আজ আপনাদের কাছে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা বর্ণনা করবো, অনেকে হয়তো বিশ্বাস করেন না। আমি নিজেও হয়তো বিশ্বাস করতাম না..................
গত শুক্রবারে বেলা দশটার দিকে বাসার সামনের একটি দোকানে চা খেতে গিয়েছি। হঠাৎ ছোট্ট একটি মেয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি বাসের সামনে গিয়ে পড়ে। বাসটি বাচ্চাটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে নিয়ন্ত্রন হারিয়ে আমি যে দোকানে বসেছিলাম ঠিক তার পরের দোকান ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে এমন একটি দূর্ঘটনায় হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। আমি দোকান থেকে বেড়িয়ে ঐ বাচ্চা মেয়েটিকে খুজতে থাকি। হঠাৎ দেখতে পাই রাস্তার পাশে ভয়ানক রক্তাক্ত অবস্থায় ঐ মেয়েটি পড়ে আছে। দৌড়ে মেয়েটির কাছে গিয়ে আমি তাকে চিনতে পারি, একি! এতো আমার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকার ক্লাস থ্রি তে পাড়া মেয়ে! আমার বাড়ীর পশেই বাড়ী। কোন দিকে না তাকিয়ে তখনি মেয়েটিকে কোলে নিয়ে একটি রিক্সায় উঠে সোজা হাসপাতালে রওনা হই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার এলাকার অনেকেই মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে চলে আসে। তাদের কাছেই জানতে পারি কোন বাসযাত্রী বা আর কারো কোন তেমন ক্ষতি হয়নি। হাসপাতালের ইর্মাজেন্সিতে থাকা অবস্থাতেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আমার সেই শিক্ষিকা হাসপাতালে এসে হাজির হয়। চাঁদের মতো ফুটফুটে এই বাচ্চা মেয়েটার এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমারই কান্না পাচ্ছে আর সে তো মা, সে তো কাঁদবেই। হাসপাতেল বড় ডাক্তার এসে তখন আরও একটা দুঃসংবাদ দিলেন, তিনি বল্লেন আঘাত গুরুতর এখনি ঢাকায় নিয়ে যান, এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। দ্রুত ঢাকায় না নেয়া হলে আরও বড় সমস্যা হতে পারে। ডাক্তারের কথা শুনে আমার শিক্ষিকা কান্না থামিয়ে নিথর হয়ে বসে পড়লেন। আমি বুঝলাম তাকে শান্তনা দেয়া অর্থহীন। যা করার এলাকার আমরা যারা আছি তাদেরই করতে হবে। হতদরিদ্র এই পরিবারের এই মেয়েটার জরুরী চিকিৎসা প্রদানেরও ক্ষমতা নেই আমরা সাবাই তা জানি। আমার মনিব্যাগে দুই হাজার টাকা ছিল তা বের করে উপস্থিত আমার বন্ধু বান্ধবসহ এলাকার সকল মানুষের কাছে সাহায্য চাইলাম। প্রায় সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। দেখতে দেখতে প্রায় বিশ হাজার টাকা আমার হাতে চলে এলো। বুঝলাম শুধু আমি নই এই হতদরিদ্র শিক্ষিকার প্রতি ভালবাসা আর মমতা এলাকার প্রায় সকলেই আছে। আমি খুশি হয়ে গেলাম। ইর্মাজেন্সি বিভাগ থেকে আমার হাতে একটি প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বলেছে এই ঔষধ গুলি নিয়ে আসেন, স্যালাইনের সাথে এই ঔষধ গুলি পুশ করে তারপর রওনা দিতে হবে। আমি প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে ঔষধগুলি আনানোর জন্য মানুষ খুজচ্ছি হঠাৎ আমার শিক্ষিকার স্বামী অর্থাৎ ঐ বাচ্চাটির বাবাকে দেখতে পেলাম, তাকে আমি শুধু শিক্ষিকার স্বামী হিসাবেই চিনি তা নয়, তিনি আমাদের এলাকার একজন বড় ভাইও, অনেক ছোট বেলা থেকেই তাকে চিনি এবং সম্মানও করি।
