ঐশ্বর্যকে আমি কোথায় প্রথম দেখি ঠিক মনে নেই । ওর জন্যে আমার মনে একটু দুর্বলতা ছিল । খবরের কাগজে ওর ছবি বেরোলে আমার বুকের মধ্যে ঢিপিস ঢিপিস হত ফিল্মি কায়দায় ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ডের মতো । অন্য ঘ্যাম কোন ছবি দেখলেও ঢিপি ঢিপিস হতো, কিন্তু পূর্বোক্ত ঢিপিস ঢিপিস ছিল একেবারে অন্যস্বাদের । সে আমি তোমাদের বোঝাতে পারবো না । কেবল আমার যে বেষ্টফ্রেন্ড ( ধরা যাক তার নাম 'গ' ) তাকে বলেছিলাম । ব্যাটা একটা গাধা । বলে কিনা ডাক্তার দেখা ।
আমি জানতাম এর চিকিতসা একমাত্র ঐশ্বর্যই করতে পারে । আমি ওকে নিয়মিত চিঠি লিখতাম যদিও ঐশ্বর্যের কাছ থেকে আমি কোন উত্তর পেতাম না । গাধাটা বলত, এসব প্লেটোনিক প্রেম ছাড় । ভাল স্যাটি মেয়ে দেখে প্রপোজ কর দেখি । এমনও হয়েছে 'তাল' বলে একটা সিনেমা চলছিল তখন, পরপর চারটে শোতে ঐশ্বর্যের সঙ্গে কথা বলছি । তারপরও হলে বসে আছি দেখে মালিকপক্ষের লোক ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে । বাইরে হ্যাভক বৃষ্টি পড়ছিল, সারা রাত্তির প্যাচার মত ভিজলাম । তখনই আমি ডিসিশন নিয়ে নিই, এবার নিজের রক্ত দিয়ে ঐশ্বর্যকে চিঠি লিখব । রিপ্লাই না পেলে, এই শর্মা আর জীবনটাই রাখবে না ।
আল্টিমেটলি অবশ্য চিঠিটা লেখা হয়েছিল গাধাটার বুদ্ধি দিয়ে, মুর্গীএর রক্তে । আমার আলটিমেটাম জানিয়ে দিই । সেই চিঠি ঐশ্বর্যকে পাঠিয়েছিলাম বিয়ারিং করে । মাইরি বলছি সেই সময় আমার কাছে কোন পয়সা ছিল না । আসলে পকেটে পয়সা থাকার কোন সিনই ছিল না । হলে 'তাল' চলছিল । পকেটে পয়সা থাকলে আমি হলের বাইরে থাকার মত বোকা নই । আমি আমার বন্ধুটার মত গাধা নই । ও তো যাকে পারতো তার সন্গে লাইন মারতো । আমি ওর বেষ্টফ্রেন্ড হওয়ায়, ও অবশ্য আমাকে সব কথাই বলত । ওর কোন ক্লাস-ফ্লাসের বালাই ছিল না, খালি ছুক-ছুক । ঐ অনেকটা তোমাদের কার্ল মার্কসের মত । আস্থা খালি 'মোড অফ প্রডাকশনে' । চিঠিটা পাঠিয়েও আমার শান্তিতে থাকার জো ছিল না । রাত্রে ঘুমাতে পারতাম না । কেবল মনে হত, যদি ঐশ্বর্য টের পেয়ে যায়, ওটা মুর্গীর রক্তে লেখা । আমার খুব ভয় করত । রাতে ভাল করে ঘুমোতে পারতাম না । আমার আবার ঘুম না হলে স্বপ্ন-ফপ্ন আসে না, মানে ধাতে নেই আর কী ! স্বপ্ন না দেখতে দেখতে আমি ক্রমশ ঐশ্বর্য এর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকলাম ।
