ঢাকা, ১৪ জুলাই: পারস্য উপসাগরে বড়সড় মার্কিন সেনা ঘাঁটি তৈরির নির্দেশ নতুন করে দিয়েছে ওবামা প্রশাসন। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক অনুমোদনের ছাড়পত্র দিয়েছিল। কিন্তু ফের নতুন করে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার তোড়জোরে কার্যত উত্তেজনা ছড়িয়েছে ইরানে। পারস্য উপসাগরে ইতোমধ্যেই বিশাল সংখ্যক রণতরী মোতায়েন করার কাজ শুরু করে দিয়েছে পেন্টাগন। পারস্য উপসাগরের আশপাশের দেশগুলির ওপর মার্কিন যুদ্ধ বিমানের টহলদারিও শুরু হয়েছে।
নতুন করে এই সামরিক প্রস্তুতির উদ্দেশ্য কী? ‘নিউইয়র্ক টাইমস্’-এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, এই সামরিক তোড়জোরের লক্ষ্য ইরানকে কিছু বার্তা দেয়া যাতে হর্মুজের কৌশল নীতির সঙ্গে ইরান ঘনিষ্ঠ হতে না পারে। পাশাপাশি, ইসরাইলকে আশ্বস্ত করা যাতে ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র, গবেষণাগারগুলির ওপর ইসরাইল কোনও আক্রমণ না করে। এরই সঙ্গে ‘ইরানের প্রতি নরম’ ওবামা, রিপাবলিকান শিবিরের এই সমালোচনাকে বন্ধ করে দেয়া।
মার্কিন সেনাঘাঁটি নির্মাণের এগুলি প্রকৃত উদ্দেশ্য কিনা তার উত্তর নিশ্চয়ই সময় বলবে। কিন্তু মার্কিন এই সামরিক তৎপরতা সশস্ত্র সংঘাতের পথই তৈরি করছে। এমনকী বিধ্বংসী পরমাণু যুদ্ধের কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। অসংখ্য মানব জীবনের ক্ষয়, সম্পদ ধ্বংস এবং গোটা অঞ্চল জুড়ে অর্থনৈতিক ক্ষতিই ডেকে আনতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধ।
‘টাইমস্’ পত্রিকার এক প্রতিবেদন বলছে, আটটি রণতরীতে মাইন বিধ্বংসী অস্ত্রের পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে মার্কিন নৌবাহিনী। এদিকে গত বসন্ত থেকেই ওই অঞ্চলের সেনা ঘাঁটিগুলিতে এফ-২২ এবং এফ-১৫সি যুদ্ধ বিমানের মজুত করা শুরু করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী। পাশাপাশি, ওই অঞ্চলে জেট বিমান এবং টহলদারি বিমানের নজরদারি চলছে।
‘টাইমস্’-এর ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এই অতিরিক্ত হানাদার যুদ্ধ বিমান উপসাগরীয় অঞ্চলে আসার ফলে উপকূলীয় মিসাইল হানার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। যুদ্ধ জাহাজকে ধ্বংস করে ফেলা যাবে এমনকি ইরানের অভ্যন্তরীণ কোনো লক্ষ্যবস্তুকেও নিশানা করে ধ্বংস করা সম্ভব হবে।
এরই সঙ্গে মার্কিন সেনা ঘাঁটিগুলিতে পাঠানো হয়েছে এক উভচর পরিবহন, ইউএসএস পোন্স। পাঠানো হয়েছে ডবিং শিপ যাকে রূপান্তরিত করা হয়েছে ‘অ্যাফ্লোট ফরওয়ার্ড স্টেজিং বেস (এ এফ এস বি)-এ’। এধরনের যুদ্ধ জাহাজে রয়েছে একটি হেলিকপ্টার অবতরণের ডেক, একটি ফিল্ড হাসপাতাল, স্পেশাল অপারেশনস ট্রুপস্-এর সৈন্যদের জন্য বিশাল সংখ্যক বাঙ্ক। সব মিলিয়ে ইরান আক্রমণের ক্ষেত্রে স্থল, জল এবং আকাশ তিন জায়গাতেই আক্রমণ শাণাতে পারবে এ জাতীয় যুদ্ধ জাহাজ।
‘টাইমস’ পত্রিকার ওই প্রতিবেদনে ইরান আগ্রাসনে ওবামা প্রশাসন এবং পেন্টাগন-এর আগ্রাসী মনোভাবের সমর্থন মিলেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ আধিকারিকদের তরফে। এক আধিকারিকের মতে, যখন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট বলছেন টেবিলে বসে আলোচনা ছাড়াও অন্য পথ রয়েছে তখন তিনি আক্রমণকেই বোঝাতে চেয়েছেন এবং তারজন্যই পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সেনা ঘাঁটি গড়ে তোলার এই তোড়জোর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক অবশ্য শুনিয়েছেন অন্য কথা। তার মতে ইরানের কাছে বার্তা এই যে আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেছে এমন ভাববেন না। আমরা প্রতিবন্ধকতাগুলিকে দূর করব। আমাদের জাহাজ বা বাণিজ্য তরীগুলিকে নৌকো পাঠিয়ে ঝামেলায় ফেলবেন না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা কিন্তু বিষয়টিকে অন্যরকমভাবে দেখছেন। তাদের মতে পারস্য উপসাগরকে ওয়াশিংটন আমেরিকার কোনও হ্রদ হিসেবে ভাবছে।
এদিকে ইরানের তেল রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশ আমদানি করতে আগে সম্মত হলেও খুব সম্প্রতি ইরানের তেলের ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এখানেই শেষ নয়, ইরানের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন চালানো অন্যান্য দেশগুলিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আমেরিকা বলেছে, ইরানের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক বা লেনদেন চালালে মার্কিন ব্যাঙ্ক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ওই দেশগুলির ব্যাঙ্ক তথা অর্থনীতির আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না।
গত বছর থেকে ইরানের তেল রপ্তানির প্রায় ৪০ শতাংশ ছাঁটাই করা হয়েছে। ইরানের প্রতি এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের মাশুল গুণতে হচ্ছে ইরানের শ্রমজীবী মানুষকে। ইরানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্বের হার।
