দাদাভাইয়ের প্রকৃত নাম রোকনুজ্জামান খান। তিনি ১৯২৫ সালের ৯ এপ্রিল রাজবাড়ী জেলা অর্ন্তগত পাংশা উপজেলায় সেকালের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক রওশন আলী চৌধুরী ও এয়াকুব আলী চৌধুরীর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন দাদাভাইয়ের নানা। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মোখাইর উদ্দীন খান। শৈশবে মাকে হারিয়ে নানা বাড়িতে তিনি বড় হন এবং পাংশা জর্জ স্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি কলকাতা চলে যান এবং কলকাতায় মুকুল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আবার একটি সরকারি দফতরে চাকরিও করেন। পারিবারিক জীবনে দাদাভাই ছিলেন দুই কন্যা সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমও দেশের সকলের কাছে সুপরিচিত। তাঁর শ্বশুর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ছিলেন প্রখ্যাতজন।
১৯৪৮ সালে আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত ইত্তেহাদ পত্রিকার 'মিতালী মজলিস' নামীয় শিশু বিভাগের দায়িত্ব লাভের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে শিশু সওগাত পত্রিকায় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালে দৈনিক মিল্লাতের কিশোর দুনিয়া'র শিশু বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় তরুণ সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২রা এপ্রিল শিশু-কিশোরদের উপযোগী কচিকাঁচার আসর বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত হন এবং আসর পরিচালকের নামকরণ করা হয় দাদাভাই। সেই থেকে তিনি নতুন পরিচয় পান দাদাভাই। তাঁর পরিচিতিতেই ছোটদের উপযোগী করে লিখতেন - সুফিয়া কামাল, আব্দুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, ফয়েজ আহমেদ, হোসনে আরা, নাসির আলী, হাবীবুর রহমানসহ বিখ্যাত অনেক লেখক।
১৯৫৬ সালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিশু-কিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন রোকনুজ্জামান খান। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে কচি-কাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠানকে তিনি সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। এতে শিশুদের গান, আবৃত্তি, ছবি আঁকা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য স্থাপন করা হয়েছে কাকলী পাঠাগার। দেহে ও মনে শিশুদের সৎ ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই এসব কার্যক্রমের উদ্দেশ্য। বিখ্যাত অনেক ব্যক্তিত্ব এর সদস্য ছিলেন - সুলতানা কামাল, হাশেম খান, মাহবুব তালুকদার, কৌতুক অভিনেতা রবিউল প্রমূখ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনারা কচি-কাঁচার মেলার অফিস ভাংচুর করে এবং বইপত্র পুড়িয়ে দেয়।
দাদাভাই'র রচনাসমগ্র-
“বাক বাক্ কুম পায়রা
মাথায় দিয়ে টায়রা
বউ সাজবে কাল কি
চড়বে সোনার পালকি”
তাঁর অসামান্য শিশুতোষ ছড়া হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। হাট্টিমাটিম টিম(১৯৬২), খোকন খোকন ডাক পাড়ি, আজব হলেও গুজব নয় প্রভৃতি বই লিখেছেন দাদাভাই। সম্পাদনা করেছেন আমার প্রথম লেখা, ঝিকিমিকি, বার্ষিক কচি ও কাঁচা, ছোটদের আবৃত্তি ইত্যাদি পুস্তক।
শিশুদের প্রতিভা বিকাশে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দাদাভাই ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী। তিনি নিজে অনেক ছড়া ও কবিতা লিখেছেন এবং শিশুদের লেখা সংশোধন ও সম্পাদনা করে পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। এসব রচনার মাধ্যমে তিনি শিশুদের মনে নীতিজ্ঞান, দেশপ্রেম ও চারিত্রিক গুণাবলী জাগানোর চেষ্টা করেন।
পুরস্কার ও সম্মাননাঃ শিশু সংগঠনে অসামান্য অবদান রাখায় রোকনুজ্জামান খান ২০০০ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন। সৃজনশীল সাংগঠনিক কর্মের পুরস্কারস্বরূপ তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮), শিশু একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৪), একুশে পদক (১৯৯৮), জসীম উদ্দীন স্বর্ণপদক এবং রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ও রোটারি ফাউন্ডেশন স্ট্রাস্টির পল হ্যারিস ফেলোসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।
ছোটদের প্রিয় রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর সবাইকে ছেড়ে চলে যান সেই অচেনা এক দেশে। যে দেশ থেকে কেউই আর কখনই ফেরে না। কিন্তু তিনি চলে গেলেও তার অবদানের কথা মনে রাখবে সবাই।
আরও ছবির দেখার জন্য নিচের এই লিংকে ক্লিক করুন-
‘রাজবাড়ী-৭৭০০, বাংলাদেশ’
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:০৮