একজন মানুষ কত ভয় পেতে পারে!??? আজ সেই ঘটনা বলবো। মজা করছি না সত্যি বলছি।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। গ্রামে নানা বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছি। আমার নানা বাড়ী জামালপুর জেলায়। তখল ছিলো শিতকাল। আমার নানা বাড়ীর কাছেই অর্থাৎ ২ থেকে ৩ কিঃ মিঃ দূরেই আমার ছোট ফুপুর বাড়ী। একদিন দুপুর বেলা বাইসাইকেল নিয়ে ফুপুবাড়ীতে চলে গেলাম। অনেক দিন পর পর আসি বলে আমাকে পেয়ে ফুপু আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। খাওয়া-দাওয়ার পর ফুপু আমার মা’র জন্য পিঠা বানাতে শুরু করলো। পিঠা নিয়ে নানাবাড়ী ফিরবো অপেক্ষা করছি। এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো ফুপুর পিঠা বানানোই শেষ হচ্ছে না। সন্ধ্যার পর আমি ভূতে ভয়পাই কাউকে বলতেও পারছি না, লজ্জা লাগছে। সন্ধ্যার পর পিঠা বানানো শেষ হল। একটা পাতিলে সেই পিঠা ভরে সাইকেলে বাঁধা হল। ফুপা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো একা যেতে আমার ভয় লাগবে কিনা? আমি ভয়পাই এ কথাতো আর কাউকে বলতে পারলাম না। তাই সাহসীর মতো বল্লাম না না ফুপা ভয়ের কি আছে?
এদিকে ঐ বিশাল ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে কাঁচারাস্তা, অন্ধকারে একা একা সাইকেল চালিয়ে যেতে হবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। ফুপা আমার সাইকেলে একটা টর্চলাইট বেঁধে দিলেন।
টর্চের আলোতে সাইকেল চালিয়ে আমি নানাবাড়ীতে ফিরছি। গ্রামে সন্ধ্যার পরই কেমন যেন নিরব হয়ে যায়। ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে আসার সময় কোন দিকে তাকাচ্ছি না। মনে মনে ভাবছি ‘যা খুশি হয়ে যাক আমি কিছু দেখবো না’, শুধু রাস্তা দেখে সাইকেল চালিয়ে চলে আসছি। মাঠ পার হয়ে যখন নানা বাড়ীর খুব কাছে চলে এলাম বুকের ভিতর থেকে কেমন যেন একটা গরম নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো, হাফছেড়ে বাঁচলাম। আর মাত্র পাঁচ/ছয়’শ গজ দূরেই নানাবাড়ী। এই পথটুকুর দুই পাশে গাছ আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা। দিনের বেলাতেই কেমন যেন অন্ধকার হয়ে থাকে।
হঠাৎ আমার মনে হলো কে যেন আমাকে গাছের ডাল থেকে একটা ভিষণ জোরে একটা লাত্থি দিল। আমি সাইকেল নিয়ে হুমরি খেয়ে পরে গেলাম। কিসের সাইলেক আর স্যান্ডেল সব ফেলে আমি দিলাম দৌড়.......।
নানাবাড়ীর উঠোনে তখন আমার মামাতো ভাই বোনেরাসহ ১০/১২ জন খর জ্বালিয়ে আগুনের তাপ নিচ্ছে। আমি সেখানে গিয়ে হাউ-মাউ করে কেঁদে দিলাম। সবই জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে? কি হয়েছে? আমি বল্লাম আমাকে ভূতে লাত্থিদিয়েছে! আমার কথায় সবাই হাঁসাহাসি শুরু করলো। শুধু আমার মা কথাটা সিরিয়াস্লি নিল। সে সবাইকে একটা ধমক দিয়ে বল্ল এই তোরা হাঁসাহাসি বন্ধ কর। দেখ ও সত্যিই ভয়ে কাঁপছে। তখন গ্রামের পদ্ধতিতে ভয় পাওয়া মানুষকে যা যা করে তারা তাই করতে লাগলো। একজন দোয়া-কালাম পরে আমার গা’য়ে ফুঁ দিলো। একজন পানির সাথে লবন মিশিয়ে আমাকে খাওয়াল।
কিছু ক্ষণপর আমি সত্যিই শান্ত হলাম। আমার বড় মামাতো ভাই আমাকে বল্ল সাইকেল কোথায় ফেলে এসেছিস? চল নিয়ে আসি। আমি বল্লাম যেখানে আমাকে লাত্থি দিয়েছে সেখানেই সাইকেল ফেলে এসেছি, আমি মরে গেলেও সেখানে আর যাব না, তোমরা সবাই গিয়ে নিয়ে আসো। অনেক টানাটানির পরও আমি যখন যেতে রাজি হলাম না তখন আমার মা বল্ল তুইও ওদের সাথে যা, এখন ওখানে না গেলে মনের মধ্যে ভয়টা থেকে যাবে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মা’র কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ১০/১২ জনের সাথে সাইকেল উদ্ধারে রওনা হলাম। কিছু দূর এসেই আমার নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগতে লাগলো। আসলে ওরা ওখানে গিয়ে ভূত, প্রেত কিছুইতো পাবে না, মাঝখান থেকে কাল সকালে সবাই আমাকে নিয়ে হাঁসাহাসি করবে। ১০/১২ জনের সাথে যখন রওনা হয়েছি তখন নিজেকে ভিষণ সাহসি মনে হচ্ছে। কয়েক মিনিটেই সেখানে চলে এলাম, আমার মামাতো ভাই আমাকে প্রশ্ন করলো তোকে কোত্থেকে থেকে লাত্থি দিয়েছে? আমি একটু এগিয়ে ঐগাছটার নিচে এসে হাত উঠিয়ে বল্লাম ঐখান থেকে। ওরা পেছন থেকে টর্চলাইটের আলো ফেল্ল। আমি দেখলাম আমার হাতের খুব কাছে একজোড়া পাঁ তখনও ঝুলছে।
আসালে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে ঐজায়গার খুব কাছেই একটা বাড়ী আছে সেই বাড়ীর বড় মেয়ে স্বামীর সাথে ঝগড়া করে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। গলায় দড়ি দেয়া অবস্থায় তখনও ঝুলছে।
টর্চের আলো জ্বালার সাথে সাথেই আমার পেছন থেকে ঐদৃশ্য দেখে ১০/১২ জন এক সাথে চিৎকার করে উঠলো। আমি একবার ভয় পেয়ে গিয়েছি, আবার যাদের সাহসে এসেছি তারাই ভয়ে চিৎকার করছে। সবাই চিৎকার করেছে শুধু আমি করিনি। আমার গলা দিয়ে কোন সাউন্ড বেরুল না। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। আমার যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন শুধু দেখলাম অনেক গুলো মুখ উপুর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এর ভিতর একজন বলছে- না না ওতো মরে নাই, এইতো জ্ঞান ফিরেছে।
এরপর বহুকাল ঘুমুতে পারতাম না। চোঁখ বুঝলেই শুধু একজোড়া পা ঝুলছে, শুধু সেই দৃশ্য দেখতাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৩:১৮