আমিও একদিন ছোট্ট ছিলাম ৷ঐ ছেলেটা , ভ্যেলভ্যেলেটা টাইপের৷ তোমার মত৷
মাধ্যমিকে স্টারপেয়ে বিশাল কিছু একটা করে করে ফেলেছি ভাব নিয়ে তখন সায়েন্স নিয়ে পড়ছি ৷ মনে তখন সদ্য উড়ুউড়ু ভাবটা গজিয়েছে ৷ ফাঁকফোকর পেলেই সাইকেল নিয়ে পালাতাম ৷ কালনার চারিদিকে ১৫-২০ কিমি তখন আমার নখদর্পনে ৷শীতকালগুলোতেই আমার পালানো টা জমত ভালো ৷
এইরকম একটা শীতের দুপুরে চলেগেছি বাকুলিয়া৷ বাকুলিয়া কবি রঙ্গলালের বাসভূমি ৷রঙ্গলালের নাম শুনেছিলুম আগে। বাকুলিয়া যে তার জন্মস্থান তাও বোধায় আবছা জানতাম।কিন্তু সেটি যে আমার একরকম ঘরের পাশেই তা সেইদিনই আবিষ্কার করেছিলাম।একটা এই বড় স্কুল না লাইব্রেরি ওনার নামে। একটা টলটলে বিলের ধার দিয়ে রাস্তা৷ সেখানে রাস্তার ধারে ধারে তখন ইউক্যালিপ্টাস না আকাশমনি গাছ ক্রমশ বাড়ছে ৷ অদ্ভুত ভালো লাগত রাস্তাটা৷একা একা বিলের জলের ধারে দাড়িয়ে দেখতাম সাদা আকাশের ছায়া পড়েছে বিলে। বিলের স্থির জলে তাদের ঈসৎ নীল লাগে৷ একটা দুটো সাদা মেঘের টুকরো আলগা ভেসে আছে৷ জলে তাদেৱ ছায়া দেখে আরো রূপসী মনে হচ্ছে ৷ কিছু বক-পানকৌড়ি জলে র ধারে ধারে উদাসীন ৷এই সব বসে বসে দেখতে আমার কত যে বেলা বয়ে গেছে৷
সেদিন অনেকটা সাইকেল চালিয়ে পা ব্যাথা ৷ বিলের কাছে একটা সাঁকোর উপর দুইধাৱে বসার জায়গা৷ সেখানে বসে দম নিচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি তোমাৱ কথা ৷ হ্যা , সত্যি তোমার কথা ৷
না, মানে এক্কেবারে হুবহু যে তুমি তা বলছিনে ৷ তবে এখনকার তোমার সঙ্গে তার বেসিক স্ট্রাকচারের বেশ কিছু মিল ছিল৷তোমার মতই সে আকাশ ভালবাসত, রোদ্দুর ভালবাসত, বৃষ্টি ভালবাসত। হটাৎ তাকে দেখেছিলাম ৷ একদিন তার বাবার সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে সে যাচ্ছিল ৷তোমার মতই রোগা পাতলা৷ একটা ম্যাড়ম্যেড়ে হলুদ রঙের ফ্রক পরে ছিল সে৷ এমনিতে একটু ফরসার দিকেই৷ আর গালে একটু সাদা সাদা ছোপ৷ শীতের শেষে ত্বক যেন খোলস ছাড়ছে৷ বিশ্বাস করবে কী জানিনা, ওর মনে মনে নাম ঠিক করেছিলাম অনামিকা৷
আমার দিকে তাকিয়ে সে অদ্ভুত সুন্দর ভাবে হেসেছিল৷ সে হাসিতে কারোর মন জয় করার চেষ্টা ছিল না, নিজেকে জাহির করা ছিল না, তাতে কোনো বিজুরির চমক , অথবা এখন কাৱ উঠতি নায়িকাদের অতিরঞ্জিত চোখ ঠেলে অবাক হবার মেকি ভাব কোনোটাই ছিল না৷ ষ্পষ্ট কী ছিল তা এত বছর পর আমি আৱ ব্যাখ্যা করতে পারি নে৷তবু এই টুকু বুঝতে পারি সেই মেয়েটি যেন আমাকে সেখানে সেই প্রকৃতির নির্জন কোলে চুপটি করে বসে থেকতে বলেছিল৷ বলেছিল , এই আকাশ দেখো , তুমি তোমার অনামিকাকে দেখতে পাবে , জলের বুকে কান পাতো , তোমার অনামিকার মৃদু হাসির কলতান শুনতে পাবে, এই মেঠো বাতাসে তোমাৱ দুহাত প্রসারিত করো , দেখবে তোমার অনামিকা তোমার আলিঙ্গনে ধরা দেবে ৷
তারপর আমি তন্ময় হয়ে দেখেছিলাম কীভাবে আস্তে আস্তে তার হাসি মাখা মুখ ফিকে হতে হতে মিশে গেছে সবুজ মাঠে, আকাশে, বাতাসে , দিগন্তে৷
তারপর তার খোজে আমি বেশ কদিন, কমাস, কবছৱ আশপাশের গ্রাম গুলোতে সাইকেলে টো টো করে ঘুরেছি ৷ তাকে আর খুজে পাইনি ৷
এখন আমার স্কুলটা ওই দিকেই ৷ মাঝে মধ্যে মন কেমন হলে ওই রাস্তা ধৱে আসি৷ দেখি সেই বাঁক, সেই ঝিল, টলটলে জল, হাওয়ায় ঢেউ লেগেছে তার বুকে৷ দূরে চাষীরা ব্যাস্ত মাঠে, তাদের মৃদু গুনগুন গান কানে আসে৷ সেই বসবার জায়গাটায় গিয়ে দেখি সেই ছোটোবেলাৱ আমিটা এখনো সেখানে বসে৷ সেই একইরকম তন্ময়তায় চেয়ে আছে তোমার পথের পানে৷
মাঝে মাঝে মনে হয় একদিন তোমায় নিয়ে গিয়ে হাজির করাই ওর সামন৷ গিয়ে ওকে বলি দ্যাখৱে গরু, তুই এখানে মন কেমন করে বসে আছিস ? তোর অনামিকা কোথাও না কোথাও আছেই , কোথাও না কোথাও ছিলই, কোথাও না কোথাও থাকবেই