আমার স্বস্তিতে থাকার যো নেই । আমার গাধা বন্ধুটার সাথে গন্গার ঘাটে যেতাম বটে, কিন্তু ওর সন্গে শান্তিতে দুটো কথা বলার যো ছিল না । ও দিব্যি লাইন মেরে যেত আর আমি খানিকটা তফাতে বসে ঘাস ছিড়তাম আর পিঁপড়ের বাসা ভাঙতাম । গন্গার দিকে আমি তাকাতাম না, ইনফ্যাক্ট আমার বেশ ভয় করত । স্বপ্নে আমি এখান থেকেই ঐশ্বর্যকে কাঁধে করে নদী পার করেছিলাম । ভাগ্যিস স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না । নিজেই শালা সাঁতার জানি না, আবার অন্যকে পার করা । প্রেস্টিজ পুরো ফেটে হাতে । স্বপ্ন আর বাস্তবে অনেক ফারাক । ঐশ্বর্য এই ঘাটে এসে দাঁড়ালে , মা কালীর দিব্যি, মিনিমান এককোটি লোক এসে গন্গার ঘাটে এসে জড়ো হয়ে যাবে । স্বপ্নে তো গাধাটাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি ! মনটাকে টেম্পোরারি বুঝ দিলাম, এই গ-ল আর প নিয়ে যত গল্পই থাক, রিয়ালিটিতে ডিফারেন্স আছে । গাধাটার কাজই ছিল আমাকে উপদেশ দেওয়া, বলল, এই ডিফারেন্সটা বোঝার জন্যে নাকি আমার দেরিদা পড়া উচিত ।
লাইব্রেরী থেকে বই গেঁড়িয়ে পড়া শুরু করে দিলাম । ইংরাজী আমার ধাতে সয় না, কিন্তু এই বইটা দিব্যি লাগতে লাগলো । লোকটাকে আমার বন্ধু মনে হলো । ল্যাং খেলে এই ধরনের অনেক লেখা মাথায় আসে । মাথা নেই, মুন্ডু নেই, লিখলেই হল । নতুন থিওরি দিচ্ছি । বই-এর পিছনে উত্তর মিলিয়ে কেউ খচাত করে কাটতে পারবে না । দেখলাম, ফিলজফার হওয়াটাই বেশ । ব্যাপারটা মাথার মধ্যে তিনদিন ধরে ঘুরপাক খেল । আল্টিমেটলি শেপ নিল এক মাঝরাত্তিরে । লোকনাথের ক্যালেন্ডারটার পেছনের জমিতে নামিয়ে ফেললাম । গ-ল আর প কে নিয়ে আদতে কোন গল্পই হতে পারে না । আগে অনেক ত্রিকোণ প্রেমের গল্প ফেঁদেছো, তখন এই শর্মা আসেনি বলে রক্ষা পেয়েছো । আমি থাকলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিতাম । বাইনারি থিয়োরি ঝেড়ে দেখলাম, মূল চরিত্র দুটো । নিউট্রনটা বাড়তি, আসল হল পজিট্রন আর ইলেকট্রন । সেটাকে এক্সপ্লেন করলাম ফ্রয়েড ঝেড়ে একই চরিত্রে নারী ও পুরুষের লক্ষণ কিভাবে থাকে ... ..।
আমার থিসিসটা গাধাটাকে ডেকে শোনালাম । 'গ-ল-প' -এর শেষটা শুনে ও হ্যাভক খচে গেল । বললো, তোর পেট গরম হয়েছে, গন্গর হাওয়া খাবি চ । আমি রাজি হলাম না । 'মাইরি বলছি, সত্যি কথাটাই ওকে বললাম, গন্গা দেখলে আমার ভয় করে । গাধাটা 'হাইড্রোফোবিয়া' ,না 'হাইড্রোসিল' কী সব বিড়বিড় করতে করতে হাওয়া হয়ে গেল ।
