জন্মেছিলাম মামার বাড়িতে, শুধু বাড়ির বড় ছেলে হিসাবেই নয়, বাড়ির বড় নাতি হিসাবেও।বাড়ির সবার প্রথম হওয়ার দরুন খুব আদর যত্ন পেয়েছিলুম সন্ধেহ নেই, তবে খুব বেশি দিন তার একছত্র অধিপতি থাকতে পারিনি। ১০ কি ১১ মাস পরেই আমার বোন মামনির জন্ম। একদম পিঠোপিঠি । এত কাছাকাছি দুই জন ছেলেমেয়ে কে নিয়ে মায়ের হাল কি হয়েছিল কে জানে? আমার শুধু মনে পড়ে একটা আবছা আঁধার ছবি। সবে আধো আধো কথা বলা শিখছি, তখন আব্বা সন্ধ্যে বেলা মাঠ থেকে ফিরে আমায় কলে নিয়ে চলে যেত ছাদে। সেখানে রাতের কালো আকাশে অজস্র মিটিমিটি তারা আর তার নিচে খোলা ছাদে আব্বা আমায় নিয়ে পায়চারি করছে আর বলে যাচ্ছে এম এ এন জি ও ম্যাঙ্গো , ম্যাঙ্গো মানে আম, আমিও তোতা পাখির মত বলে যাচ্ছি সেই সব আর আবছা শুনতে পাচ্ছি নিচে আমার বাচ্ছা বুনিটা কেঁদেই চলেছে আর মা তাকে থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে।গ্রামে থাকার ওই জীবনের প্রথম তিন কি চারটে বছর আমি আব্বা কে পেয়েছি নিরবিচ্ছিন ভাবে।তখন আব্বা কথাথেকে একটা পুরনো দুই শিটের তিন চাকা সাইকেল কিনে এনে দিয়েছিল।সেটা নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়তাম এপাড়া ওপাড়া। গ্রামে তখন ওই জিনিস খুব কমই ছিল। পাড়ার বাচ্ছা বাচ্ছা দাদারা সব হই হই করে আমার সাইকেলের পিছু পিছু দৌড়ে দৌড়ে আসত ঠেলে দেবার লোভে। সেখানেও ছিলাম আমি সর্বেসর্বা, কে আমার সাইকেলে হাত দেবে কে হাত লাগাতে পারবে না, কোন ছেলেটা হাত লাগানো তো দূরে থাক রাস্তাতেও দাড়িয়ে থাকতে পারবে না সেই সব আমিই ঠিক করে দিতাম নিজের খেয়াল খুশি মত।এই সব লোক মুখে শোনা। সাইকেলের এই গল্প আমার খুব একটা মনে নেই। হ্যাঁ একটা বেপার মনে পড়ছে।একবার প্রচণ্ড জোরে ঠেলার দরুন সাইকেল গমগমিয়ে ছুটছে গ্রামের নতুন মোরাম রাস্তায়, আর তারপর যেটা হয়, আমি সপাটে চিৎপটাং আর কোনরকমে উঠে দেখি হাঁটু কুনই থেকে গলগল রক্ত বেরুচ্ছে, আমার ঠেলা বাহিনী কোথায় উধাও। মা ও খবর পেয়েছিল কোথা থেকে , আমি খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছিলুম (আশ্চর্য রকম ভাবে আমি ছোট থেকেই কাদি কম, অন্তত শারীরিক আঘাত জনিত কারনে) দেখলুম মা একটা কাঁচা কঞ্চি নিয়ে হ্নতদন্ত হয়ে আমার দিকে আসছে। আমি সাইকেল ওখানেই রেখে নাকি দৌড় দিয়েছিলাম ধান খেতের মধ্যে দিয়ে, শেষে পাড়ার ছেলেরা আমায় পাজকালো করে নিয়ে আসে, মা তো আমায় এই মারে তো সেই মারে, কিন্তু সমবেত সবাই ওই একরত্তি ছেলে টাকে মারার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় কোনও রকম রক্ষে পেয়েছিলুম বোধায়।