পশ্চিমী শক্তির কাছে ইরানের সরকারকে পারমাণবিক কর্মসূচীর প্রশ্নে নতজানু করতেই এই চাপ বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক ওয়াকিবহাল মহল। ইরানের সরকার পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজে নিমগ্ন এ ধরনের অভিযোগ ইরানের বিরুদ্ধে উঠলেও তেহরান তা পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছে। তেহরান বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে শান্তির উদ্দেশ্যেই পারমাণবিক কর্মসূচির কাজ চালাচ্ছে ইরান।
সম্প্রতি ইস্তানবুলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলি ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইরানসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলির পরমাণু বিশেষজ্ঞরা। এর আগে গত মাসে মস্কোতে আলোচনা বসে কিন্তু সেই আলোচনায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। অচলাবস্থার কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীরা তেহরানকে নানা বিষয়ে চূড়ান্ত সময়সীমা দিতে শুরু করে। নানা বিষয়ে ঊর্ধ্বসীমা স্থির করে দিতে শুরু করে। বলা হয়, ২০ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম উত্তোলন করতে পারবে না ইরান। ফর্জেতে ইউরেনিয়াম প্ল্যান্ট বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীরা অবশ্য ইরানের দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছে। উলটে আমেরিকা বলছে, নিউক্লিয়ার নন প্রলিফারেশন ট্রিটি অনুযায়ী ইরানের অধিকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে তারা। যাতে ইরান আরও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ হতে পারে তাই ইরানের প্রতি আর্থিক অনুমোদনও সম্প্রতি দেয়া হচ্ছে।
কূটনীতির পথে পারমাণবিক বিতর্কের সমাধানের প্রশ্নে ওয়াশিংটনের প্রকৃত সদিচ্ছা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করেছে তেহরান। ইরানের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রামিন মেহমান পরাস্ত জানিয়েছেন, সম্ভবত উদ্ভূত এই পরিস্থিতির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যোগ রয়েছে।
অন্যদিকে পেন্টাগনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস্’ জানিয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে মার্কিন দ্বন্দ্ব, সঙ্ঘাত মার্কিন অর্থনৈতিক এবং সামরিক আগ্রাসনের অনুসারী যা আমেরিকার কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা টাইমস-কে জানিয়েছেন, প্রশ্ন ইরানের পারমাণবিক উচ্চাশার নয়, প্রশ্ন ইরানের আঞ্চলিক কর্তৃত্ব স্থাপনের উচ্চাশার। তেল সমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর এবং মধ্য এশিয়া অঞ্চল জুড়ে মার্কিন কর্তৃত্বকারী উচ্চাশার পথে বাধা ইরান। গত এক দশকে আফগানিস্তান এবং ইরাকে দু-দু’টি যুদ্ধের পর ইরানের বিরুদ্ধে তৃতীয় আরও ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আমেরিকা।
হরমুজের স্ট্র্যাটেজিক স্ট্রেইট বন্ধ করার হুঁশিয়ারি আসছে পশ্চিমী শক্তিগুলির কাছ থেকে এমনই মত ইরানের। ইরানের তেলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ইরানের পার্লামেন্ট মজলিশ-এ আলোচনা হয়। দেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিদেশনীতি বিষয়ক কমিটিতে আলোচনা হয়। এক প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে সই করে সমর্থন জানিয়েছেন ১২০ জন পার্লামেন্টের সদস্য।
ইতোমধ্যে তিন দিনের সামরিক মহড়া করে নিল ইরানের রেভলিউশনারি গার্ডসরা। ইরানের মরুভূমিতে মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল ছোঁড়া হয় সেনাবাহিনীর তরফে। এর মধ্যে ছিল ৮০০ মাইল পাল্লার শাহাব-থ্রি মিসাইল যা ওই অঞ্চলের ইসরাইল এবং মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে। আলোচনার টেবিলে বসে রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য ও সৌজন্য, শিষ্টাচার ভঙ্গের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই ইরানের এই পরীক্ষামূলক সামরিক মহড়াকে ব্যাখ্যা করেছেন জেনারেল হোসেইন সালামি। ইরানের বিদেশমন্ত্রক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কোনও রকম আন্তর্জাতিক আইনী এবং নীতি নির্দেশিকার তোয়াক্কা করে না আমেরিকা এবং একথা ইরান রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক স্মৃতিতে চিরদিন অম্লান থাকবে।
বার্তা২৪ ডটনেট/এসএফ
ইরানের ওপর সামরিক হুমকি বাড়াচ্ছে আমেরিকা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।
আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।
এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন
তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?
আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন
এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান
এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়
সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন