বিশ্ব মানের কোন ইউনিভার্সিটি কেন বাংলাদেশে নেই তার কারণগুলো অনুসন্ধান করা জরুরী। আমরা যারা অমুক-তমুক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্বে ফুলে যাই এগুলো সেরার তালিকায় থাকা দূরে থাক, মোটামুটি মানেও নেই কেন? তা জানা দরকার। আসুন কারণগুলো একে একে জেনে নিই।
(১) অদক্ষ প্রশাসন; রাজনৈতিক বিবেচনায় দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এখানে তাদের মূল যোগ্যতা দলীয় আনুগত্য আর চাটুকারিতা। এই মেরুদন্ডহীন পরিচালকের ছোয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও গবেষণার কাজ এগোনোর পরিবর্তে পিছিয়ে যায়। কেউ কেউ তো শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেন। এছাড়া কর্মস্থলে না যাওয়ার সংস্কৃতি আছে কারো কারো।
(২) শিক্ষক রাজনীতি; অধিকাংশ শিক্ষক রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিতে মশগুল। শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। তাদের একমাত্র কাজ গবেষণা ও পাঠদানে সীমাবদ্ধ নয় বলে শিক্ষার মানোন্নয়ন ব্যহত হয়। শিক্ষকদের প্রমোশন ও স্কলারশিপে রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারবে না।
(৩) রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ; বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতো পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ এটি। এতে অধিকাংশ সময় অদক্ষরা সুযোগ পায়। এছাড়া এরা শিক্ষক হওয়ার পরও রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করে। একাডেমিক কার্যক্রমে দাদাগিরি করে। কোন কোন শিক্ষক তো অনার্স শেষ করেই শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান!
(৪) ছাত্র রাজনীতি; একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে ছাত্র রাজনীতি যথেষ্ট। ছাত্ররা যখন ক্লাশ আর গবেষণা বাদ দিয়ে রাজনীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নিয়ে মশগুল থাকে তখন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনতিবিলম্বে ছাত্র রাজনীতি ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর আইন করা আবশ্যক।
(৫) বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রক্রিয়াটি হাস্যকর। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ছাত্ররা কোচিং সেন্টারগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তোতাপাখির মতো গাইডবই মুখস্থ করে। এই প্রক্রিয়ায় ভর্তি বন্ধ করতে হবে। যে ছাত্র যে বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায় শুধু সে বিষয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া উচিৎ। কোচিং সেন্টার আর গাইড বই নিষিদ্ধ করতে হবে।
(৬) অতিলোভী মনোভাব; অনেক শিক্ষক নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির পাশাপাশি অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বড় বেতনে চাকরি করেন। এতে মূল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণায় সময় দেওয়ার ফুরসত থাকে না। এগুলো বন্ধ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।
(৭) বিদেশ যাত্রা; কোন কোন শিক্ষক স্কলারশিপ নিয়ে বছরের পর বছর বিদেশে পড়ে থাকেন। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেতন নেন! বছরের পর বছর এই অনৈতিক কাজ করলেও সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিশ্চুপ! যারা বেতন ভাতা নিয়ে দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থান করে বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে আসবে না তাদের কাছ থেকে সমুদয় অর্থ ফেরৎ আনতে হবে। না দিলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। এদের অনুপস্থিতিতে ছাত্ররা বঞ্চিত হয়।
(৮) বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ; বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না। এটা দুঃজনক। শুধু স্থানীয় শিক্ষক না রেখে বিদেশি শিক্ষক নিয়োগ দিলে শিক্ষার পরিবেশ আরো সুন্দর হতো।
(৯) আবাসিক ছাত্রাবাস; বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আবাসিক ছাত্রাবাস থাকায় ছাত্র ছাত্রীরা এই এলাকাকে নিজের বাড়ির মতো মনে করে। এতে তাদের মধ্যে ক্ষমতার দাম্ভিকতা আর অপরাধ প্রবণতা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া ক্লাসেও মনোযোগী কম হয় এরা। এজন্য আবাসিক হলগুলো একাডেমিক এলাকা থেকে দূরে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।
(১০) গবেষণার অভাব; এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজারো পিএইচডি দেওয়া হলেও উনাদের গবেষণাকর্ম কী বিশ্ব মানের হয়! কারণ, এসব পিএইচডি-ধারীদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি সবই শুধু কাগুজে! এজন্য প্রকৃত গবেষকদের গবেষণায় উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে রিসার্চ ফ্যাসিলিটি বাড়াতে হবে। বিদেশি রিসার্চারদের নিয়ে আসতে হবে। দেশিদের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে।
(১১) নামমাত্র ফি'তে ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা বন্ধ করা উচিৎ। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশেও ফ্রিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই। প্রয়োজনে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছাত্রদের "স্টুডেন্ট লোন" দেওয়া যেতে পারে। চাকরি জীবনে যাওয়ার পর সে ধাপে ধাপে তা পরিশোধ করবে। উচ্চ ফি দিয়ে ছাত্ররা পড়াশুনা করলে তারা ক্লাসে এবং গবেষণায় মনোযোগ দিতে বাধ্য থাকবে; অভিভাবকরাও সচেতন হবে। শিক্ষকরাও ফাঁকিবাজি করার সুযোগ কম পাবে।
মনে রাখতে হবে, পিএইডি (PhD) অর্জন কোন সার্টিফিকেট নয়; এটা গবেষণা কর্মের স্বীকৃতি।।
ফটো ক্রেডিট,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৯ দুপুর ১:৪৪