তারপর আমার সাইকেল চালানোর সীমানা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, আর ঠেলা বাহিনি কে বরখাস্ত করে দিয়েছিল আব্বা, মাঝে সাঝে সীমানার বাইরে বেরুতে গেলেই অদৃশ্য গুপ্তচরদের দ্বারা নিমেষে খবর চলে যেত মায়ের কানে, অমনি আমি শুনতে পেতুম - বাপওওওন, সিগগিরি এদিকে ঘোর।
আমাদের বাড়িতে তখন মেয়েদের সংখ্যা ছিল বেসি। মেজ আব্বার মেয়ে এন.ডি (N= NURUNESSA, D= DELWAR যথাক্রমে মেজমা আর মেজাব্বা)আমার থেকে মাস পাঁচেকের ছোট আর মামনির থেকে মাস পাঁচেকের বড়, তারপর মেজ আব্বার দ্বিতীয় মেয়ে নয়ন আমাদের থেকে দুই বছরের ছোট, ও বাড়ির রিজিয়া দিদি বছর দুয়েকের বড়।আমরা সবাই মিলে খেলনাবাটি খেলতাম। রিজিয়া দিদি ছিল আমাদের নেতা, আমাকে পাঠাতো বাজার করতে, আমিও মহা আনন্দে সাইকেল নিয়ে চলে যেতাম পুকুর পারে সাগপাতা বাজার করে আনতে। তারপর সেখানে একদিন দেখেছিলাম একটা বেরাল ছানা খেলা করছে।ভাবলাম এটাকে গরু বানিয়ে নিয়ে যেতে পারলে দারুন একটা বেপার হবে, যেমন ভাবা তেমন কাজ,ওটাকে ধরে দরি দিয়ে বাঁধতে গিয়েই , না কি ওকে জল খওয়াতে পুকুর পানিতে চুবিয়ে ছিলাম ঠিক মনে নেই তবে ওটা আমার হাতে আঁচড়ে দিয়েছিল এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে।শুধু বেড়ালেরই নয় ছোট বেলায় অজস্র বার মামনির কামড় খেতে হয়েছে আমায়। ঝগড়া ঝাটির নিস্পত্তি মনমত না হলে আমি ওর চুল ধরে টেনে দিতাম আর ও আমায় কামড়ে দিত। সঙ্গে সঙ্গে মা ছুটে আসত, ধুপ কাঠি করে ছেঁকা দিয়ে দিত। আর মামনি কে ভয় দেখাত শিল নোড়া দিয়ে ওর দাঁত ভেঙ্গে দেওয়ার কথা বলে।
তখন মা দাদি মেজমা সবাই কে দেখতাম দিন রাত বাড়ির কাজ নিয়ে থাকতে, হয় ধান সেদ্ধ করছে, নয় গরুর গোয়ালে, অথবা ধান ঝারা হবে বলে উঠনে গোবর গোলা দেওয়া হচ্ছে। চাষ বাসের প্রায় পুরোটাই আব্বা দেখত, বেসির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে , দেখতুম মাঝে মাঝে দুপুর বেলায় আব্বা এসেছে মাঠ থকে, কাদা মাখা, ঘামে ভেজা শরীরের উপর ছেঁড়া জামাটা লেপটে আছে। আব্বার খুব অল্প বয়েসে বিয়ে । ২২ কি ২৩ এ বোধায়, তরুণ তরতাজা আব্বা তখন প্রচণ্ড খাটতে পারত।একটু বদরাগী ও ছিল। হয়ত তেতে পুড়ে এসেছে মাঠ থেকে, খেতে বসেছে , কি একটা কারনে হয়ত ডাল হয়নি,অমনি হটাত রেগে গেল, ছুড়ে ফেলে দিল ভাত সমেত থালা, তারপর গটগট করে আবার চলে গেল মাঠে। ওদিকে নারকেল গাছের গোঁড়ায় ভাতের থালা, ভাত ছড়িয়ে পড়ে রইল, ধিরে ধিরে সেখানে জমে যেত কাকেদের মেলা। আমারা ঘরে গিয়ে দেখতুম মা একটা কোনে অন্ধকারে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। মামনিই যেত প্রথম মায়ের কাছে, আর আমি ওকে বারন করতাম -এ এখন জাস না দেখছিস না মা কাঁদছে, অমনি মা বুকে জড়িয়ে ধরত আমাদের।
