somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার 'মাস্টর' বাবা ...

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সন্ধ্যা ৭:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- এ্যারে, হোলা ইয়া কন রে ?
- চিনেন ন? আন্ডা মাস্ঠরের হোলা।
- হাছানি? হোলা দি বড্ডা অই গ্যাছে। তো মাস্ঠর বাইত আইছে কবে?
- কাইল্ল্যা আইছে।
- ভাতিজা কি খাইবা? ছা না পান্টা?
- জ্বি না। কিছু খাব না।

ছোট আমি লজ্জায় না বলি। ফুফাতো ভাইদের সঙ্গে টুকটুক করে বাজারে ঘুরে বেড়াই। তখনও জানি না বাবাকে মাস্টার কেন বলা হয়।

একটু বড় হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে মজার তথ্য জানি। বাবা যখন মেট্রিক পাস করে তখন গ্রামের সবাই তাকে মাস্টার ডাকা শুরু করে। বাবার আগে গ্রামে আরেকজন মেট্রিকপাস করেছিল। পরে সে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করে। সবাই তাকে মাস্টার বলত। সে ধারাবাহিকতায় মেট্রিক পাসের পর বাবাকেও মাস্টার ডাকার চল শুরু হয়ে যায়। অথচ এই মেট্রিকপাস করতে গিয়ে বাবাকে কম ঝামেলা করতে হয়নি।

অতো বেশি ইংরেজি কেন পড়তে হবে - এই ধারণায় বাবাকে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়াতে উৎসাহ দেয়া হয়নি। আমার দাদা-দাদী তখন বেঁচে ছিলেন না। তাই বাবারও কারো কাছে আব্দারের জায়গা ছিল না। বাবার ফরম ফিলাপের পয়সা জোগাড় হচ্ছিল না। কিন্তু বাবার খুব ইচ্ছা ছিল মেট্রিক পরীক্ষা দিবে। সেই সময় বাবার দূরসম্পর্কের এক খালা বাবাকে একটা বুদ্ধি দিলেন। নতুন ঘর উঠানোর জন্য তখন দাদাবাড়িতে চাচারা টিন কিনে রেখেছিলেন। বাবা একরাতে সেইগুলো চুরি করে বেচে দিয়ে সোজা চট্টগ্রামের মিরসরাই চলে গেলেন। মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তবেই ফিরলেন। আমার বাবার সারাজীবনে এটাই প্রথম এবং শেষ সাহসী কর্মকান্ড।

আমার বাবা বিয়েপূর্বক খুব অল্পসময়ের জন্য প্রেম করেছিলেন। মা-র সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর বড়মামাকে বাবা পড়াতেন। তখন মা-র সঙ্গে মাত্র এনগেজমেন্ট হয়েছে। সে সময়ে মা-র সঙ্গে নাকি একটু প্রেম প্রেম সময় কেটেছিল। মা আমাদের গল্প করতেন, তোর বাবা যখন ঢাকায় চলে আসবে তখন আমি একটা বড় পেয়ারা দিয়েছিলাম যেন যাত্রাপথে খায়। তোর বাবা সেটা না খেয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরে অফিসের সমস্ত কলিগদের ছোট ছোট ভাগ করে ওই পেয়ারাটা খাইয়েছিল।

বাবা হলেন চরম শান্ত স্বভাবের একটা মানুষ। মা-র হাজারো চেঁচামেচিতে কখনো রা করতেন না। অবৈষয়িক বাবা ঘুষটাও খেতে পারেন না। তার কলিগদের বাড়ি-গাড়ি হয়ে যায় অথচ তার সরকারি কোয়ার্টারের এলোকেশন ক্যানসেল হয়ে যায়। আমার মাস্টর বাবা এসবে বিরক্ত হন না।

একবার বাবা খুব রেগে গিয়েছিলেন। পরীক্ষার আগের রাতে আমি কিশোর থ্রিলার বইয়ের তলায় লুকিয়ে পড়ছিলাম। মা-র হাতে ধরা পড়ে যাই। অমনি মা-র চিৎকার চেঁচামেচিতে সারা বাড়ি মাথায় উঠল। আমার শান্ত বাবাও খেপে গেলেন। দুমদাম মার দিলেন আর পিড়ি দিয়ে টিভিটা ভেঙে ফেললেন। ওইদিন প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম।

