টিভি দেখার সখ বলেন আর ফ্যাশন বলেন কোনটিই এখন এই বান্দার নেই। তবে পছন্দের টিমের খেলা থাকলে টিভির সামনে বসা হয় মাঝে মাঝে। অতি সাধনায় কেনা পছন্দের টিভিটা এজন্য হয়তো মাঝে মাঝে অভিমান করে। তার অভিমান ভাঙতেই কখনো কখনো বেচারার মুখোমুখি বসি!
আজো বসলাম। কোন অনুষ্ঠানই পছন্দ হচ্ছিল না বিধায় রিমোট নিয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল বাড়িগুলো ঘুরছি। হঠাৎ পয়লা নম্বর বাটনে চাপ পড়তেই পর্দায় বিটিভি বাবাজি হাজির।
তবে নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত, ভুল করে!
দেখলাম ফেইসবুক প্রতিদিন নামে একটা অনুষ্ঠান চলছে। উপস্থাপক বেশ গুরু-গম্ভীর! (আগে কখনো দেখিনি)। ফেইসবুক কিভাবে ব্যবহার করবেন? উপকারিতা/অপকারীতা নিয়ে অনুষ্টান সাজানো।
বাহ! বেশ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। একটু আয়েশ করে, ভাব নিয়ে বসলাম। দেখি নতুন কিছু শেখা যায় কী না!! হাজার হোক তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর অনুষ্ঠান।
একটি ভিডিও ক্লীপে দেখলাম আনুমানিক ১২/১৩ বছরের একটি স্কুল ছাত্রীকে (স্কুল ইউনিফর্ম পরা) রিপোর্টার জিজ্ঞেস করছেন-
আচ্ছা, ফেইসবুকে কোন পোস্ট দেখলে তুমি কিভাবে রিএ্যাক্ট কর, আই.... মিন.... প্রটিক্রিয়া (প্রতিক্রিয়া) দেকাও (দেখাও) -
উত্তরে সে বল্ল-
পোস্ট শুধু পসন্দ (পছন্দ) করলে লাইক, বিষ্মিত হলে ওয়াও, ডুক্ষিটো (দুঃখিত) হলে স্যাড, আর........... !! (ইতস্ততা)
বল, বল টামলে (থামলে) ক্যান (কেন)?
আর...... আর..... রুমান্টিক অথবা হার্ট টাচিং কিসিমের কিছু হলে লাভ (Love) !!........... সাথে মেয়েটির চমৎকার হার্ট টাচিং টাইপের মুচকি হাসি! কিলার স্মাইল!!
এবার রিপোর্টার বাহাদুর বেজায় খুশি। আহা, কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
কিছুক্ষণ পর শুরু হলো রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনুষ্টান। উপস্থাপিকা বেশ রসিয়ে রসিয়ে গায়কের সাথে আলাপ করছেন। আমার ভালই লাগছিল বিটিভির সৌজন্যে নতুন দুইজন গুণী মানুষকে চিনতে পারলাম বলে! এর আগে উনাদের কখনো দেখেছি, এই তথ্যটি স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতেও পেলাম না।
বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। শুরু হলো কাঙ্খিত রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠান।
হায় হায়..........
একি শুনি!
সুর......তাল....... লয়....... কিছুই ঠিক নেই। গানটি শেষ হতেই উপস্থাপিকা প্রশংসার বণ্যায় এক্কেরে গায়ককে পদ্মা, মেঘনা হয়ে বঙ্গপোসাগরে ভাসিয়ে দিলেন!
আহ! ক্ষণজন্মা প্রতিভা।
তিনি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পৃথিবীর কেউ উনার সঙ্গীত প্রতিভার মূল্যায়ন না করলেও সরকারী গণমাধ্যম (বিটিভি) ঠিকই বিরল এ প্রতিভাকে জাতির সামনে উপস্থিত করেছে। এজন্য আসুন বিটিভির এ প্রতিভা অন্নেষণের প্রচেষ্টাকে দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে সম্মান জানাই!
তবে তিনি কোন কোটাধারী কি না, জানা যায়নি।
মাহফুজুর রহমানের এটিএন চ্যানেল থাকায় শেষ বয়সে এসেও উনার সঙ্গীত প্রতিভার ঝলক জাতির কাছে পৌছিতে পেরেছে। সবার তো আর টিভি চ্যানেল নেই! এজন্য বিটিভি বিরল এ প্রতিভাগুলো জাতির সামনে উপস্থাপন করছে। ওয়েল ডান, বিটিভি!
