somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাসবন্ধু...

২৮ শে নভেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সকাল বেলা আমাদের বাস ছাড়তো ঘড়ি ধরে, কাটায় কাটায় আটটায়। এক সেকেন্ড কম না এক সেকেন্ড বেশি না। ঢিমে তেতালার এই দেশে এমনটা হলে আনন্দিত হবারই কথা। কিন্তু আমাদের ভারি রাগ লাগতো। কেননা বরাবরের লেটলতিফ আমরা, নগর ভবন পার হয়ে আসতে আসতেই দেখতে পেতাম আমাদের বাসগুলো নাকের ডগা দিয়ে আস্তে আস্তে, একটা একটা করে ছেড়ে যাচ্ছে। তখন টারজানের মতন মুখের কাছে পাঞ্জা নিয়ে আ...আ...আ...করে হাক ছাড়তে ছাড়তে ঝেড়ে একটা দৌড় লাগাতে হত। তারপর বাসের পেছনের গেটের কাছটায় পৌছাতে পারলেই হিন্দী ছবির রোমান্টিক নায়কের মতন হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছুটতে হত বাসের পেছন পেছন। একটা না একটা হাত জুটেই যেত। টেনে ফুটবোর্ডে তুলে ফেলত ঠিক ঠিকই। ব্যাস, শুরু হয়ে যেত যাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাইনি সেটা নয়, ফুটানি দেখাতে গিয়ে আমরা বলতাম- ‘হেহ...!এইসব ছোট খাটো জায়গায় আমরা পড়ি না!’ কিন্তু তবুও ঘুরে ফিরে আমাদের সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিই মাড়াতে হত। কেননা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস স্ট্যান্ডটা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মধ্যেই! তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেপুলেদের কাঁচকলা দেখাতে দেখাতে আমরা ছুটে চলতাম আমাদের ক্যাম্পাসের দিকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাড়াবাড়ি রকম সবুজ ক্যাম্পাস শহরের বাইরে থেকেই হাত ছানি দিয়ে ডাকতো যেন। বাসের দরজায় দাড়িয়েই টের পেতাম, অদ্ভুত এক অস্থিরতা শরীরময় দৌড়ে বেড়াতো তখন।
দূরত্ব আর যানজট মিলিয়ে মোটমাট দেড় থেকে দুই ঘন্টার রাস্তা। পথের মাঝে মাঝে বাস থামিয়ে ছাত্রদের তুলতো। শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, শ্যামলী,মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর সবখান থেকে ছেলে মেয়েরা উঠতো। তবে আমরা যারা গুলিস্থান থেকে উঠতাম অধিকাংশ সিট থাকতো তাদের দখলে। তাই আমাদের সাথে খাতির জমানোর লোক বড় একটা কম ছিল না। কিন্তু সেজন্য ঘটনা যেটা ঘটতো সেটা ভিষন রকম বেখাপ্পা। দেখা যেত খাতিরের লোকজনকে সিট দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত আমাদেরই দাড়িয়ে একজন আরেকজনের বোগলের গন্ধ শুকতে শুকতে যেতে হচ্ছে সারা পথ। কিন্তু তবুও দেখতে দেখতে আমাদের জীবনের টালি খাতায় বন্ধুত্বের নতুন একটা পৃষ্ঠা যোগ হয়ে গেল। তার শিরনামে লেখা- ‘বাসবন্ধু’।
