বাজেট আসলে আমার মতো নিম্নবিত্ত মানুষের হার্টবিট বেড়ে যায়। কারণ, আমরা অতি সাধারণ জনগণ; না পারি বাজেট পূর্ব আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে, না পারি নিজেদের অভাব-অনুযোগ-শঙ্কার কথা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানাতে। আমরা অর্থনীতির বিরাট বিরাট তথ্য আর অগ্রগতি বুঝি না; শুধু বুঝি নিত্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল-লবণ-দুধ-তেল-পেয়াজ ইত্যাদির দাম কমছে কিনা? অথবা স্থির আছে কিনা? আমরা না পারি চুরি করতে, না পারি আওয়াজ করে নিজেদের দারিদ্র্যতা প্রকাশ করতে, না পারি পেটের খিদে সহ্য করতে। এজন্য নীরবে শুধু পর্যবেক্ষণ করি।
পৃথিবীর সব সভ্য দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা হয় বাজেটে। যাতে অল্প আয়ের মানুষের কষ্ট না হয়। প্রয়োজনে সরকার ভর্তুকীর ব্যবস্থা করে। কারণ, এই বাজেটের সিংহভাগ যোগান দেয় এসব খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদের দেশের অতি উচ্চবিলাসী, অতি ধনী এমপি/মন্ত্রীরা কি এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখেন?
এবারের বাজেটে গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে। কিন্তু এর বিকল্প হিসাবে পাস্তুরিত তরল দুধের যোগান ও মান ঠিক আছে কিনা তা কি যাচাই করা হয়েছে? গত দুই-তিন বছর থেকে দেশের নামকরা সব পাস্তুরিত দুধ কোম্পানীর প্যাকেটে ডিটারজেন্ট/শ্যাম্পুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শুধু শ্যাম্পু দিয়েও এসব দুধ তৈরী করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। এগুলো নিয়ে টিভি, পত্রিকায়ও অনেক লেখালেখি হয়েছে। আর পাস্তুরিত দুধে খাল-নালা-ড্রেন-টয়লেটের পানি তো হরহামেশা মেশানো হয়। এসব প্রতিবেদন দেখে কোন সুস্থ মানুষ এসব দুধ নামক বিষ কিনে খাবার কথা নয়। এজন্য বিকল্প হিসাবে বাধ্য হয়ে গুঁড়ো দুধ খাচ্ছে। আমরাও গুঁড়ো দুধ খেতে চাই না; চাই শতভাগ নিরাপদ আর পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধ পাস্তুরিত তরল দুধ। বিএসটিআই/সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কি তা করতে পেরেছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের গবেষণার তথ্যমতে,"পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধে ডিটারজেন্ট, এন্টিবায়োটিক ও ফরমালিন, গুঁড়া মশলায় (হলুদ) টেক্সটাইল রঙের উপস্থিতি এবং তেল (পামওয়েল, সরিষা, সয়াবিন), ঘি ও ফ্রুট ড্রিংকস বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নির্ধারিত মান উত্তীর্ণ হতে পারেনি।"
পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনায় ‘ফ্যাট ইন মিল্ক’ এর বিবেচনায় ছয়টি নমুনা; ‘সলিড নট ফ্যাট’ বিবেচনায় পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের ১০টি নমুনার সবগুলো; ‘এসিডিটি এনালাইসিস’ বিবেচনায় পাস্তুরিত দুধের একটি নমুনা ও অপাস্তুরিত দুধের তিনটি নমুনা; ‘টোটাল ব্যাকটেরিয়া কাউন্ট’-এ পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলো, ‘কলিফর্ম কাউন্ট’-এ পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার দুইটি, ‘স্টেফাইলোকক্কাস স্পেসিজ কাউন্ট’ হারে পাস্তুরিত দুধের পাঁচটি নমুনার পাঁচটি মানোত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে।
গবেষনা মতে, "খাদ্যপণ্যে যত্রতত্রভাবে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহৃত হলে আমরা বাঁচতে পারব না। মরে যাব। মানুষ ও পশুর জন্য ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক সম্পূর্ণ আলাদা। গরুকে মানুষের এন্টিবায়োটিক দিলে, দুধ ও মাংসের মাধ্যমে তা আবার মানুষের শরীরেই প্রবেশ করে। যা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিষয়। তিনি বলেন, পরীক্ষায় পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনার সবগুলোতেই মানব চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়াও অপাস্তুরিত দুধের একটি নমুনাতে ফরমালিনও মিলেছে। অন্য একটিতে পাওয়া গেছে ডিটারজেন্ট।"
অথচ বিএসটিআই কিছুদিন আগে ১৪টি ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে আশঙ্কাজনক কিছু নেই বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয়! ব্র্যান্ডগুলো হলো পুরা, আয়রান, আড়ং ডেইরি, ফার্ম ফ্রেশ মিল্ক, মো, মিল্ক ভিটা, আফতাব, আল্ট্রা, তানিয়া (২০০ গ্রাম ও ৫০০ গ্রাম), ইগলু, প্রাণ মিল্ক, ডেইরি ফ্রেশ, মিল্ক ফ্রেশ এবং কাউহেড পিওর মিল্ক।
বাজারে প্রচলিত ৮টি ঘিয়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চালানো হয়। এগুলো হলো- বাঘাবাড়ি, প্রাণ, মিল্কভিটা, মিল্কম্যান, সমির ও টিনে বিক্রি হওয়া নামবিহীন দু’টি নমুনা। বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ঘিয়ে জলীয় উপাদান ও আয়োডিন ভ্যালু যতটুকু থাকার কথা রয়েছে এসব নমুনায় তার থেকে বেশি পাওয়া গেছে।
এই বিএসটিআই দিয়ে আমাদের হবেটা কী? দুধের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যে ভেজাল ধরতে পারে না যে মাথামোটা সরকারি সংস্থা এদের বাঁচিয়ে রেখে কি লাভ আমাদের? প্রতি মাসে পাবলিকের করের শত শত কোটি টাকা যে সংস্থার পেছেনে খরছ হয়, সেই পাবলিকের কাছে তাদের কোন দায় নেই কেন? সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কি এই দুর্নীতির আখড়া প্রতিষ্ঠানটিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ? নাকি নিজেরাও জড়িত? মিল্ক ভিটার মতো সরকারি দুগ্ধ খামারের দুধে এন্টিবায়োটিক, শ্যাম্পু আর ডিটারজেন্ট থাকবে কেন? এগুলোর জবাব দিতে হবে।
ফটো ক্রেডি,
গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৭