আমি যেদিন প্রথম এ্যাডভোকেট হিসাবে কোর্টে গিয়ে ছিলাম, গরমের মধ্যে কোর্ট, প্যান্ট, টাই, গাউন পড়েছিলাম। প্রচন্ড গরমে দরদর করে ঘামছিলাম পোষাকটার জন্য। আমার খুব আন্তরিক সম্পর্কের একজন বড় ভাই, নাম শাহজাহান মৃধা তিনি ছিলেন জজ কোর্টের পেশকার। তার সাথে দেখা করতে গেলাম। আমার ঐ অবস্থা দেখে তিনি আমাকে তারাতাড়ি একটা চেয়ার টেনে বসতেদিয়ে বল্লেন, ফ্যানের নিচে কিছুক্ষণ বসেন। আপনিতো গরমে ঘেমে একদম গোসল করে ফেলেছেন। আমি ফ্যানের নিচে বসলাম।
তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, বলেনতো উকিলদের এই পোষাকটা কিভাবে এসেছে?
তার প্রশ্ন শুনে আমি হেসে ফেল্লাম, আমি উকিল আর এই প্রশ্নের উত্তর জানবো না? আমি বল্লাম এই পোষাকটা ব্রিটিশ আইন অনুশারে এসেছে।
শাজাহান ভাই খুব সিরিয়াস ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বল্লেন, না আপনি জানেন না!
আমি বল্লাম- তাহলে?
শাজাহান ভাই আরও সিরিয়াস হলে বল্লেন- এই পোষাকটা আল্লার তরফ থেকে নাজিল হয়েছে ভাই, সত্যি বলছি আল্লার তরফ থেকে নাজিল হয়েছে, কারন এদের পৃথিবীতেও শাস্তি হওয়ার দরকার আছে।
আমি তার কথা শুনে হেসে ফেল্লাম। বল্লাম- উকিলদের উপর এতো ক্ষেপেছেন কেন ভাই?
তিনি বল্লেন- আজকে আপনার কোর্টে প্রথম দিন, আর কয়েকদিন কোর্টে আসেন, এরা কি করে আর না করে অটোমেটিক বুঝে যাবেন।
উকিল আর পুলিশ শব্দ দুটি শুনলেই মানুষ কেমন ভাবে যেন তাকায়.......... একদিন এক বৃদ্ধা ভিক্ষুক মহিলা আমাকে বলেছিলেন ‘এতো ভালা মানুষটা মিছ্যা কতা কওনের কামে ক্যানযে আইলো?’ এতো গেল উকিলের ইমেজ।
বাংলাদেশের পুলিশের ইমেজ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু ছোট্ট একটা আইন বলেই লেখাটা শেষ করবো।
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন অনুশারেই বাংলাদেশের বিচার কার্য পরিচালিত হয়। ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ শাসন ছিল। এই আইন ব্রিটিশরা তৈরি করলেও ইংল্যান্ডের জন্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য এক রকম সাক্ষ্য আইন ছিল না, কিছু পাথ্যর্ক করে সাক্ষ্য আইন তারা তৈরি করেন। এই পার্থকেরই দুটি খুব ইন্টারেস্টিং পার্থক্য আপনাদের বলবো।
পার্থক্য নাম্বার-১
ভারতীয় উপমহাদেশের কোর্টগুলি শুধু মাত্র পুলিশ স্বাক্ষীর পরিপ্রেক্ষিতে আসামীদের শাস্তি দিতে পারবে না। কিন্তু ইংল্যান্ডে শুধু মাত্র পুলিশ স্বাক্ষীর ভিত্তিতেও আসামীদের শাস্তি প্রদান করতে পারবে।
অর্থাৎ কোন পুলিশ যদি কোর্টে স্বাক্ষী দিতে গিয়ে বলে আমার চোখের সামনেই এই লোক অমুক লোককে গুলি করেছে অথবা আমি তার কাছথেকে হাতেনাতে অস্ত্রটি উদ্ধার করেছি, তাতে কোন লাভ নেই, পুলিশের এই স্বাক্ষী শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রহন যোগ্য নয়। কিন্তু ইংল্যান্ডে গ্রাহনযোগ্য।
ব্রিটিশরা এতো বছর আগেই এই দেশেগুলির পুলিশের চরিত্র বুঝে ফেলেছিলেন!
পার্থক্য নাম্বার-২
মানুষ মৃত্যুর আগে, মৃত্যুর কারন বর্ণনা করলে তাকে ‘মৃত্যুকালীন ঘোষণা’ বলা হয়। সাক্ষ্য আইন অনুশারে ভারতীয় উপমহাদেশের কোর্টগুলি শুধু মাত্র মৃত্যুকালীন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে কোন ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারবে না, কিন্তু ইংল্যান্ডের সাক্ষ্য আইন অনুশারে শুধু মাত্র মৃত্যুকালীন ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতেই আসামীদের শাস্তি দিতে পারবে।
অর্থাৎ আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুর আগে যদি আমাকে কে কে মেরেছে তার বর্ণনা করেও যাই, তবুও শুধুমাত্র আমার বর্ণনায় আসামীদের শাস্তি প্রদান করা যাবে না। কিন্তু ইংল্যান্ডে যাবে।
এই পার্থক্যের কারন হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন- ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায় তারা মৃত্যুর সময়ও মিথ্যা কথা বলে, তারা মৃত্যুর সময় চিরশত্রুদের নাম বলে যায়।
আমরা এখনও সেই সাক্ষ্য আইন অনুশারেই বিচারকার্য পরিচালনা করে যাচ্ছি.....................
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:৩১