এখন স্যাটেলাইট জমানায় শহুরে মানুষ কোন দিন ইত্যাদি প্রচারিত হয় টের পায় না। অবশ্য তাতে খুব একটা সমস্যা নেই। ইউটিউব বাবাজি আছেন আপনার ইত্যাদি দেখার সখ মেটাতে।
দেশে সর্বসাকুল্যে সরকারি চ্যানেল তিনখানা, থুক্কু সাড়ে তিনখানা! বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ড ও সংসদ টিভি। আর সাড়ে তিনখানা এ কারণে যে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রটি কখন উদয় হয় আর কখন অস্ত যায় তার সঠিক পরিসংখ্যান এই বান্দার কাছে নেই।
ভাবছি! বিটিভি আর বিটিভি ওয়ার্ল্ড একই মোড়কে দুইটি চ্যানেল কেন? সম্ভবত চ্যানেলটি আমেরিকা, ব্রিটেন, চায়না, জাপান, রাশিয়া ও জার্মানির অনুরোধে খোলা হয়েছে। যাতে বিশ্বসেরা বাঙালির গর্বের ধন চ্যানেলটা উনারা দেখতে পান।
এটা স্রেফ আমার অনুমান। ডিফরেন্ট ভাবনাও থাকতে পারে!
বিটিভির আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর কাজটা কী? সম্ভবত আমার মতো অনেকেই তা জানেন না। তবে আমার মনে হয় বিটিভির সুউচ্চ টাওয়ারগুলো পাহারা দেওয়া।
আইমিন, ওয়াচম ম্যান! আর প্রতিবছর বিটিভির জন্মদিনে স্থানীয় বিগ আইটেম (নেতা) দিয়ে কেক কাটা!!
বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদ মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, আমার নাটক যখন বিটিভিতে প্রচারিত হত তখন স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না। এজন্য মানুষ মন ভরে দেখতো। এযুগে হলে তো কখন নাটক প্রচার হতো মানুষ জানতোই না!
হ্যা, মানছি কথাটির পক্ষে যুক্তি আছে। তবে এ যুগেও উনার নাটক মানুষ দেখতো। কারণ তিনি জানতেন কিভাবে মানুষকে আনন্দ দিতে হয়।
এতো গেল বিটিভির রূপের বিবরণ। এখন দেখা যাক বিটিভি আমাদের জন্য কি কি উপকার করতে পারে। হাজার হোক সরকারী টিভি। এক্কেরে উপকারী না হলে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নিশ্চয় তিনি বিশাল বহর নিয়ে স্ট্যাচুর মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকতেন না!
ধরুন, আপনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। বাংলাদেশের নতুন নতুন অনেক প্রতিভাবান শিল্পী, উপস্থাপক ও প্রডিউসারকে চেনেন না। মাত্র দুইটা দিন ধৈর্য ধরে নাওয়া, খাওয়া আর ঘুম বাদ দিয়ে কলম খাতা নিয়ে বিটিভির সামনে বসে পড়ুন।
ব্যাস, সহজেই প্রতিভাগুলো আপনার গুডবুকে চলে আসবে।
অনেক দিনের সখ টিভিতে গান গাইবেন। কিন্তু প্রাইভেট স্যাটেলাইট টিভিগুলো পাত্তাই দিচ্ছে না। যোগাযোগ করুন বিটিভির সাথে। তবে এক্ষেত্রে সরকারী বড় আমলা হলে লাইন পেতে সুবিধা হবে। টিভি (তথ্য) সচিব/মন্ত্রীর খাস লোক হলে তো আরেক কদম এগিয়ে। বাকিদের মন খারাপের কোন কারণ নেই পকেট ভরা সেলামী থাকলেই জামাই আদর জুটবে!