গ্রামে থাকার সময় আমাকে পড়াশোনা তেমন করতে হয়নি। শুধু আব্বা ওই রাতের বেলা ছাদে পায়চারি করতে করতে যেটুকু শিখিয়েছিল।তারপর যখন বাড়িতে আমার দুরন্তপনাড় বাড়বাড়ন্ত দেখা দিল তখন ঠিক হল আমাকে ইস্কুলে ভর্তি করার সময় এসে গেছে।আলোচনা করতে করতে আব্বারা কি বুঝল কি জানি,ঠিক করল ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে ভর্তি করবে। নিমতালার কাছে একটা ইস্কুল ছিল, হলি চাইল্ড স্কুল, তাতেই ভর্তি করা হবে ঠিক হল, মায়ের চোখে স্বপ্ন আমি পিঠে ব্যাগ কাধে ওয়াটার বোতল আর গলায় টাই ঝুলিয়ে সাফ সুথরো জামা প্যান্ট মোজা জুতো পরে আমি ইস্কুল যাবো, ইংরাজি কবিতা বলব গড়গড় করব -ব্যা ব্যা ব্লাক শিপ.... মাঝ খান থেকে বাধ সাধল দাদি। বলল, কালনায় আমাদের বাড়ি থাকতে এখানে নিমতলায় কেন ভর্তি হব? ওখানে আব্বারা পড়েছে, তো আমি কেন নয়? কত ভালো ভালো স্কুল আছে সেখানে।কিন্তু তাই বা কি করে হয় ? এখানে চাষের কাজে আব্বা কে গ্রামে থাকতেই হবে। মেজআব্বা বরাবর বাউন্ডুলে টাইপের, এমনিতে হাতুড়ে ডাক্তার, নাম-কা-ওয়াস্তা কোনোদিন ডাক্তার খানায় বসত, কোনোদিন বসত না, ওনার যত নেশা ছিল পার্টি আর রাজনীতিতে, গ্রামের যত চ্যাংড়া ছেলেদের নিয়ে 'ভোট দিন বাঁচতে তারা হাতুড়ি কাস্তে' করে বেড়াত, ভোটের আগে রাতে টর্চ জেলে দেওয়ালে দেওয়ালে লাল রং, কার্টুন, বিদ্রুপ আর মুষ্ঠিবদ্ধ লাল হাত আঁকতে শেখানো, আর ভোটের পড় জেতার আনন্দে গ্রামে যাত্রাপালা লাগিয়ে নিজেই অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিত সবার, উনি আর যায় পারুক ওনার রোগা পাতলা শরীরে মাঠের জল কাদায় গা লাগিয়ে পড়ে থাকতে পারত না। তাই দাদিও আব্বা কে ছাড়তে রাজি হল না।জমি গুলোতো কাউকে দেখতে হবে। আব্বা মাকে কি ভবে বুঝিয়ে ছিল কি জানি শেষে একদিন মায়ের হাত ধরে চলে আসতে হল কালনায়। মায়ের বয়স তখন কত? খুব বেশি হলে একুশ কি বাইশ। আমদের কি তখন খুব মন খারাপ করেছিল? নাকি নতুন একটা জায়গায় যাওয়ার আনন্দে মন নেচে উঠেছিল? কে জানে? তবে আব্বা যখন আর সমস্ত জিনিস গুলোর সাথে আমার সেই দুই শিটের তিন চাকা সাইকেলটাও পাঠিয়ে দেবে বলেছিল তখন আমার আর খুব বেশি ভাবনা হয়নি বোধায়।