এবার সুনীল গান্গুলিকে ষ্ট্রেটকাট একটা চিঠি লিখে ফেললাম, জানিয়ে দিলাম, বাংলা বর্ণমালায় 'গ-ল-প' তিনটে অক্ষর ফালতু রাখার কোন মানে হয় না । 'প'টাকে হটিয়ে দেওয়ার জন্যে বাইশখানা গোলা গোলা জুক্তি দিয়েছিলাম ( আসলে 'ল' তে ল্যাংচা, লজেন্স, লরি সব হেভি হেবি জিনিস, 'প'তে পেঁদানি, পড়াশোনা সব খারাপ খারাপ ওয়ার্ড এগুলো আমি অবশ্য ডিরেক্টলি ম্যানিফেষ্টোতে লিখিনি) । একমাস ওয়েট করলাম, মালটার কাছ থেকে কোন রিপ্লায় এলো না । মনে হল, ম্যানিফেষ্টো পড়ে সুনীল গান্গুলি ট্যান হয়ে গেছে । আবার ভয়ও করতে লাগলো, পুরো কনসেপ্টটাই না আবার নেতাজী করে দেয় । চুপিচুপি মুর্গীর রক্ত যোগাড় করে সুনীল গান্গুলিকে একটা হুমকি চিঠি লিখে ফেললাম । বরকতদের মত এই শর্মাও শহীদ হবে বাংলা ভাষার জন্য ।
তিনমাস কেটে গেল । নো রিপ্লাই । বুঝলাম ব্যাটা আমাকে ভয় পাচ্ছে । চেপে যেতে চায় । আমি আমার ক্ষমতা সম্পর্কে এবার নি:সন্দেহ হলাম, এন্থু ও বেড়ে গেল । রবীন্দ্র সদন- নন্দন চত্তরে চর্কি শুরু করে দিলাম । চারটে লিটল ম্যাগে আমার লেখা কবিতা বেরিয়ে গেল । ( কবিতা না ছাই, আমার ম্যানিফেষ্টোর ছ'টা / আটটা করে লাইন ছাপিয়ে নিচ্ছি এই সুযোগে) । বোল্ডার ঘোষ নামের এক মানবীর ফ্যানমেল এলো ঝাড়গ্রাম থেকে । গুরু গুরু ।
জনৈক সাহিত্যিকের স্মরণসভায় সবাই দেখলাম নিজের গল্প-কবিতা দিব্যি পড়ে চলে যাচ্ছে । আমিও পকেট থেকে ভাঁজ করা ক্যালেন্ডারটা খুলে একসময় পড়তে শুরু করি । কবিদের মতো গলায় ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে দিব্যি পড়ছিলাম । জনৈক পাঠিকা, সম্ভবত ঐ সাহিত্যিকের যুবতী স্ত্রী ( তিন নম্বর বা চার নম্বর নিশ্চয়ই) সদ্য বিধবা হঠাত চেঁচিয়ে উঠলেন , এই সব ' গাল-গল্প' বন্ধ করুন । বুঝতে পারলাম আমার লেখা তার পুরোটাই ট্যান হয়ে গেছে । মুচকি হেসে বললাম, ওসব পুরনো 'গল্প' ভুলে যান, দাদারা গল্পের শাঁস-আঁটি সবই খেয়ে ফেলেছেন, এখন শুধু 'গাল'টুকু পড়ে আছে । ঝাড়ি মেরে দেখলাম, তার ফর্সা গালটা স্যাট করে লাল হয়ে গেল । বুকের মধ্যে টের পাচ্ছি সেই ঢিপিস ঢিপিস, যেন ডাইনোসরে ডন দিচ্ছে । 'প্রেম'এ পড়লাম নাকি? না: 'প' টাও ইম্পর্টেন্ট মনে হচ্ছে । প্রেমে, প্লেনে আর প্লেগেও রক্ষা করো বাবা লোকনাথ, তোমার সার্ভিস আরেকটু এক্সটেন্ড করে দাও বাবা ।
প্রথম প্রকাশ : ছায়াবৃত্ত, বর্ষ ১, সংখ্যা ৯, অক্টোবর ২০০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