অদ্ভুত ছিল আমাদের সেই বন্ধুত্ব। ক্যাম্পাসের মাটিতে আমরা কেউ সিনিয়র, কেউ জুনিয়র। অথচ বাসের ভেতর আমরা সবাই বন্ধু। পেছনের দরজাটা আর তার আশে পাশের কয়েক লাইন সিট, পুরোটাই ছিল আমাদের দখলে। বাসের ইঞ্জিন এর ক্রমাগত গো গো শব্দ, হাইওয়ে দিয়ে বয়ে চলা শো শো বাতাস আর আশে পাশের গাড়ির র্হন মিলে মিশে একটা কেমন যেন অস্পষ্টতা তৈরি করে ফেলত আমাদের কথায়। চিৎকার না করলে কেউ কিছু শুনতে পেতাম না। মজার ব্যাপার হল বাসের পেছনের দরজায় দাড়িয়ে চিৎকার করে করে জীবনের গভীর তম গোপন কথাগুলো অনায়াসে একজন আরেকজনকে বলে ফেলতাম আমরা। কে জানে হয়তো জমে থাকা স্বীকারোক্তি গুলো, ভেতরে চেপে রাখা গোপন কথা গুলো চিৎকার করে বলতে পারতাম বলেই বোধহয় আমাদের বাসের ভেতর খুব আড্ডা মারতে ইচ্ছে হত।
আর কি এক একখান চরিত্র যে ছিল আমাদের মধ্যে! ফিলোসফি ৩৩ এর পাপ্পু ভাই, আই টি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে কম্পিউটার সায়েন্সের ছেলেদের নাকানি চুবানি খাইয়ে দিত। তার বন্ধু সোহান ভাই, অতি অল্প বয়সে ডায়াবেটিস বাধিয়ে ভারি একটা হাসির খোরাকে পাল্টে গেছিল বেচারা। ফার্মেসি ৩৬ এর তনু ছেলেটা কি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতো! কত কি জানতো সাহিত্যের! আমরা সাহিত্যের ছাত্র হয়ে মাঝে মাঝে তব্দা মেরে যেতাম ওর কথা শুনে।
ইংরেজী ৩৪ এর সজীব ভাই সিনেমার মহা ওস্তাদ লোক। ছবি বানানোর কায়দা কানুন নিয়েই সারা রাস্তা বক বক করতো। আর ছিল সেই মেয়েটা।সেই কলজে মোচড়ানো সুন্দর মেয়েটা। শ্যামলী থেকে রোজ উঠতো। যাকে দেখলে সারাটা বাসের ভেতর ছেলেদের উশখুশ শুরু হয়ে যেত। হঠাৎ তার মুখের দিকে তাকালে টের পেতাম এক্ষুনি বুকের মাঝে একটা হৃদস্পন্দন হারিয়ে গেল। যার কথা ভেবে এক ভর সন্ধ্যায় আমি কোন কারন ছাড়াই খুব কেঁদেছিলাম। নাহ! তার নাম বেত্তান্ত আজও জানা হল না!
গাবতলির ভিড় ভাট্টা ঠেলে ঠুলে একটু সামনে এগুলেই পিচঢালা মহাপথ। শহরের বাইরের প্রথম পদক্ষেপটাই যেন সব। দুপাশে যেই একটু সবুজের দেখা মেলে অমনি আমাদের গলা চিরে বেরিয়ে আসে গান। লং প্লে রেকর্ডের মতন একটার পর একটা, একটার পর একটা চলতেই থাকে। হিন্দী, বাংলা, ব্যান্ড, লালন কোন ধরাবাধা নেই। যা মনে আসে তাই।গান গল্পের ফাকে ফাকে প্রায়ই এর ব্যাগ থেকে চানাচুর, ওর ব্যাগ থেকে গোটা কতক পাকা কলা, নিদেন পক্ষে ডাবলি ভাজা, বাদাম ভাজা বেরুতো। তারপর তাই দিয়ে চলতো ভোজ। অতিতুচ্ছ সব জিনিস, অথচ কি আনন্দ তখন ভেসে বেড়াত আমাদের বাসবন্ধুদের মাঝে! আসলে যৌবনের আনন্দগুলো বড় অদ্ভুত। ছোট, সুক্ষ্ম তার ধার, কিন্তু জীবনের গায়ে কেমন যেন মোটা মোটা আচড় কেটে যায়। তারপর সেই মোটা মোটা দাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেটে যায় আমাদের বাকিটা জীবন।