পত্রিকা ও ফেইসবুকে দেশের অনাচার, দুর্ণীতি, অবিচার এবং হাহাকার দেখে হয়তো আপনি ত্যক্ত বিরক্ত। আপনি বেশি না মাত্র একটা দিন সময় করে বিটিভি দেখুন। আর বেশি ব্যস্ততা থাকলে শুধু সংবাদ। ব্যাস, আপনার সব রাগ পানি হয়ে যাবে।
দেশব্যাপী শুধু উন্নয়ন আর উন্নয়ন চোখে পড়বে, কোথাও কোন অবিচার নেই। দেশটা এক্কেরে উন্নয়নে ঠাসা, এক ফু্টো দুর্ণীতি, অবিচার এই বাংলার জমিনে নেই। একদম ফকফকা আলোকিত দেশ। খুশির জোরে পাবলিক গড়াগড়ি খাচ্ছে।
অনেক দিন হলো গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয়নি। কি আর করা, বিটিভির সামনে বসে পড়ুন! দেখবেন বিশ-ত্রিশ বছর আগের স্টাইলে বিটিভি বাবাজি চলছে। মানুষের বয়স বাড়ে, চুল পাকে, অভিজ্ঞতা হয় কিন্তু বিটিভি যেন চিরযৌবনা। ত্রিশ বছর আগে চেহারা যেমন ছিল এখনো তাই আছে! একদম!!
বিটিভি আপনার ফ্ল্যাট বাড়িতে বসিয়ে রেখে কল্পনায় শৈশবে নিয়ে যাবে। আহ! সোনালী সেই টগবগে দিনগুলো।
আপনার কানে কোন কারণে তালা লেগে গেছে। ডাক্তার দেখিয়েও লাভের লাভ কিছুই হয়নি। মধ্যরাতে যখন বিটিভি সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বন্ধ হয় তখন চ্যানেলের পর্দা থেকে যে সুরেলা (ঝাঁঝালো) মিউজিক আপনার কর্ণমূলে আঘাত করবে তাতে পর্দার লকটা অটোমেটিক খুলে যাবে। তারপরও কাজ না হলে একদম ফুল ভলিয়মে টিভির মুখের কাছে কানটি লাগিয়ে বসে পড়ুন।
এবার তালা খুলতেই হবে! এখন আফসুস করবেন, কেন যে শুধু শুধু ডাক্তারকে পয়সাটা দিলাম! জলে গেল টাকাটা!!
ধরুণ আপনার আদরের সন্তান কোন অবস্থায় বিয়েতে রাজি হচ্ছে না। মেয়েদের নিয়ে তার বিস্তর অভিযোগ। মায়েরা যদি একটু বুঝিয়ে সুজিয়ে ছেলেকে নিয়ে রাত আটটার বিটিভির সংবাদ দেখতে বসেন তহলে কাজ হবে গ্যারান্টি!
দেখ বাবা, মেয়েটি কি সুন্দরী! কি সুন্দর করে খবর পড়ছে। এক্কেরে স্ট্যাচুর মতো। আহ! কি ভদ্র, শালীন একটি মেয়ে। এমন মেয়েও এ যুগে হয়? চমৎকার রূপ-লাবণ্য! আমি একদম এই মেয়েটার মতো একটা প্রিন্সেস তোর জন্য দেখে এসেছি। রাজি হয়ে যা বাবা। তোর মনের মতো হবে!!
আচ্ছা বলতো পটল, সব মেয়ে কি সমান?
ভয় পাইস না, বাবা। লক্ষী সোনা আমার!
দেখবেন মুচকি হাসি দিয়ে রাজপুত্র সম্মতি জানিয়ে দেবে। আবার যাদের রিডিং পড়তে সমস্যা হয় তারাও বিটিভির সংবাদ দেখতে পারেন। চমৎকার অনুশীলন হবে!
তবে বিটিভি সবচেয়ে উপকারি বাক্স তাদের জন্য, যারা সময় সুযোগে খোলস বদলায়। এসব বহুরূপী রাজনীতিবিদরা বিটিভি দেখে উদ্ভোধ্য হবেন, নিশ্চিত! ইলেকশনে সরকার চেঞ্জ হলে সাথে সাথে বিটিভি যেভাবে ইউ-টার্ণ করে তা পুরোপুরি রাজনীতিবিদরা অনুকরণ করলে, সফলতা শতভাগ।
সবশেষে দুইখান প্রশ্ন,
দুপুর দুইটার বাংলা সংবাদ কেন অন্য স্যাটেলাইট টিভিতে পুণঃপ্রচার করা হয়, তা দেশ ও জাতির কী কোন উপকারে আসে?
বিটিভির মহা! পরিচালকের নাম কী?
(বিঃদ্রঃ প্রশ্নটি শুধুমাত্র বিসিএস পরীক্ষার্থী ও সরকারী চাকরি প্রত্যাশিদের জন্য, বাকিদের না জানলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না!)।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৮ দুপুর ১:২৯