সেই শান্ত বাবাই আরো একবার ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমাকে। ১২ এপ্রিল ২০০৫। ওইদিন রাত ১১টায় আমার লন্ডন ফ্লাইট। জীবনে এই প্রথম বিমানে চড়ব। ঘুম থেকে সকাল ৯টার সময় উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখি বাবা পেপার পড়ছেন। আমি আমার রুমে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর মা এসে বলে, দেখতো তোর বাবা জানি কেমন করছে। আমি দৌড়ে যাই। বাবা তখন বুকে হাত ঘষতে ঘষতে বলছে, আরে না। আমার কিছুই হয়নি। মা সন্দেহের সুরে বলে, হার্ট এ্যাটাক না তো? আমি তড়িঘড়ি করে বাবাকে সোহরাওয়ার্দী নিয়ে যাই।

বাবাকে হাসপাতালের বারান্দায় মাটিতে শুইয়ে রাখা হয়েছে। কোনো সিট নেই। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। আমার বাবা মাটিতে আর আমি যাব লন্ডনে। ডাক্তাররা একগাদা পরীক্ষা করতে দিয়েছে। আমি পাগলের মতো ছুটছি। লন্ডনের মায়রে বাপ। টিকেট ক্যানসেল করতে হবে। কিন্তু কেমনে? বাবা তখনও কথা বলতে পারে। কাছে ডেকে বলে, তুই চলে যাস। আমার কিছুই হয় নাই। আমি বলি, তুমি কথা বোলো না তো।

এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার মোবাইল ফোন নিয়ে। নানান জায়গায় ফোন করে পরবর্তী ২ ঘন্টার মধ্যে সব সিস্টেম করি। প্রচুর আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুবান্ধব দিয়ে হাসপাতাল ভরে ফেলি। বাবাকে সিটে তুলি। বিকেল হয়ে যায়। ডাক্তাররা বলেন, মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। মাত্র ৪টা সেল কলাপস করেছে। ঠিক হয়ে যাবে। বাবার কাছে যাই। বাবা নরম স্বরে বলে, তুই লন্ডন যা। আমি ঠিক হয়ে যাব।

গত ৯ আগস্ট বাবা রিটায়ার্ড করেছেন। গতবছর বাবার হার্টের অস্ত্রোপচার হয়েছে। এখন অনেকটাই সুস্থ আছে। সারাজীবন নরম বাবা এখন আরো নরম হয়ে গেছে। ঢাকায় থাকতে বাবাকে আমি জিন্স আর রঙ্গিন টি-শার্ট জোর করে পড়াতাম। ছোটভাইকে বলেছি সবসময় বাবাকে কৌতুক শুনাতে। যেন প্রতিদিনই তিনি কিছুক্ষণের জন্য হাসেন।

বাবা একবার বলেছিলেন, সরকারি স্কেলের সর্বনিম্ন স্যালারি পাওয়া লোকেরাও ঈদ করে, পোস্ট অফিসে টাকা জমায়। কতো এমএ বিএ পাস ছেলে আমার কাছে পিয়নের চাকরি করতে আসে। তোরা কেন পড়াশোনা করস না? ঠেলাগাড়ি চালাইয়া খাইতে হইব।

বাবার এখন সময় কাটে পেপার পড়ে আর ছোটভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে। মা-কে বলেছি বাবাকে নিয়ে মাঝে মাঝে গ্রামে যেতে। মা ঝামটা মেরে উঠে, রাখ তোর গ্রাম। তোর বাবা তো প্ল্যান করছে গ্রামে বাড়ি বানাইব।

আমি হাসি। বাবার অবস্থান বুঝতে পারি। ইংরেজি পড়তে গিয়া বাবু হয়ে শহরে স্যাটেল হয়েছে। কিন্তু বাবার সবসময় গ্রামে মন পড়ে থাকে। আমি খেয়াল করেছি বাবা গ্রামে গেলে মন ভাল থাকে। আমার ইচ্ছা আছে শেষ বয়সে বাবা যেন গ্রামে বেশ সময় কাটাতে পারে তার জন্য একটা ছোট বাংলো টাইপের বাড়ি করব। দেখি কতোদূর কি করা যায় ....
১৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×