প্রত্যেকটা সকাল তখন অন্যরকম ছিল। প্রত্যেকটা দিন আগের দিনটার চেয়ে অন্যরকম, একদম ভিন্ন। আরো, আরো অনেক বেশি সুন্দর। মনে হত প্রত্যেকটা দিনই যেন এক একটা আনন্দময় পিকনিক।
একদিন আমাদের সেই পিকনিক পিকনিক জীবনে একটা ভারী দুখের ঘটনা ঘটে গেল। কি জানি কোন কারনে ৩৬ এর তনু একদিন বুড়িগঙ্গায় ঝাপিয়ে আত্মহত্যা করে বসলো। আমার ঠিকমতন কাঁদতেও পারলাম না। বুড়িগঙ্গার ময়লা কালো জলে ওর শীতল দেহটা ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেই কথাটাও আমরা জানতে পারলাম সাতদিন পর। হীন্দুদেরতো কবর হয় না, নদী থেকে তুলে কাঠ-কেরোসিন দিয়ে ওকে পুড়িয়ে ফেলল। তনুর সাথে এই জীবনে আমাদের আর কোনদিন দেখা হল না। কত কি জানতে চাওয়ার ছিল আমাদের, কত কি জিজ্ঞেস করার ছিল ওকে, সেসব উত্তর আর কোনদিন মিলবে না জানি। ওর দীর্ঘ আখি পল্লব আর বাদামী চোখ দুটোয় একধরনে বিষন্নতা দেখতাম মাঝে মাঝে। সে এমনই এক রহস্য থেকে গেল, এ জীবনে আর কোনদিন তার ভেদ জানতে পারবো না।
তারপর সময় কেটে যায়। সবাই কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। কেউ পাশ করে চাকরি ধান্দা ধরলো। কেউ বিদেশে চলে গেল। ভার্সিটির বাসের সময়ও পাল্টে গেল। আস্তে আস্তে আমরা সবাই সবাইকে হারিয়ে ফেললাম। আমাদের আর দেখা হয় না। তবু পথে দেখা পেলে মনের ভুলেই মাঝে মাঝে দৌড় ঝাপ করে ভার্সিটির বাসে উঠে পড়ি। দেখি বাস ভরা একগাদা কচি কচি অচেনা মুখ। আমার সেই বাসবন্ধুদের চেনা মুখ গুলো আর কোথাও খুঁজে পাই না।
একদিন শুধু দেখলাম সেই কলজে মোচড়ানো সুন্দর মেয়েটাকে, তার বাম হাতের অনামিকায় একটা হীরের আংটি ঝলকাচ্ছে। অভিমানে চোখ ভরে যায় জলে। খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-‘শোন, তোমার জন্য এক সন্ধ্যায় কোন কারন ছাড়াই খুব কেঁদেছিলাম আমি, অথচ তোমার নামটাও আজঅব্দি জানা হল না আমার! জানো? কত কি জানতে চাওয়ার ছিল আমার, তোমার কাছে, তনুর কাছে, আমার বাসবন্ধুদের কাছে! কিছুই জানা হল না, কিচ্ছু না!’
বলা হয়না, কোন কিছুই বলা হয় না। আমার চারদিকে বাসভর্তি নতুন নতুন মুখ। কত আনন্দ তাদের! কত গান! এক একটা দিন যেন পিকনিক! কিন্তু সেই আনন্দের ঢেউ আমাকে ঠিক স্পর্শ করে না। চারপাশে আনন্দের স্রোত নিয়ে আমি বিচ্ছিন্ন বদ্বীপের মতন চুপচাপ বসে থাকি বাসের সিটে। পিঠের ব্যাগটা বুকে চেপে ধরে তাতে মুখ গুজে দেই। বুকচিরে স্বশব্দে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। অথচ কেউ টের পায় না। বাসটা ছুটেই চলে, ছুটেই চলে, থামে না। দীর্ঘশ্বাসের অনুবাদ আমি শিখিনি এখনো, তবু ঠিক টের পাই যেন সে বলছে,-‘আহা জীবন! আহা! একটু আস্তে যাও না ভাই! ক্লান্ত লাগে বড়, আর যে পারি না!’
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×