে গিয়েই জীবন দিয়েছেন। আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, এখনো এই সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা প্রতিদান বা স্বীকৃতির জন্য নয়—প্রতিবাদী হন, প্রতিরোধ রচনা করেন নিজের তাগিদে। হয়তো বর্তমান সামাজিক অবস্থার বিবেচনায় অনেকেই বলবেন, হযরত আলী কাজটি ঠিক করেননি, বোকামি করেছেন। কিন্তু আমরা বলব, আমরা যা করতে পারি না, হযরত আলী তা করেছেন। এ জন্য তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। তাঁর স্ত্রী হয়েছেন বিধবা, দুই সন্তান হারিয়েছে বাবাকে।
আমরা এই সাহসী যুবকের জন্য কী করতে পেরেছি? রাষ্ট্র বা সরকার কী করেছে? অনেককেই আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, আমাদের সমাজ থেকে ন্যায়পরায়ণতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়েছে বা হারিয়ে গেছে। কিন্তু একজন স্বল্প বেতনভুক্ত কর্মচারী—যিনি খুব বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন—তিনি প্রমাণ করলেন, সমাজে এখনো এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের মধ্যে সহমর্মিতা, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, প্রকাশ্যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো সততা অটুট রয়েছে। সমাজে এখনো কেউ কেউ আছেন, যাঁরা চোখের সামনে অন্যায় মেনে নেন না, উট পাখির মতো চোখ বন্ধ করে থাকেন না। তাঁদেরই একজন হযরত আলী। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করলেও আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র তাঁর দায়িত্ব পালন করেনি। এই অন্ধকার, নষ্ট সময়ে হযরত আলী একজন আলোকিত মানুষ, আলোকবর্তিকা, বাতিঘর। যাঁর আত্মদান ও বীরত্ব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে বয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
আমরা দেখেছি, সরকার নানা সময়ে ভালো কাজের জন্য নানা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। সচ্ছল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করারও নজির আছে। কিন্তু নিজের জীবন উৎসর্গ করে অন্যের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য যে হযরত আলী ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হলেন, তাঁর জন্য সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা উট পাখির মতো বেঁচে আছি, বীভৎস কোনো মৃত্যু দেখব বলে। এ অবস্থায় আমরা মনে করি, এই সাহসী বীরকে সম্মাননা জানানো আমাদের দায়িত্ব। দায়িত্বটি যদি রাষ্ট্র পালন করে, তাহলে আমরাই মহিমান্বিত হব, আমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে। আধুনিক রাষ্ট্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে একটি কথা রয়েছে। আমাদের এখানে যেসব করপোরেট ব্যবসায়ী রয়েছেন, তাঁদেরও আমরা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি তাঁদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা। কেননা, স্বল্প বেতনে চাকরি করা এই মানুষটি যে আমাদের ঋণী করে গেছেন! আমরা হযরত আলীর পরিবারকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্মাননা ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি এবং যাদের গুলিতে হযরত আলী নিহত হয়েছেন, সেই ছিনতাইকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। না হলে সব বাতি নিভে যাবে আর তাতে গোটা সমাজই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×