আমি তাকে প্রেসক্রিপশনটা দিলাম এবং সাথে একহাজার টাকাও, বল্লাম খুব দ্রুত এই ঔষধগুলি নিয়ে আসেন ভাই। তিনি প্রেসক্রিপশন এবং টাকা নিয়ে খুব দ্রুত চলে গেলেন। হাসপাতালের সামনেই অনেক ঔষধের দোকান ঔষধ নিয়ে আসতে দশ থেকে বিশ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না।
এ্যাম্বুলেন্স চলে এলো। ইর্মাজেন্সি বিভাগের ডাক্তারও অপেক্ষা করছে সবকিছু রেডি করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হবে। কিন' ঔষধ নিয়ে বাচ্চাটির বাবা আর আসছে না। ডাক্তার সাহেব তাড়া দিচ্ছেন, আমার বন্ধুরাও তাড়া দিচ্ছেন- কিরে কার কাছে প্রেসক্রিপশন দিয়েছিস আসছেনা কেন? আমি বল্লাম, বাচ্চার বাবার কাছেই তো প্রেসক্রিপশন আর একহাজার টাকা দিয়েছি, হাসপাতালের সামনে হয়তো ঔষধ পায়নি, হয়তো বড় বাজারে গিয়েছে, এখনি চলে আসবে।
বিশ মিনিট, ত্রিশ মিনিট এভাবে একঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পর আমার পরিচিত এক রিক্সাওয়ালা এসে আমাকে বল্ল আপনারা কার জন্যে অপেক্ষা করছেন? সেই ভাইরে তো দেখলাম লোকশেড যাইতে! তার অপেক্ষা করে লাভ নেই। আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে বলছি, আমার এই জেলায় রেল স্টেশনের পাশেই লোকশেড নামে একটি স্থান রয়েছে, যাবতিয় নেশাজাতীয় দ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য কুখ্যাতি সম্পন্ন স্থান এটি। আমার একবন্ধু বল্ল একজন ইয়াবা খোড়ের হাতে টাকা আর প্রেসক্রিপশন দেয়াটা ঠিক হয়নি। আমি কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি বলছে এরা? এই লোকের মেয়ে মৃত্যুশয্যায়। এই লোক মেয়েকে এভাবে ফেলে ইয়াবার নেশা করতে যাবে? ইয়াবা কি মানুষকে জানোয়ার করে দেয়?
কথা না বাড়িয়ে ইর্মাজেন্সি বিভাগ থেকে আর একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঔষধ এনে আমার সেই শিক্ষিকাসহ চারজন কে সাথে দিয়ে ঢাকায় পাঠালাম। আমার জামা প্যান্টে বাচ্চাটির রক্ত তখনও লেগে ছিলো। বাসায় এসে জামা-কাপড় পাল্টে, গোসল করে বেড় হলাম। আরও দুই বন্ধুকে সাথে নিয়ে বেড় হলাম জানোয়ার নিধনে। কত বড় জানোয়ার ঐ লোক তাই দেখতে। প্রায় সাড়া দিন বসেছিলাম ঐ বাড়ীর সামনে, ঠিক সন্ধ্যার পর ঐ লোককে দেখে মূহুর্তের মধ্যেই মাথায় আগুন লেগে গেলো। একটি চলা কাঠদিয়ে কতগুলি বাড়ি দিয়েছি এখন মনে করতে পারবো না, রাগে ক্রোধে আমি হয়তো পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, কয়েকজন মুরুব্বি আমাদের ঠেকাচ্ছিল আর বলছিলো ‘মরা মেরে খুনের দায়ে পরিসনে বাবা’। অঝড়ে কান্নার বয়স হয়ত আমার আর নেই, তাই বাসায় এসে মনে মনে কেঁদেছি অনেকক্ষণ। আমার ঐ শিক্ষিকার দূভাগ্যের কথা ভেবে আর একদিন যাকে দেখে দূর থেকেই সালাম দিতাম সেই বড় ভাই এর অমানুষ হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে। ঐ দিনই মনে মনে কসম কেটেছি কোন মাদক ব্যবসায়ির পক্ষে আর কোন দিন কোর্টে কেস লড়বো না। আমার ঐ শিক্ষিকার সম্মানে ঘটনার বর্ণনায় কোন নাম ঠিকানা উল্লেখ করলাম না।
ওহ্ হ্যা---- দুটি সুখবর পেয়েছি আজ
১. মেয়েটি মোটামুটি সুস্থ্য হয়েছে।
২. ঐ লোক এখনো হাসপাতালে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:১২